Advertisement
০৯ মে ২০২৪
Coronavirus

লজ্জা

এত দিন যে ভাবে চলিয়াছে, অর্থব্যবস্থাকে আর সে ভাবে চলিতে দেওয়া যায় না। দরিদ্র মানুষের কথা পৃথক ভাবে ভাবিতেই হইবে।

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২০ ০০:৫৫
Share: Save:

অতিমারির বিপদও যে শ্রেণি-নিরপেক্ষ নহে, গত কয়েক দিনে তাহা প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণিত। তাহার শারীরিক বিপদ যেমন, আর্থিক বিপদও তেমনই— আর্থিক ভাবে দুর্বলতমদের উপরই তাহার প্রকোপ সর্বাধিক। ভারত যেমন হাইওয়ে ধরিয়া বিপন্ন মুখের মিছিল প্রত্যক্ষ করিয়াছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তেমন পরিসংখ্যান মিলিতেছে যে কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিকরা শ্বেতাঙ্গ বা এশীয়দের তুলনায় কোভিড-১৯’এর শিকার হইতেছেন অনেক বেশি। কারণটি তাঁহাদের বর্ণে নাই, আছে সামাজিক অবস্থানে— তাঁহারা কেবল সুষম আহারের অভাবে পুষ্টির মাপকাঠিতে বঞ্চিত নহেন, ফুসফুস সহ বিবিধ শরীরযন্ত্রের বড় ক্ষতি হইতে পারে, এমন জীবনযাত্রা করিতে তাঁহারাই বাধ্য হন, কারণ তাঁহারা দরিদ্রতম। সেই শারীরিক ক্ষতি তাঁহাদের কোভিড-১৯’এ আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা বাড়াইয়াছে। দরিদ্রের বিপত্তি আরও বাড়িবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শ্রমবিষয়ক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন (আইএলও) জানাইয়াছে, শুধু ভারতেই অদূর ভবিষ্যতে আরও চল্লিশ কোটি মানুষ গভীরতর দারিদ্রে তলাইয়া যাইবেন।

স্পষ্টতই, এত দিন যে ভাবে চলিয়াছে, অর্থব্যবস্থাকে আর সে ভাবে চলিতে দেওয়া যায় না। দরিদ্র মানুষের কথা পৃথক ভাবে ভাবিতেই হইবে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়াছেন, প্রয়োজনে টাকা ছাপাইয়া গরিব মানুষের মধ্যে বিলি করিতে হইবে। যে ভাবেই হউক, দারিদ্রের করাল গ্রাস হইতে তাঁহাদের উদ্ধার করা জরুরি, নচেৎ ঘোর বিপদ। এই বিপদটিকে অন্তত তিনটি স্তরে দেখা যাইতে পারে। প্রথম, দরিদ্র মানুষের বিপদ— এক দিকে তাঁহারা অর্থাভাবে আরও বেশি উন্নয়ন হইতে বঞ্চিত হইবেন, অন্য দিকে রোগব্যাধি তাঁহাদের আরও জর্জরিত করিবে। দ্বিতীয়, যদি গরিব মানুষের ঘরে অন্তত নুন-ভাতের ব্যবস্থা না থাকে, তবে রাষ্ট্র যতই লকডাউনের কথা বলুক, তাঁহারা পথে নামিবেনই। না নামিয়া তাঁহাদের উপায়ান্তর নাই। ফলে, কোভিড-১৯ আরও পরাক্রান্ত হইবে, সার্বিক ভাবেই বিপত্তি বাড়িবে। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ ভাবে এই বিপদটির কথা উল্লেখ করিয়াছেন। তৃতীয় বিপদটি মনুষ্যত্বের। দেশের, অথবা দুনিয়ার, বিপুলসংখ্যক মানুষ চূড়ান্ত দারিদ্রে থাকিতে বাধ্য হইতেছেন, প্রাণের ঝুঁকি লইয়া বাঁচিতেছেন প্রতি দিন— এই বাস্তবটিকে মানিয়া লওয়া, তাহাকে চলিতে দেওয়া মনুষ্যত্বের অপমান। এই বিপুল অসাম্যের সুবিধাজনক প্রান্তে থাকিয়া যদি অবস্থাটির চূড়ান্ত অন্যায্যতাকে মানুষ ভুলিয়া থাকে, তবে মনুষ্যত্বের উপর তাহার আর দাবি থাকিবে না। যে দেশ, যে পৃথিবী রচিত হইবে, তাহা ভয়ানক। তাহা সভ্যতার লজ্জা।

অভিজিৎবাবু যে পরামর্শ দিয়াছেন, তাহাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা চলে। আবার, তাহার অর্থ অনুধাবন করিয়া সেই পথে নীতিনির্মাণও সম্ভব। বস্তুত, তাহাই বাঞ্ছনীয়। বিলি করিবার জন্য টাকা ছাপাইবার পরামর্শটির বিরুদ্ধে নব্যধ্রুপদী অর্থনীতির আপত্তি সুগভীর। তাহা ভিত্তিহীনও নহে। অভিজিৎবাবু সেই আপত্তি সম্বন্ধে বিলক্ষণ অবহিত। তাহার পরও এই পরামর্শের একটিই অর্থ হয়— এই মুহূর্তে অন্য সব বিবেচনাই অবান্তর, এখন শুধুমাত্র গরিব মানুষের কথা ভাবিতে হইবে। তাহার জন্য যদি মুদ্রাস্ফীতি ও তজ্জনিত মূল্যবৃদ্ধি হয়, তাহাই সই; যদি রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ হু হু করিয়া বাড়িতে থাকে, তাহাও সই। অবস্থাপন্নদের সমস্যা হইলে তাহাকে মানিয়া লইতে হইবে। মধ্যবিত্তকে সুবিধাভোগের অভ্যাসটি ত্যাগ করিতে হইবে। দেশের সিংহভাগ মানুষ আজ যে অকল্পনীয় বিপদের সম্মুখীন, এত দিন এই সুবিধাগুলি সেই সিংহভাগ মানুষকে বঞ্চিত করিয়াই মিলিতেছিল। বণ্টনের অসাম্য যে শুধু অনৈতিক নহে, অতি বিপজ্জনক, ভারত এই বার কথাটি বুঝিলে মঙ্গল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Abhijit Banerjee Pandemic
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE