বন্ধ বস্তুটি সমতলে যতখানি পীড়াদায়ক, দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে তাহার অপেক্ষা শতগুণ বেশি। পশ্চিমবঙ্গের পাহাড় অধিবাসীরা আপাতত সেই পীড়ার চরম পর্যায়ে পৌঁছাইয়াছেন, তাঁহাদের বাসভূমি আজ সাতাশ দিন যাবৎ লাগাতার বন্ধ-অধীন। খাবারদাবার-স্কুল-কলেজ-কাজকর্ম বন্ধ করিয়া এই ভাবে সাধারণ মানুষকে অসীম বিপদের মুখে ঠেলিবার আশ্চর্য অমানবিকতা কেবলমাত্র রাজনীতিকদেরই থাকিতে পারে। রাজনীতিকরা মানুষের নামে রাজনীতি করেন, বিশেষ করে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে উত্তাল-উদ্ধত নেতারা তো আঞ্চলিক অধিবাসীদের নামেই নিজেদের রাজনৈতিক স্বীকৃতির ভূমিটি রচনা করেন। অথচ মানুষের ভালমন্দকে তাঁহারা নিজেদের ভাবনাচিন্তার মধ্যে কত কম জায়গা দেন, দেখিলে তাজ্জব বনিতে হয়। পাহাড় তো যে কোনও জায়গা নহে যে চাহিলেই কোনও না কোনও পথ দিয়া খাদ্য-পানীয় পৌঁছাইবে! তাহাকে নিজের দৈনন্দিন প্রয়োজনের জন্যই সমতলের মুখাপেক্ষী হইতে হয়। পাহাড়-সমতলের সেই সম্পর্কটি যদি এই ভাবে জোর করিয়া রুদ্ধ করিয়া রাখা হয়, তাহাতে সমতলের অপেক্ষা বহু গুণ বেশি ক্ষতি পাহাড়েরই। কোন যুক্তিতে বিমল গুরুঙ্গ এবং গোর্খাল্যান্ড-অভিলাষী নেতৃবৃন্দ বন্ধ প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত হইবার পরও জোরদার চালাইবার কথা ভাবিতেছেন, তাঁহারাই জানেন। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এই প্রশ্নও তুলিতে হয় যে, কোন যুক্তিতে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ তাঁহাদের নেতাদের পিছনে এখনও সমর্থন জুগাইয়া চলিতেছেন, শতকষ্ট স্বীকার করিয়াও সেই সমর্থন প্রত্যাহার করা কিংবা পাল্টা আন্দোলনের বার্তা দিয়া তাঁহারা নেতাদের সামলাইবার কথা ভাবিতেছেন না।
রাজ্য প্রশাসনেরও কিছু দায় বহন করিতে হইবে বইকি। মুখ্যমন্ত্রী এই বারের পাহাড় সংকট নিয়ন্ত্রণ করিবার বহু চেষ্টা করিয়াছেন, তাঁহার সরকার নানা ভাবে সাধারণ মানুষকে অভয় দিবার প্রয়াস করিয়াছেন, সবই সত্য। কিন্তু রাজ্যের একাংশ এই ভাবে লাগাতার অচল হইয়া থাকিলে আর কী করিতে হইবে, তাহা রাজ্যের প্রশাসকদেরই ভাবিতে হইবে। সেই ভাবনার দীনতায় পাহাড় অঞ্চলের বাসিন্দাদের এতখানি অসহায়তা বা বিপদের মধ্যে ঠেলিয়া দেওয়া চলিবে না। বিশেষ করিয়া যখন পাহাড়ে বন্ধ বস্তুটি চার বৎসর আগেই বিচারবিভাগীয় নির্দেশে বেআইনি বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে, সেই পরিস্থিতিতে কোনও রাজনৈতিক দল একনাগাড়ে বেআইনি কাজটি করিয়া গেলে প্রশাসনের কী কর্তব্য, তাহা দ্রুত স্থির করিতে হইবে। গোর্খাল্যান্ডের দাবি মানার প্রশ্ন নাই, সেই দাবির সামনে রাজনৈতিক জমি ছাড়িবারও হয়তো প্রশ্ন নাই। কিন্তু প্রয়োজনে আদালতের নির্দেশ ভাঙিবার জন্য কঠোর ব্যবস্থা লওয়া সম্ভব। তাহার পরিবর্তে, গত এক মাস ধরিয়া এক অতীব আপত্তিকর পরিস্থিতির সামনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজনীতিকদের দেখিয়া দেখিয়া রাজ্যবাসী ক্লান্ত।
সৌভাগ্য, শেষ পর্যন্ত আবারও সেই হাইকোর্ট হইতেই জরুরি ভর্ৎসনাবাক্যগুলি শোনা গেল। আদালতের বক্তব্য পরিষ্কার। কে বন্ধ আটকাতে পারিবেন, কাহার সেই দায়িত্ব, এ সব বিষয়ে বিচারবিভাগের কিছু বলিবার নাই। কিন্তু আঞ্চলিক দল, রাজ্য প্রশাসন, কেন্দ্রীয় সরকার, কোনও পক্ষ হইতেই যে যথেষ্ট উদ্যোগ লইয়া অচলাবস্থা শেষ করিবার চেষ্টা হইতেছে না, তাহা পরিষ্কার। মুখ্যমন্ত্রী বারংবার কেন্দ্রের অসহযোগিতার কথা বলিতেছেন। তাঁহার অভিযোগ যথেষ্ট সারপূর্ণ। কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবের দরুণ এত চরম দুর্ভোগ সাধারণ মানুষ কেন পোহাইবে, বিচারবিভাগ তাহা জিজ্ঞাসা করিবেই। গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে এই সমালোচনা ও প্রশ্নের অবকাশ যে এখনও হারাইয়া যায় নাই, এইটুকুই আশার কথা। আদালতের ভর্ৎসনায় কাজ হইবে কি না, তাহা অবশ্য প্রশ্নমাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy