Advertisement
E-Paper

পর্দা খসে পড়তেই ক্লেদাক্ত চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে

দলীয় বৈঠকে অনুব্রত মণ্ডলের কথোপকথনের যে ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে, সে ভিডিয়ো যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আইন-কানুন, প্রশাসন বা সাংবিধানিক কাঠামোর নামে কী অসীম প্রহসন চলছে।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৫৬
অনুব্রত মণ্ডল। —ফাইল চিত্র।

অনুব্রত মণ্ডল। —ফাইল চিত্র।

প্রথমেই বিধিবদ্ধ বার্তাটা দিয়ে রাখা জরুরি— দলীয় বৈঠকে অনুব্রত মণ্ডলের কথোপকথন বা নির্দেশ দেওয়ার যে ভিডিয়োটি ঘিরে তুমুল তোলপাড় চলছে, সে ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু সত্যতা সম্পর্কে সেই সংশয়কে মান্যতা দিয়েও সাংবাদিকতার বুনিয়াদি শিক্ষার ভিত্তিতে কয়েকটা প্রশ্ন তুলতে হয় এবং ওই শিক্ষার ভিত্তিতেই বলা যায়, অনুব্রত মণ্ডল নতুন কিছু বলেননি বা করেননি, একটা পর্দা খসিয়ে দিয়েছেন মাত্র।

দুজনকে গ্রেফতার করিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে দেখা গিয়েছে বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে। ‘গাঁজার কেস’ দেওয়ার কথা বলতেও শোনা গিয়েছে। কোথায় বসে বলছেন কথাগুলো? তৃণমূল কার্যালয়ে আয়োজিত দলীয় বৈঠকে।

প্রশ্নগুলো এখানেই ওঠে সর্বাগ্রে। কাউকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেওয়ার অধিকার অনুব্রত মণ্ডল পেলেন কোথা থেকে? কোন ‘কেসে’ গ্রেফতার করানো হবে, তা স্থির করে দেওয়ার এক্তিয়ারই বা এল কোন উৎস থেকে?

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

অনুব্রত মণ্ডল কি পুলিশ আধিকারিক, নাকি প্রশাসনিক কর্তা? তিনি কি কোনও আদালতের বিচারক? যদি না হন, তা হলে কোন অধিকারে পুলিশকে এমন নির্দেশ দেওয়ার কথা ভাবেন তিনি?

তবু আবার বলি, নতুন কিছু নয়, একটা পর্দা খসেছে মাত্র। আরও উৎকট ভাবে সামনে এসেছে ব্যবস্থার অন্দরের ক্লেদটা। পুলিশ-প্রশাসনের উপরে নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টার অভিযোগ অনেক আগে থেকেই উঠে আসছে। বাম জমানাতেও শোনা যেত যে, শাসকের অদৃশ্য অঙ্গুলিহেলনেই পুলিশ-প্রশাসন পা ফেলে। অনুভবও করা যেত সে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু যখন তখন হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাওয়ার ঢঙে সেই অশুভ নিয়ন্ত্রণ প্রকাশ হয়ে পড়ত, এমনটা নয়। তৃণমূল জমানায় মাঝে-মধ্যেই তেমনটা হচ্ছে, অনেক খোলাখুলিই চলছে প্রশাসনের উপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। বার বার রাজ্যের নানা প্রান্তে তার প্রমাণ মিলছে। শুধু রাজনীতিকরা আদেশ দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন এমন নয়। প্রশাসনিক কর্তারাও অতি-সাংবিধানিক হয়ে ওঠা রাজনীতিকদের আদেশ পালন করাকে অভ্যাসগত করে ফেলেছেন। পুলিশ-প্রশাসন হয়ে উঠছে শাসকের সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার।

দলীয় বৈঠকে অনুব্রত মণ্ডলের কথোপকথনের যে ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছে, সে ভিডিয়ো যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আইন-কানুন, প্রশাসন বা সাংবিধানিক কাঠামোর নামে কী অসীম প্রহসন চলছে। ভিডিয়োর সত্যতা নিয়ে অনুব্রত মণ্ডল নিজে প্রশ্ন তুলেছেন ঠিকই। কিন্তু তৃণমূলের তরফে ভিডিয়োকে ভুয়ো আখ্যা দিয়ে সামূহিক নিন্দা বা প্রতিবাদ হয়েছে, এমন নয়। অনেক ইঙ্গিত মিলে যায় তাতেই।

আরও পড়ুন: সঙ্গীতা-ফঙ্গিতা চিনি না, সব রং চড়ানো: অনুব্রত এক্সক্লুসিভ

বাম জমানার শুরুর দিকেও এই প্রবণতা ছিল না। অন্তত প্রথম দুটো মেয়াদে বামফ্রন্ট সরকারের গায়ে এই কাদা ছেটানোর অবকাশ তদানীন্তন বিরোধীরা পাননি। তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকার থেকেই অবক্ষয়টা শুরু হয়ে গিয়েছিল ধরে নেওয়া যেতে পারে। সপ্তম তথা শেষ বামফ্রন্ট সরকারের জমানায় অসহনীয় ঠেকতে শুরু করেছিল প্রশাসনের উপরে শাসক দলের নিয়ন্ত্রণ এবং পুলিশের দলদাসত্ব। তার জেরেই শেষ হয়ে গিয়েছিল বাম রাজত্বকাল।

কিন্তু আশাভঙ্গ হল বঙ্গবাসীর সম্ভবত। তৃণমূল তার রাজত্ব শুরুই করল ক্লেদে ডুবে যাওয়া বামফ্রন্টের কর্দমাক্ত জুতোটায় পা গলিয়ে। নতুন জুতো পরার কথা ভাবলই না।

তৃণমূলের সামনে একটা নতুন দিন দেখানোর সুযোগ ছিল। নতুন দিন দেখার জন্যই ঐতিহাসিক পরিবর্তনটা এসেছিল। কিন্তু ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে পা বাড়াল না এই নতুন জমানা। অন্তত আইন-শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার প্রশ্নে তো বটেই।

তৃণমূলের বা তৃণমূল পরিচালিত সরকারের ভুল-ক্রুটিগুলোর দিকে আঙুল তুললেই আজ পাল্টা আঙুল তোলা হয় বাম জমানার ক্লেদাক্ত সময়কালটার দিকে। ওই জমানার খারাপগুলো বেশি খারাপ ছিল, এই জমানার খারাপগুলো কম খারাপ— এই জাতীয় তুলনা টানা হয় এবং কু-তর্ক জুড়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ খারাপের সঙ্গে খারাপের তুলনা। ভালর সঙ্গে ভালর তুলনার কথা ভাবনার পরিসরেই আসে না বোধহয়। এই জমানার খারাপটাও ওই জমানার ভালটার চেয়ে ভাল— এমন কথা বলতে পারার অবকাশও যে তৈরি করা যেতে পারে, সে কথা কারও চিন্তায় উঁকি দেয় না সম্ভবত। জনগণ কিন্তু দুটো খারাপের মধ্যে থেকে একটাকে বেছে নিতে চায় না, জনগণ আরও ভাল কিছুর আশায় ভোট দেয়, আরও ভাল দিন দেখার বাসনা নিয়ে রং বদলে দেয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকরা সে সব নিয়ে ভাবিত নন সম্ভবত। অনেক ভাল কিছু উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় আসেন। খারাপের সঙ্গে খারাপের তুলনাতেই দিন কাটিয়ে দেন। এই প্রতারণা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। প্রত্যেকের সে কথা বুঝে নেওয়া উচিত।

Anjan Bandyopadhyay Newsletter Anubrata Mandal TMC অনুব্রত মণ্ডল অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy