Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিকূলতা নিয়েও এখনও বেঁচে রয়েছে পুরুলিয়ার নিজস্ব যাত্রা

শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে শুরু। তার পর বহু গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে পুরুলিয়ার মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে যাত্রা। এক কালে যা ছিল প্রতিটি বর্ধিষ্ণু পাড়ার চিহ্ন, আজ তা-ই রুগ্ণ। পুরুলিয়ার মানুষ কি তবে ভুলে যেতে বসেছে তাঁদের যাত্রাশিল্পকে? লিখছেন চণ্ডীদাস মুখোপাধ্যায়ছৌনাচ, নাটুয়া, পাতা, বুলবুলিনাচ এবং টুসু, ভাদু, ঝুমুর হয়ে উঠেছে পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই জন্মসূত্রে অর্জিত মঞ্চনাটকের গায়ের বিলিতি গন্ধকে ছাপিয়ে যাত্রার গায়ের মাটিমাটি গন্ধকে পুরুলিয়া আপন করে নিয়েছে এক অনায়াস নিজস্বতায়। আবেগমণ্ডিত যাত্রাপালা তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সঠিক উচ্চকিত উচ্চারণে পুরুলিয়ায়র মানবমনের নরম জমিতে আঁচড় কেটে তার সুখদুঃখের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে।

যাত্রার আসর। কাশীপুরের রাঙামাটি গ্রামে। নিজস্ব চিত্র

যাত্রার আসর। কাশীপুরের রাঙামাটি গ্রামে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩২
Share: Save:

পুরুলিয়ার মানুষ যাত্রাগানের অকৃত্রিম অনুরাগী ও ভক্ত, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে। আসলে নিজের পরিসরে ও ধারায় লোকসংস্কৃতির যেখানে স্ফূরণ হয়েছে, সেখানেই সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের আবেদনে সাড়া দিয়ে পুরুলিয়া দু’হাত বাড়িয়ে তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদকে পুরুলিয়া (প্রকৃতার্থে মানভূম) মেনে নেয়নি, লড়াই করেছে। বিদেশি সংস্কৃতিকেও এড়িয়ে গিয়েছে। নিজস্ব প্রাণোচ্ছ্বলতায় ও সৃষ্টির উন্মাদনায় গড়ে ওঠা লোককলা ও লোকশিল্প তাই পুরুলিয়ার রুখাশুখা মাটিতে তার শিকড় ছড়িয়েছে।

ছৌনাচ, নাটুয়া, পাতা, বুলবুলিনাচ এবং টুসু, ভাদু, ঝুমুর হয়ে উঠেছে পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই জন্মসূত্রে অর্জিত মঞ্চনাটকের গায়ের বিলিতি গন্ধকে ছাপিয়ে যাত্রার গায়ের মাটিমাটি গন্ধকে পুরুলিয়া আপন করে নিয়েছে এক অনায়াস নিজস্বতায়। আবেগমণ্ডিত যাত্রাপালা তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সঠিক উচ্চকিত উচ্চারণে পুরুলিয়ায়র মানবমনের নরম জমিতে আঁচড় কেটে তার সুখদুঃখের সঙ্গী হয়ে গিয়েছে।

সেই পঞ্চদশ শতকে শ্রীচৈতন্যের মস্তিষ্কপ্রসূত কেষ্টযাত্রা অনেক গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে কখন পুরুলিয়ার মাটিতে তার শিকড় ছড়িয়েছে তার ঠিকঠাক হিসেব কেউ রাখেনি। সে ইতিহাসকে অন্ধকারের জঠর থেকে বার করে আনতে তেমন ভাবে প্রচেষ্টা হয়েছে বলেও শুনিনি। তবে লোকপরম্পরায় শোনা যায় যে, বিশ শতকের প্রথম থেকেই যাত্রাগান বা যাত্রাপালা পুরুলিয়ায় তার পাকা আসন তৈরি করে নেয়।

এক কালে প্রায় প্রতিটি বর্ধিষ্ণু গ্রামে ও শহরের পাড়ায়-পাড়ায় উৎসাহী যাত্রামোদীদের যাত্রাদল (পার্টি) ছিল, ছেলেরা গোঁফ কামিয়ে মেয়ের অভিনয় করত। পৌরাণিক নাটক করার জন্য তাদের ঝলমলে পোশাক ছিল (বলা হত কাটা পোশাক— কেন এমন নামকরণ জানা যায়নি), ছিল মাথায় পরার নানা আকারের ছেলেদের ও মেয়েদের চুল, ছিল মুকুট ও তরবারি। মেক-আপ নিজেরাই বা গ্রামের কেউ করতেন, গোঁফ আঁকা হত ভুষো কালি দিয়ে। কোনও কোনও গ্রামে আবার পালায় সুর করার জন্য সারা বছর সবেতন সুরকার থাকতেন।

এক সময় বছরে নানা উৎসবে (পরবে) যাত্রাগান অনুষ্ঠিত হত। কোনও উঁচু মঞ্চ ছিল না। শ্রোতা-অভিনেতারা একই স্তরে থাকতেন। আলো বলতে, হ্যাজ়াকের আলো। অভিনয় চলাকালীন শ্রোতাদের বিরক্তি উৎপাদন করে সেগুলিতে পাম্প দেওয়া হত। তবুও শ্রোতারা সেই যাত্রা প্রাণভরে উপভোগ করতেন। অশেষ তাঁদের ধৈর্য, যাত্রার প্রতি অসীম তাঁদের ভালবাসা। শোনা যায় ‘মান্ধাতা’ নামে এক যাত্রাপালা সারারাত ধরে অভিনীত হয়ে সকালের সূর্যোদয়ে শেষ হত।

যাত্রাপালার প্রস্তুতিপর্বটাও ছিল অদ্ভুত। মহলা শুরু হত রাতের খাওয়ার পরে। চলত রাত ২টো পর্যন্ত। সকাল থেকে যে-যার নিজের কাজে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা অবশ্য পাল্টে গিয়েছে। প্রথম দিকে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের কথা নিয়ে রচিত হত যাত্রাপালাগুলি। অর্থাৎ, পৌরাণিক যাত্রাপালা অভিনীত হত। স্থানীয় ভাবে পালাগান লিখিত হত বলে জানা নেই। হয়ে থাকলেও তা খুব সীমিত পরিসরে ও একান্ত নিজেদের প্রয়োজনে। এ রকম কোন পাণ্ডুলিপির সন্ধান এখনও পর্যন্ত অমিল। কলকাতা থেকে প্রকাশিত যাত্রাপালা দিয়েই কাজ চলত। সেই অঙ্গনটিতে একচেটিয়া রাজত্ব করতেন শ্রীকৃষ্ণ, কংস, রাম, রাবণ ও কৌরব-পাণ্ডবদের দল-সহ হনুমান। শেষোক্ত জনের ‘হুপহাপ’ শব্দে আসর মাতানোর কথা মুখেমুখে প্রচারিত হত। এই অবস্থাটা চালু ছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

পঞ্চাশের দশকে এল ‘সোনাই দিঘি’ ও ‘হিটলার’। বলা যায়, যাত্রাপালায় এক রকম বিপ্লব নিয়ে এল নট্ট কোম্পানির ‘সোনাই দিঘি’ ও তরুণ অপেরার ‘হিটলার’। যাত্রাপালার ভোল পাল্টে দিল ওই দু’টি প্রযোজনা। পুরুলিয়ার যাত্রাদলগুলিও পিছিয়ে থাকল না। ইতিহাসভিত্তিক যাত্রাপালা শুরু হল। যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল রেখে ও সমসময়কে বুঝে নিতে এক সময় সামাজিক যাত্রাপালা আসন পেতে বসল। বহিরাগত মহিলা শিল্পী নিয়ে আসা হল, উঁচু পাটাতনের মঞ্চ তৈরি হল, দু’দিক দিয়ে মঞ্চে আসা-যাওয়ার দু’টি ঢালু পথ তৈরি হল, ‘স্পটলাইট’, ‘স্ট্রোব লাইট’-এর ব্যবহার শুরু হল। কিন্তু এতে আয়ের থেকে ব্যয় বেড়ে গেল। বহিরঙ্গে পরিবর্তন আনার চড়া মাসুল দলগুলিকে গুণতে হল। অধিকাংশ গ্রামের নিজস্ব গৌরবসূর্য অস্তমিত হল। পেশাদার দলের যাত্রাও আর পুরুলিয়াতে তেমন ভাবে আয়োজিত হয় না।

এখন কিছু জায়গায় জেলার যাত্রাদলগুলি অনেক লড়াই করে টিঁকে রয়েছে। বছরে বড়জোর এক বার তারা যাত্রা করতে পারে। দুর্গাপুজোর সময় বা তার এদিক-ওদিকে। কিন্তু তাতেও নিজেদের যাত্রাপ্রীতিকে টিকিয়ে রাখতে তাদের যে কী হারে অনুদানের নামে চাঁদা দিতে হয়, পুজোর কেনাকাটা কম করতে হয়, পুরনো জুতো তাপ্পি মেরে আর একটা বছর পার করে দিতে হয়, তা আমরা জানতে পারি না। তবে আশার কথা এই, তাদের এই সুবিন্যস্ত প্রযোজনাগুলি শ্রোতাঠাসা আঙিনায় অভিনীত হয় এই যুগের সর্বব্যাপী দূরদর্শন এবং ইন্টারনেট, ‘ইউটিউব’-এর প্রচণ্ড অভিঘাত সত্ত্বেও। পুরুলিয়ার নিজস্ব যাত্রা এখনও বেঁচে রয়েছে।

আশার কথা, জেলার সাঁওতাল সম্প্রদায় তাঁদের নিজের ভাষায় চিরাচরিত আঙ্গিকে যাত্রাপালা করা শুরু করেছেন। নিজেদের সম্প্রদায়ে এঁদের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। হয়তো এদের হাতেই হয়ত যাত্রার ভবিষ্যৎ নিরাপদ থাকবে।

লেখক পুঞ্চার প্রাক্তন শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Theatre Purulia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE