অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
ডিজিটাল দুনিয়াটা ঠিক কী রকম দেখতে, সহকর্মীদের নিয়ে আমি সেই মানচিত্র তৈরি করছি এখন। এটাই আমার গবেষণা। মজা করে মাঝেমধ্যে বলি, মধ্যযুগের মানচিত্রকাররা যেমন আসল পৃথিবীর ম্যাপ বানাতেন, আমাদের কাজটাও সে রকম। সেই পৃথিবীটা তৈরি করছেন বিভিন্ন মাপের, বিভিন্ন অবস্থানের মানুষ, সংস্থা— সিলিকন ভ্যালির, অথবা বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের বিপুল সব তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট, উদ্যোগপতি, বিভিন্ন দেশের সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা। এবং অবশ্যই দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ, এখন যাঁদের হাতে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। বাকি অর্ধেকও এই ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশের ছাড়পত্র পেতে ব্যাকুল। মধ্যযুগের মানচিত্রকারদের মতোই, আমাদের মানচিত্রেও ছবিটা নিতান্ত আংশিক। আমরা ‘ডিজিটাল ইভোলিউশন ইনডেক্স’ বা ‘ডিজিটাল বিবর্তন সূচক’-এর মাধ্যমে এই মানচিত্রের লাইন টানার চেষ্টা করছি। কিছু দিনের মধ্যেই প্রকাশ করব ‘ইজ় অব ডুয়িং ডিজিটাল বিজ়নেস’ নামের একটি সূচক। আমাদের হাতে তথ্য প্রচুর। কিন্তু, একটা জায়গায় আমরা এখনও অন্ধকারে— সেই মানচিত্রের কোন বিন্দুটা যে সত্যি মানুষ, কোনটা কম্পিউটারের অ্যালগরিদম্; কোনটা আসল আর কোনটা ভুয়ো, বোঝার উপায় নেই।
ফেক নিউজ়ের কথাই ধরুন। ডিজিটাল দুনিয়ায় বিশ্বাস তৈরির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। সেটাকে ঠেকানোর উপায় কী? এই প্রশ্নের সামনে পড়লে ডিজিটাল দুনিয়ার বড় কর্তারা হতবাক হয়ে যান, সমাধান খুঁজে বার করা আর ক্ষমতায় কুলোয় না। বস্তুত, তাঁরা আরও খানিক সমস্যাই তৈরি করেন। মার্ক জ়াকারবার্গই যেমন। সে দিন শোনা গেল, তাঁর ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ শুধু ভুয়ো খবর সংবহনই করে না, সেই খবর তৈরিও করে। নিউ ইয়র্ক টাইমস খবর করেছে, ফেসবুক নাকি এক মার্কেট রিসার্চ সংস্থাকে টাকা দিয়েছে বিলিয়নেয়ার জর্জ সোরোজ়-এর নামে মিথ্যে খবর ছড়ানোর জন্য। কারণ, সোরোজ়-এর প্রতিষ্ঠান ‘ওপেন মার্কেট ইনস্টিটিউট’-কে টাকা দেয়, যারা আবার ফেসবুক বিষয়ে মন্দ কথা বলে। ভুয়ো খবর তৈরি করানোর অভিযোগ ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই প্রথম নয়। এর আগেও একটি বাণিজ্যিক সংস্থা মামলা ঠুকেছিল, কত জন ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে তাদের বিজ্ঞাপন পৌঁছেছে, ফেসবুক সেই সংখ্যাটি বহু গুণ বাড়িয়ে চড়িয়ে বলছে।
ফেক নিউজ়ের হাতে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন কারা? আমার আশঙ্কা, যেখানে রক্ষাকবচ সবচেয়ে দুর্বল, সেখানকার ডিজিটাল নাগরিকরা। অর্থাৎ, উন্নয়নশীল দুনিয়ার মানুষ। এই দুনিয়ায় ফেসবুকের চেয়ে হোয়াটসঅ্যাপেই খবর বেশি ছ়়ড়ায়। একাধিক কারণে সেটা বেশি বিপজ্জনক। প্রথমত, হোয়াটসঅ্যাপে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন থাকায় কোনও বার্তার উৎপত্তিস্থল খুঁজে পাওয়া কঠিন; দ্বিতীয়ত, সংস্থা হিসেবে ফেসবুক যদিও বা ফেসবুকে তথ্য যাচাইয়ের কিছু ব্যবস্থা করেছে, তাদের অধীন হোয়াটসঅ্যাপে সে রকম কোনও ব্যবস্থা হয়নি। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকরা ফেসবুক নিয়েই বেশি চিন্তিত। চাপও সেখানেই বেশি।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিপদের চেহারাটা ঠিক কী, ভারতের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। হোয়াটসঅ্যাপে ভেসে আসা ভুয়ো খবরের ভিত্তিতে সাম্প্রতিক অতীতে ভারতে বেশ কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, অনেকের প্রাণও গিয়েছে। বিবিসি-র একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, যে সব বার্তা ভারতে হিন্দু ভাবাবেগের কথা বলে, জাতীয় সম্মানের প্রসঙ্গ টানে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতার মাহাত্ম্য প্রচার করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানোর ক্ষমতা তার বিপুল। নির্বাচন আসছে। আশঙ্কা হয়, এমন দুষ্কৃতীর সংখ্যাও বাড়বে। খেয়াল করার কথা, বিবিসি-র সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে ভুয়ো খবর তৈরির ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি অনেক এগিয়ে। সম্প্রতি ওয়ায়েল ঘোনিম-এর সঙ্গে আলাপ হল। মিশরে ‘আরব বসন্ত’-র অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। বললেন, দক্ষিণপন্থীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যে মেসেজ শেয়ার করেন, তার কেন্দ্রে রয়েছে ভীতি। আর বামপন্থীদের শেয়ার করা মেসেজের কেন্দ্রে থাকে লজ্জা। ভীতিই দ্রুত দৌড়োয়, বেশি দূর যায়।
ভারত একা নয়। শ্রীলঙ্কা আর মায়ানমারেও গুজবের ভিত্তিতে বিপুল হিংসা হয়েছে। তার প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুক টুকরোটাকরা পরিবর্তন করেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে অন্যত্র যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করার মতো কিছুই করতে পারেনি। ব্রাজ়িলের উদাহরণটি সাম্প্রতিকতর। সেখানে ভুয়ো খবর রটল যে ভেনেজ়ুয়েলা নাকি ব্রাজ়িলের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নাক গলাচ্ছে। আরও রটল, সদ্য-নির্বাচিত (চরম দক্ষিণপন্থী) প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর বিরোধীরা নাকি স্কুলে স্কুলে বাচ্চাদের বোতল বিলি করে বেড়াচ্ছে, যার ছিপিটা পুরুষাঙ্গের আকৃতিতে তৈরি। এই গুজবগুলো রটতে আরম্ভ করেছিল হোয়াটসঅ্যাপে, তার পর ফেসবুক আর টুইটার সেই আগুনে হাওয়া দেয়।
বিপদ কোথায়, তার খানিকটা আঁচ পাওয়া গেল। কিন্তু, সেই বিপদের চেহারাটা কী রকম? ২০১৬ সালের নভেম্বরে জ়াকারবার্গ বুক ঠুকে বলেছিলেন, মার্কিন নির্বাচনে ফেক নিউজ় বড় প্রভাব ফেলছে, এই কথাটা নিতান্ত পাগলের প্রলাপ। বাস্তব হল, তিনি যখন এই বিবৃতি দিচ্ছিলেন, তখনই ফেসবুকের অন্দরমহল জানত যে জ়াকারবার্গের কথাটা মোটেই সত্যি নয়। তার পর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের বহু ঢেউ ভেঙেছে, জ়াকারবার্গকেও বহু বার ঢোক গিলতে হয়েছে। কিন্তু, এই সমস্যা ঠেকানোর কোনও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা তাঁরা এখনও করে উঠতে পারেননি। তার একটা মস্ত কারণ হল, ফেক নিউজ় জ়াকারবার্গদের ব্যবসার পক্ষে লাভজনক। এই গুজবগুলো লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অনেকেই তা শেয়ার করতে থাকেন। যত বেশি লোক ক্লিক করবেন, যত শেয়ার হবে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ততই লাভ। গুজবের খেলায় আসল ভিলেন আসলে এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর কর্তারাই— যারা গুজব ছড়িয়ে বেড়ায়, তারা নেহাতই পার্শ্বচরিত্র।
কাজেই, কাউকে যদি চেপে ধরতে হয়, তবে তা জ়াকারবার্গদের। যে খেলা তাঁরা সাজিয়ে বসেছেন, তার জঞ্জাল সাফাইয়ের দায়িত্বও তাঁদেরই নিতে হবে। যে কোনও মূল্যে টাকা রোজগার করার প্রবণতা থেকে বার করে আনতে হবে তাঁদের ব্যবসাগুলোকে। ডিজিটাল দুনিয়াকে সভ্য, সৎ, নিরাপদ ও মানবসভ্যতার জন্য উপকারী রেখেও কী ভাবে নিজেদের ব্যবসাকে লাভজনক করে তোলা যায়, সেই পথ তাঁদেরই খুঁজতে হবে।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
(লেখক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টাফ্টস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুলে ডিন অব গ্লোবাল বিজ়নেস)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy