মেধা পাটকর মধ্যপ্রদেশে গত ২৭ জুলাই থেকে অনশন করছেন। তাঁর সঙ্গী আরও এগারো জন সমাজকর্মী। নর্মদা বচাও আন্দোলন-এর দীর্ঘ সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে সর্দার সরোবর প্রকল্পের জলাধারটি চালু করা যাবে না। আন্দোলনকারীদের দাবি, এই জলাধার চালু হলে প্রায় চল্লিশ হাজার পরিবার উৎখাত হবেন, তাঁদের অধিকাংশেরই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়নি, যেটুকু যা হয়েছে তা-ও নামমাত্র, বাস্তুহারাদের কোনও রকমে একটা জায়গা দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিকল্প জীবিকার কোনও সুবন্দোবস্ত হয়নি। নতুন কিছু নয় সেটা, আমাদের দেশে পুনর্বাসনের নামে চিরকাল যে নির্মম রসিকতা হয়ে থাকে, তারই পুনরাবৃত্তি। মধ্যপ্রদেশ সরকার অবশ্য বলেছে, পুনর্বাসনের কাজ ঠিকঠাক চলছে। সংসদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও অম্লানবদনে জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার আদালতের নির্দেশ পালন করছে। এ-সবই চেনা গল্প— অনেক যন্ত্রণা, বিক্ষোভ, আন্দোলন পার হয়ে যদি বা আদালতের কল্যাণে কিছু সুরাহার সম্ভাবনা মেলে, সরকারের কাছে তা আদায় করা অসম্ভব রকমের কঠিন। উপেক্ষা, ছলনা, মিথ্যে— কত অস্ত্র যে ক্ষমতাবানদের ভাণ্ডারে থাকে!
অনশন দীর্ঘতর হলে যদি মিডিয়ার ফেরে পড়তে হয়, সম্ভবত সেই ভয়েই ক’জন আধিকারিককে মেধা পাটকরদের কাছে পাঠিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, যদি ভুলিয়েভালিয়ে অনশন ভাঙাতে পারেন। প্রতিবাদীরা তাঁদের কাছে জানতে চান, সরকার কি তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে? আগে পুনর্বাসন, পরে জলাধার— এই দাবি মানার প্রতিশ্রুতি কি তাঁরা দিতে পারবেন? জবাব মেলে: তাঁরা প্রতিবাদীদের বক্তব্য রাজ্য সরকারকে গিয়ে জানাবেন, এইটুকুই তাঁদের দায়িত্ব। যেন সে বক্তব্য সরকার জানে না! কৌশল ব্যর্থ হয়, অনশন ভাঙেনি।
মেধা পাটকরের মতো সমাজকর্মীরা— নেত্রী বলব না, নেতা বা নেত্রীর মতো শব্দগুলো এই বাজারে তাঁদের পক্ষে অপমানজনক— আক্ষরিক অর্থেই জীবন বাজি রেখে অচলায়তনে আঘাত করে চলেছেন। এক বার নয়, বার বার। এক দিন দু’দিন নয়। দশকের পর দশক। ইতস্তত কিছু সঙ্গী আছেন আজও। ন্যাশনাল অ্যালায়ান্স ফর পিপলস মুভমেন্ট-এর মতো সংগঠন এই বিষয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। মেধাদের সমর্থনে রাজধানীতে সমাবেশের আয়োজন হয়েছে, প্রতীকী অনশনেরও, এমনকী কিছু রাজনীতিকও তাঁদের বিবিধ পবিত্র দায়দায়িত্ব সামলে তাতে কিছুক্ষণ যোগ দিয়েছেন।
বড় বাঁধের ফলে মানুষের বিপন্নতার সমস্যাটা নিছক মধ্যপ্রদেশের নয়, এটা জাতীয় সমস্যা। সেই প্রেক্ষিতেই কয়েক জন সাংসদ সমবেত ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আবেদন জানিয়েছেন। কিছু সচেতন সহনাগরিকের উদ্যোগে একটি আবেদন পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে, অনেকগুলি দেশের কয়েকশো সহমর্মী মানুষ তাতে স্বাক্ষর করেছেন, নোয়ম চমস্কি তাঁদের অন্যতম। তাতে বলা হয়েছে, অহিংস, গণতান্ত্রিক শাসনে মানুষের আস্থা বজায় রাখতে তাঁদের ন্যায্য অধিকার রক্ষার দাবি মেটানো জরুরি, তাই নর্মদা অববাহিকার বিপন্ন মানুষের সপক্ষে দাঁড়িয়ে ‘আপনাকে অবিলম্বে মনোযোগী হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি, যাতে তাঁরা জলপ্লাবনে সর্বস্বান্ত হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারেন।’
আন্তরিক কথোপকথনের গণতান্ত্রিক রীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে নরেন্দ্র মোদী সময় নষ্ট করতে চাইবেন কি? বিশেষ করে তাতে যদি নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ ব্যাহত হয়? সর্দার সরোবরে তাঁর নিজস্ব স্বার্থ বিলক্ষণ। গুজরাতে ভোট আসছে। এই প্রকল্পের ফলে সে রাজ্যে জলসেচের যুগান্তকারী উন্নতি হবে, এমন প্রচার চলছে অনেক দিন। এই বার জলাধার চালু করে দিতে পারলে ভোটের ফসল তুলতে সুবিধে হবে। সেই হিসেবের পাশে মধ্যপ্রদেশের কিছু বিপন্ন গরিবের স্বার্থ? প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে যা-ই আবেদন করুক, তাঁর এ বিষয়ে মাথা ঘামানোর কোনও কারণ নেই।
বিপন্ন মানুষের ন্যায্য অধিকার রক্ষার দাবি যদি পূরণ করতে হয়, তবে উপায় একটাই। সরকারকে সে দাবি পূরণে বাধ্য করা। কেবল নর্মদার অববাহিকায় নয়, গোটা দেশ জুড়ে অগণিত পরিসরে অগণিত মানুষের অগণিত সংকট মোচনের দাবি। যে সংকট অধুনা অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। যে সংকটের প্রতি নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সহ-শাসকদের অস্বাভাবিক ঔদাসীন্য। এবং যে সংকট সম্পর্কে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির, এমনকী তথাকথিত বামপন্থীদেরও অস্বাভাবিক নীরবতা। গত তিন বছরে এক বার শুধু কৃষক আন্দোলনের একটা উপক্রম হয়েছিল, অতি দ্রুত বিরোধী দলগুলি সেই সম্ভাবনাকে দিগন্তে বিলীন করে দিল। অথচ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন বর্গের মানুষের বিভিন্ন সংকটের মোকাবিলায় গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ গড়ে তোলাই এখন যথার্থ বিরোধী রাজনীতির কাজ। মেধা পাটকররা তাঁদের সাধ্য মতো, বস্তুত সাধ্যাতীত, লড়াই করছেন। কিন্তু আমাদের বিবিধ বিরোধী দল আর তাদের নেতা ও নেত্রীদের সাধ এবং সাধ্য যদি অলীক কুনাট্য রঙ্গেই সীমিত থাকে, তবে বুঝতে হবে, ভারতীয় গণতন্ত্রের পুনর্বাসনও দূর অস্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy