Advertisement
E-Paper

বাজার যাহা চাহে

বাজার শুধু ডিগ্রি দেখে না, তাহার দাবি নিয়োগযোগ্যতা। সেই গুণটি অর্জন করিতে না পারিলে এই শিক্ষার কোনও দাম, অন্তত বাজারের নিকট নাই।

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৩৭

স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী যুবকযুবতীরা বেয়ারার চাকুরিতে আবেদন করিলে যে হইচই আরম্ভ হইয়া যায়, তাহার এক ভাগ একটি বিশেষ মানসিকতাপ্রসূত— ‘ভদ্র ঘর’-এর, লেখাপড়া শেখা ছেলেমেয়েদেরও বেয়ারার কাজ করিতে হইতেছে, এ কী দুর্গতি! আপাতত সেই হাহুতাশটিকে সরাইয়া রাখা যাউক। হইচইয়ের বৃহত্তর কারণ, যে কাজ করিবার জন্য অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়াই যথেষ্ট, পিএইচ ডি ডিগ্রিধারীরা সেই কাজ করিবার অর্থ, অর্জিত বিদ্যার অপচয়। প্রশ্নটিকে, অতএব, বিদ্যা নামক ‘সম্পদ’ এবং তাহার বাজারের প্রেক্ষিতে দেখাই বিধেয়। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেয়ারার চাকুরিতে যে উচ্চশিক্ষিতরা আবেদন করিয়াছেন, তাঁহাদের অধিকাংশেরই বক্তব্য, বাজারে বেসরকারি চাকুরির স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা নাই। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি এমনই যে যে-কোনও দিন কোনও বেসরকারি সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হইতে পারে। তাহার তুলনায় সরকারি চাকুরি ভাল, হউক না তাহা বেয়ারার চাকুরি। আলোচ্য ঘটনাটি যদিও পশ্চিমবঙ্গের, প্রবণতাটি সর্বভারতীয়। মাঝেমধ্যেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ বা বিহারের ন্যায় রাজ্যের সমগোত্রীয় সংবাদ মিলে। সরকারি চাকুরির প্রতি মধ্যবিত্তের দুর্বলতা সুবিদিত। তাহার প্রধান কারণ, ভারতীয় মধ্যবিত্ত এখনও নিশ্চিতির মোহ কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। বাজারের প্রতি ভয় তাহার মজ্জায়। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে একটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ আসিবে। বাজারের প্রতিযোগিতায় চাকুরি টিকাইয়া রাখিবার এবং উন্নতি করিবার মতো শিক্ষার জোর বহু ডিগ্রিধারীরই নাই। কথাটি তাঁহারা জানেন। ফলে, সরকারি চাকুরির নিরাপত্তার টান তাঁহাদের নিকট অপ্রতিরোধ্য হয়।

‘শিক্ষাগত যোগ্যতা’ এবং চাকুরির বাজারের মধ্যে যে গরমিল তৈরি হইয়াছে, তাহার পিছনে আছে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মূলগত ত্রুটি। এই দেশে উচ্চশিক্ষা প্রায় ‘ডিফল্ট অপশন’ হইয়া দাঁড়াইয়াছে— উচ্চমাধ্যমিক পাশ করিবার পরে স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়া যে অধিকাংশ ছেলেমেয়েরই ‘স্বাভাবিক’ অগ্রগতি হওয়ার কথা নহে, ভারত এই কথাটি ভুলিয়াছে। প্রতি বৎসর যত ছাত্রছাত্রী গণিত হইতে ইতিহাস, অর্থনীতি হইতে সমাজতত্ত্ব, এমন হরেক বিষয়ে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন, তাঁহাদের কত শতাংশ সত্যই উচ্চশিক্ষার যোগ্য? প্রশ্নটির সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন। ব্যাঙের ছাতার মতো গজাইয়া উঠা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা ম্যানেজমেন্ট স্কুল হইতে বিস্তর পৈতৃক অর্থ ব্যয় করিয়া যাঁহারা ডিগ্রি অর্জন করিতেছেন, তাঁহাদের কয় জনই বা সত্যই কিছু শিখিতেছেন? বাজার শুধু ডিগ্রি দেখে না, তাহার দাবি নিয়োগযোগ্যতা। সেই গুণটি অর্জন করিতে না পারিলে এই শিক্ষার কোনও দাম, অন্তত বাজারের নিকট নাই।

উচ্চশিক্ষার প্রতি অনর্থক মোহ ভারতকে এই অবস্থায় আনিয়াছে। অথচ, উদার অর্থনীতির কল্যাণে দেশে হরেক স্তরের কাজের সুযোগ বাড়িয়াছে— এমনকী, মোদী জমানার অর্থনৈতিক তাণ্ডবের পরও সেই সুযোগ সম্পূর্ণ শুকাইয়া যায় নাই। সেই কাজের অধিকাংশের জন্যই ভারিক্কি ডিগ্রির প্রয়োজন নাই। দরকার প্রশিক্ষণের। যে কাজগুলি ‘ব্লু কলার জব’ হিসাবে পরিচিত, তাহাতে সুযোগ বেশি, টাকাও নেহাত কম নহে। কিন্তু, অধিকাংশ মধ্যবিত্তই এখনও ভাবিতে পারেন না যে সন্তান মোটর মেকানিক হইবে। তাহার বদলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ পাশ করিয়া বেয়ারার চাকুরিতে আবেদন করিলে রাষ্ট্রকে দোষ দিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলাও বুঝি শ্রেয়। প্রশিক্ষিত নার্স হওয়া অপেক্ষা বৎসরের পর বৎসর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতার পরীক্ষা দিয়া চলাও বুঝি ভাল। এই মানসিকতাই ডোবাইতেছে। বাজার কী চাহে, তাহা বুঝিতে না শিখিলে সেই বাজারে ঠাঁই পাওয়া মুশকিল, ভারতীয়রা কথাটি দ্রুত বুঝিলে মঙ্গল।

Educational qualification Job
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy