সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছেন বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ তথা ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি। তরুণ নেতার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বিক্ষোভে উত্তাল বাংলাদেশ। উত্তেজিত জনতার রোষ থেকে রেহাই পাননি সাংবাদিকেরাও। বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশের দুই সংবাদপত্র ‘প্রথম আলো’ এবং ‘দ্য ডেলি স্টার’-এর দফতরে ভাঙচুরের পরেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদে অশান্তি ছড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, কে ছিলেন এই নেতা, যাঁর জন্য ফের উত্তপ্ত হল বাংলাদেশ? সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবনে কী ভাবে এত দ্রুত আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছিলেন তিনি?
জন্ম বরিশালে। বাবা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। ছয় ভাইবোনের মধ্যে হাদিই ছিল সর্বকনিষ্ঠ। এ হেন হাদি মাদ্রাসা শিক্ষাশেষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। জীবনের মোড় বদলে যায় ২০২৪ সালের মাঝামাঝি। সে বছরের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। মূলধারার কোনও রাজনৈতিক দলে সক্রিয় ভাবে যুক্ত না থাকলেও সেই সময় থেকেই আন্দোলনের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন হাদি। জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবিতে হওয়া আন্দোলনে যে সব নেতা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, হাদি তাঁদের একজন হয়ে ওঠেন। বলা যেতে পারে, হাদির রাজনৈতিক উত্থান হয়েছিল এই আন্দোলনের সময় থেকেই।
জুলাই আন্দোলনের পর হাদির নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার একাংশ গড়ে তোলে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চ। এই মঞ্চের মূল দাবি ছিল, যাবতীয় আধিপত্যবাদের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ন্যায়বিচারের দাবি প্রতিষ্ঠা করা। ক্রমে হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কান্ডারি হয়ে ওঠে হাদির দল। চলতি বছরে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ সংগঠন হিসাবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে যে ‘ন্যাশনাল অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট ইউনিটি’ গড়ে ওঠে, সেখানেও ইনকিলাব মঞ্চের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় হাদির সক্রিয় উপস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়। ক্রমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের রায়, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ-সহ নানা বিষয়ে বক্তৃতা করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন হাদি। তাঁর বক্তৃতার ভাষা নিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকে হাদির এই নির্ভীকতার প্রশংসা করে হয়ে ওঠেন তাঁর সমর্থক। কেউ কেউ আবার তাঁর ভাষাকে অশালীন বলে সমালোচনা করতে শুরু করেন। অবশ্য সে সবে কান দেননি তরুণ নেতা। আপাত অশালীন ভাষাকে ‘মুক্তির মহাকাব্য’ আখ্যা দিয়ে নিন্দকদের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেন তিনি।
আরও পড়ুন:
ব্যক্তিগত জীবনে হাদি ছিলেন একজন শিক্ষক, স্বামী এবং এক সন্তানের পিতা। সমাজমাধ্যমেও সর্বক্ষণের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল তাঁর। গত নভেম্বরে হাদি নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে দাবি করেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি নম্বর থেকে তাঁকে ফোন ও মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকেরা সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখছে তাঁকে। এর পরেই ইনকিলাব মঞ্চের তরফে বার্তা দেওয়া হয়, জাতীয় সংসদের আসন্ন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে লড়বেন হাদি।
গত ১২ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন ও গণভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরদিন দুপুরে ঢাকার পুরনো পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে অজ্ঞাত মোটরসাইকেল আরোহীদের গুলিতে গুরুতর জখম হন হাদি। মাথায় গুলি লাগে তাঁর। ইউনূস সরকারের দাবি, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের এক কর্মী হাদিকে গুলি করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি উদ্যোগে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
হাদির মৃত্যুর পরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় বিক্ষোভ। পরিস্থিতি আঁচ করে গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ইউনূস। সেখানে তিনি ‘ধৈর্য ও সংযম’ বজায় রাখার আবেদন জানান। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, বিক্ষোভকারীরা দেশের অন্তর্বর্তী প্রধানের আবেদন কার্যত অগ্রাহ্য করেছেন। ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী— সর্বত্র অশান্তি শুরু হয়েছে। মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে ফের ভাঙচুর চালানো হয়েছে। রাজশাহীতে ভাঙচুর করা হয়েছে আওয়ামী লীগের দফতর। চট্টগ্রামে ভারতীয় উপদূতাবাস লক্ষ্য করে ঢিল-পাটকেল ছোড়়ার অভিযোগ উঠেছে। রাত থেকে উপদূতাবাসের সামনে অবস্থানে বসেছেন ছাত্র-যুবদের একাংশ। স্লোগান উঠেছে, ‘তুমি কে আমি কে, হাদি হাদি’, ‘আমরা সবাই হাদি হব, গুলির মুখে কথা কব’। শেখ হাসিনা এবং ভারত-বিরোধী স্লোগানও শোনা গিয়েছে বিক্ষোভকারীদের মুখে। শুক্রবার সন্ধ্যায় হাদির মরদেহ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে।