দিলীপ ঘোষ। —ফাইল চিত্র
সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজমাধ্যমে ভয়াবহ ঘৃণা ও বিদ্বেষের কারবারিরা রকমারি উপায়ে তাহাদের প্রচারলীলা চালাইয়া থাকে। একটি উপায় নির্ভেজাল কুকথা ‘পোস্ট’ করা এবং করিয়া চলা। যে কথা শুনিলে ভদ্রজনে কানে আঙুল দিবেন, তেমন কথা। যে কথা শুনিলে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অসুস্থ বোধ করিবেন, তেমন কথা। যাহারা ক্রমাগত এমন কদর্য কথা লিখিয়া চলে, তাহাদের নির্বোধ বা অপ্রকৃতিস্থ মনে করিবার কোনও কারণ নাই। তাহাদের একটি ছক আছে। সমাজমাধ্যমে কুকথা বলিতে বলিতে কুকথাকে ‘স্বাভাবিক’-এ পরিণত করিবার ছক। কেবল সমাজমাধ্যমে নহে, সমাজেও। বিশেষত রাজনীতির বলয়ে। কেবল গিরিরাজ সিংহদের ভারতে নহে, দুনিয়া জুড়িয়াই রাজপুরুষদের মুখে বিভিন্ন ধরনের কুকথা শুনিতে মানুষ দ্রুত, অতি দ্রুত অভ্যস্ত হইয়া উঠিতেছেন (মুখ্যত পুরুষদের মুখেই— সাধ্বী প্রজ্ঞারা মোটের উপর ব্যতিক্রমী, অন্তত এ যাবৎ)। এই বিষয়ে যদি নোবেল পুরস্কার দেওয়া হইত, তবে এত দিনে যে রাজপুরুষটি সেই পুরস্কার অনায়াসে হস্তগত করিতেন তাঁহার নাম অবশ্যই ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই পুরুষপ্রবরের অবিশ্বাস্য কদর্য-ভাষণ শুনিতে শুনিতে মানুষ অভ্যস্ত হইয়াছেন, বুঝিয়াছেন, সব কথাই বলা যায়, বলিলেই হইল। এবং ভক্তেরা তাঁহার কুবাক্যগুলি পছন্দও করিতেছেন। নেশা এই ভাবেই ধরে।
ভারতীয় জনতা পার্টির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলীপ ঘোষ যে ভাবে আগাইতেছেন, তাহাতে শ্রীমান গিরিরাজ বা শ্রীমতী প্রজ্ঞা দূরস্থান, স্বয়ং ট্রাম্পের কপালেও ভাঁজ পড়িতে পারে। জনসভায় দাঁড়াইয়া ‘বেশ করিব, (হিন্দু-মুসলমানের) মেরুকরণ করিব, ক্ষমতা থাকে আটকাও’ ঘোষণা করিয়া তিনি বঙ্গবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছেন ও স্তম্ভিত হইয়া থাকিবার অবকাশ না দিয়া পরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়িয়াছেন: সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করিলে অসমে, উত্তরপ্রদেশে, কর্নাটকে ‘আমাদের সরকার যে ভাবে শয়তানদের গুলি করিয়াছে, আমরা ক্ষমতায় আসিলে’ পশ্চিমবঙ্গেও তেমনই হইবে! এই উক্তি অ-প্রস্তুত নহে— সমালোচনার জবাবেও সভাপতি মহাশয় আপন অবস্থানে অনড় থাকিয়া টীকা দিয়াছেন: তিনি আপন বোধের প্রেরণায় যাহা বলিবার তাহা বলিয়াছেন। অবাক হইবার কিছু নাই, তিনি এবং তাঁহার সতীর্থমণ্ডলী আগেও নানা ভয়ানক কথা বলিয়াছেন, পরেও বলিবেন বলিয়াই বোধ হয়। এবং, তাঁহাদের প্রতিপক্ষের ভাষাতেও যে অশালীন অসভ্যতার প্রকাশ ঘটে না, তাহা বলিবার কোনও উপায় নাই। তাপস পাল মঞ্চের আড়ালে, কিন্তু মহামান্য অনুব্রত মণ্ডল স্বধর্মে অক্লান্ত— দিলীপ ঘোষের গুলির জবাবে তিনিও গুলি ছুড়িবার বিধান দিয়াছেন। তাঁহার নেত্রী হয়তো এই জন্য তাঁহাকে মধুর তিরস্কার করিবেন, তাহাতে বাক্সংযত হইবে বলিয়া ভরসা নাই।
ঠিক তেমনই, বিজেপির কেহ কেহ রাজ্য সভাপতির মন্তব্যের সমালোচনা করিলেও তাহাতে বিষবাষ্প প্রশমিত হইবার আশা নাই, কারণ প্রচারকেরা জানেন, করতালি (এবং ভোট) সংগ্রহ করিতে পারিলে দলনায়কেরা সভ্যতা লইয়া মাথা ঘামাইবেন না। এমন হিংস্র প্ররোচনার বিরুদ্ধে আইন আছে, দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধেও আইন মোতাবেক অভিযোগ দায়ের হইয়াছে, কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা: আইন আইনের পথে চলিবে, রাজনীতি রাজনীতির পথে। প্রশ্ন ওঠে, সমাজ এমন হিংস্র কুকথা অকাতরে মানিয়া লয় কেন? গুলি করিয়া উড়াইয়া দিবার দুর্মতি কি তবে সমাজকেও বহুলাংশে গ্রাস করিয়াছে? বিশেষত গত কয়েক বছরে যে হিংস্র বিদ্বেষের রাজনীতি দেশ জুড়িয়া আধিপত্য বিস্তার করিয়া চলিয়াছে, তাহার উপযোগী কথামৃতে বোধ করি সমাজ দ্রুত অভ্যস্ত হইতেছে। অচিরেই এমন বাণী শুনিয়া বঙ্গবাসী বলিবে, ‘সাধু, সাধু।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy