Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

হিসেবের কড়ি কোন বাঘে খায়

গ্রামের মজুরেরা অডিট করছেন পঞ্চায়েতের কাজ। কী ধরা পড়ছে তাঁদের রিপোর্টে, কী পড়ছে না, কেনই বা পড়ছে না।দি নকাল এমন পড়েছে, যে শৌচাগারেরও শিলান্যাস হয়, ঘটা করে উদ্বোধন হয় ল্যাম্পপোস্টের। মাছের জাল-হাঁড়ি, ছাত্রবৃত্তি, শিল্পী-ভাতা, মঞ্চে উঠে সামনে হেলে হাত না বাড়ালে কিচ্ছুটি মিলবে না। অথচ যে সব প্রকল্প গরিবদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ধনী, প্রভাবশালীদের, সেগুলো কখন শুরু হয়ে যাচ্ছে, কেউ টেরই পায় না।

রাস্তা। জেলা: পূর্ব মেদিনীপুর। ২০১৪। ছবি: কৌশিক মিশ্র

রাস্তা। জেলা: পূর্ব মেদিনীপুর। ২০১৪। ছবি: কৌশিক মিশ্র

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৫
Share: Save:

দি নকাল এমন পড়েছে, যে শৌচাগারেরও শিলান্যাস হয়, ঘটা করে উদ্বোধন হয় ল্যাম্পপোস্টের। মাছের জাল-হাঁড়ি, ছাত্রবৃত্তি, শিল্পী-ভাতা, মঞ্চে উঠে সামনে হেলে হাত না বাড়ালে কিচ্ছুটি মিলবে না। অথচ যে সব প্রকল্প গরিবদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ধনী, প্রভাবশালীদের, সেগুলো কখন শুরু হয়ে যাচ্ছে, কেউ টেরই পায় না।

ডিসেম্বরের দুপুরে পাথরপ্রতিমার দিগম্বরপুরের গ্রাম সভায় রিপোর্ট পড়ছিলেন রঞ্জন মাল। পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন মধুমিতা পন্ডিত, শোভনা গিরি, প্রতিমা পালেরা। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের দশ জন মজুর এ বার দিগম্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের ‘অডিট’ করেছেন। মঞ্চে বিডিও, পঞ্চায়েত প্রধান, জমিতে বসে প্রায় চারশো গ্রামবাসী, ‘সোশ্যাল অডিট’, বা সামাজিক নিরীক্ষার রিপোর্ট শুনছিলেন। কেন বার্ধক্য ভাতা এক বছরেররও বেশি বন্ধ রয়েছে সাবিত্রী দাস, ফণী নাইয়া, ব্রজেন হালদারের? প্রভাবতী হালদারের নাম ইন্দিরা আবাস যোজনার তালিকায় প্রথম ছিল। পরের লোকেরা বাড়ি পেয়ে গেল, এখনও কেন পাননি প্রভাবতী?

অভিযোগ উঠল, কাজের আবেদন জমা নেওয়ার রসিদ মজুরকে দেওয়া হচ্ছে না। ২৭৪ নম্বর মাস্টার রোলে ১০৪৪ টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে। নদীবাঁধ, ইটের রাস্তার পাশে ডিসপ্লে বোর্ড নেই। বোর্ড থাকলেও কেবল ধার্য মূল্য লেখা, ব্যয় লেখা নেই। নির্মাণ সহায়ক বোঝানোর চেষ্টা করলেন, লেখা না থাকলেও মজুরি ঠিকঠাক দেওয়া হয়েছে। শেষ অবধি প্রধান বললেন, ‘সুপারভাইজারদের বলব, নজর রাখতে।’ রঞ্জনবাবুরাই নিয়ম বুঝতে ভুল করছেন, না কি পঞ্চায়েত কর্তারা নিয়ম ভেঙেছেন, তা নিয়ে বার বার তর্কও বাধল।

শীতের বেলা পড়ে আসছে, ঠান্ডা বাড়ছে, পিছনের মস্ত অশ্বত্থ গাছের ছায়া হেলে এসে ঢেকে দিচ্ছে সভাকে। দু’এক জন করে উঠে যাচ্ছেন। তবু অধিকাংশই হাত নেড়ে মশা তাড়াতে তাড়াতে শুনলেন শেষ অবধি। তাঁদের আগ্রহটা নজর করার মতো। মলিন বিকেলে স্পষ্ট হল, কৃতজ্ঞতায় অবনত নাগরিকের যে ছবিটা মঞ্চে মঞ্চে তৈরি করেন নেতা-মন্ত্রীরা, সেটা কত ঠুনকো। সরকারি টাকায় এটা-ওটা পেয়ে নাগরিক নেতার নামে জয়ধ্বনি দিতে যাবে কেন? সে বলবে, ‘হিসেব লাও।’ নেতাকেই মাথা নিচু করে দাঁড়াতে হবে তার সামনে।

গ্রামের মানুষের হাতে সরকারের কাজের মূল্যায়নের এই দায়িত্ব যে নতুন দেওয়া হল, তা নয়। একশো দিনের কাজের আইনই আবশ্যক করেছিল সোশ্যাল অডিট। বলা হয়, প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতে কয়েকটি সংসদ বেছে নিয়ে, সেখানে বাস্তবিক কী কাজ হয়েছে খতিয়ে দেখবেন গ্রামের মজুরেরা। অডিট রিপোর্ট পেশ করবেন গ্রাম সংসদের সভায়। তবে নিয়মটা কার্যত খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে, তা পঞ্চায়েত কর্তারাও স্বীকার করেন।

কেন্দ্র গত বছর এ নিয়ে মৃদু হুঙ্কার দেওয়ায় রাজ্যে ব্যবস্থা বদলেছে। পঞ্চায়েত দফতরের অধীনে জনা পাঁচেক আধিকারিক নিয়ে ‘সোশ্যাল অডিট’ বিভাগ তৈরি হয়েছে। জেলাগুলিতে ১২৪ জন নিযুক্ত হয়েছেন গ্রামবাসীর প্রশিক্ষণ, সহায়তার জন্য। যাঁদের জব কার্ড রয়েছে, তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে ব্লক অফিস থেকে। নির্বাচিত দশ জনের দল অডিট করার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। একশো দিনের কাজের প্রকল্প, ইন্দিরা আবাস যোজনা, আর সামাজিক সুরক্ষার ভাতা, পেনশন— এই তিনটি ক্ষেত্রে অডিট করা হচ্ছে। এ বার আর নমুনা সমীক্ষা নয়, সব সংসদের সব কাজই খতিয়ে দেখার কথা। যে ক’দিন কাজ করবেন তাঁরা, সে ক’দিনের মজুরি মিলবে, একশো দিনের রেটে। সময়টা বড্ড কম, বলছেন রঞ্জনবাবুরা। ‘মাত্র দশ জনে মিলে তেরো দিনে ৫৯৬টা স্কিম দেখা কি সম্ভব?’ আক্ষেপ তাঁদের।

কিন্তু অভাবটা শুধু সময়ের নয়। সাহসের।

নিজেদের তৈরি রিপোর্টে যে সব অভিযোগ রঞ্জনবাবুরা তুললেন, দেখা গেল সে নেহাত খুচরো সমস্যা। যুদ্ধে নেমে গুলতি ছোড়ার মতো। মঞ্চ থেকে নামতেই পাকড়াও করা গেল অডিটরদের। জব কার্ড মালিকমাত্রই জানেন, কাজের আবেদন জমা নেয় না পঞ্চায়েত। কাজ শুরু হওয়ার মুখে আবেদন জমা নেয়। যাতে বেকার ভাতা দেওয়ার দাবি না ওঠে। বহু কাজ ‘হয়েছে’ বলে দেখানো হলেও, আসলে হয় না (পঞ্চায়েতের এক কর্তা বললেন, ‘এ হল মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বেড়াল আর মাংসের গল্পের মতো। গ্রামে ঢুকলে মনে হয়, এই যদি রাস্তা-পুকুর হয় তা হলে টাকা কই? আর এই যদি টাকা হয় তা হলে রাস্তা-পুকুর কই?’ অনেক গ্রাম সংসদ সভাতে গ্রামবাসীরাই এ সব অভিযোগ তুলে শোরগোল বাধান। অডিটে কিছুই ধরা পড়ল না যে?

‘কেউ তো লিখিত অভিযোগ দেয়নি।’

কিন্তু অডিট করতে লিখিত অভিযোগ কী দরকার? এমন যে হচ্ছে, তা তো নিজেই জানেন? ঘন ঘন মাথা নাড়লেন গ্রামের অডিটররা। লিখিত কমপ্লেন চাই। পাশ থেকে এক মহিলার তীব্র কণ্ঠ, ‘কে লিখে দেবে, ওরা কাজ করেনি? পর দিনই বাড়িতে চড়াও হবে না?’

চিন্তা আরও আছে। এক পঞ্চায়েত কর্তা বললেন, ‘কাজ হয়নি, এ কথা অডিট রিপোর্টে লিখলে ওই মজুরেরা টাকা পাবে ভেবেছেন?’ হক কথা। পঞ্চায়েত দফতরের অধীনেই যদি পঞ্চায়েতের কাজের অডিট হয়, তা হলে এমনই হবে। সর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকিয়ে গরিবের সঙ্গে এমন রসিকতা সরকারই করতে পারে। ইতিমধ্যেই খবর আসছে, নেতারা নিজের পছন্দের ‘অডিটর’দের তালিকা পাঠাচ্ছেন ব্লকে।

এটা প্রত্যাশিতই ছিল। যারা গোপন ব্যালটে মত জানাতে গেলে মারতে আসে, তারা কখনও প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে দেয়? সরকারি নিয়ম যে সামান্য পরিসর তৈরি করেছিল নাগরিকের সক্রিয়তার, তা দখল হতই। দেখার আছে শুধু দখলের চিত্রনাট্য। টাকা না বন্দুক, দাপটদারি না লাগানি-ভাঙানি— কী ভাবে নাগরিকদের সমর্থক বানানো হচ্ছে, সেটুকু বোঝার দরকার ছিল কেবল।

তা দেখতে গিয়ে বড় বিঁধছে ওই ‘লিখিত কমপ্লেন’-এর দাবিটা। আশি-নব্বইয়ের দশকে ভাবা হয়েছিল, গ্রামের মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবেন গ্রামের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। তাঁরা পঞ্চায়েতের চেয়ারে বসেই লাল ফিতে দেখাতে শুরু করেন— অমুকটা প্রকল্পে নেই, তমুকটার বরাদ্দ নেই, উপর থেকে নির্দেশ নেই, ইত্যাদি। গ্রামের বহু মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করে শুনতে হয়েছে, ‘এমন কোনও রিপোর্ট নেই।’ বিরোধীরাও তথৈবচ। ‘কই, আমাদের তো চিঠি দিয়ে মিটিঙে ডাকেনি’ বলে জনসভা, প্রশাসনিক বৈঠক এড়িয়েছেন, হিসেবে নজরদারির দায় ঝেড়েছেন। তাঁদের গোঁফে সর লেগে থাকতে দেখে মুখ ঘুরিয়েছেন গ্রামবাসী।

সরকারি প্রকল্পে গরিবের আস্থা ফিরে পেতে এখন গ্রামের মজুরদের নজরদারি করতে বলছে সরকার। তাঁরাও আজ লিখিত অভিযোগ চাইছেন। কাল হয়তো দাবি করবেন, বিডিও অফিস থেকে ছাপ মেরে আনতে হবে। পরশু আদালতে হলফনামা দিতে বলবেন। খেতমজুর অডিটর-এর কাছেও মনে হয়, এমন অসম্ভব শর্ত চাপানো যায় গরিবের উপর। অনেকে বলবেন, মজুরের পক্ষে যে হিসেবে নজরদারি সম্ভব নয়, তা কি সরকার জানে না? নামেই ‘সোশ্যাল অডিট’, আসলে সরকারি দুর্নীতিতে গরিবের শিলমোহর। নেতা, আমলাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে এ সব নতুন নতুন ফন্দি। ওই মঞ্চ, ওই রিপোর্ট, ওই জবাবদিহি, সব স্রেফ দেখনদারি।

কথাটা ভুল নয়। কিন্তু এ কি কেবল গরিবের ব্যর্থতা? রঞ্জন মালের চাইতে শতগুণে বেশি বিত্তবান, ক্ষমতাবান, শিক্ষাগর্বী মানুষরাই বা কী সামাজিক নিরীক্ষা করছেন? সরকারি দফতরের সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, অর্থনীতির গবেষক-অধ্যাপক, মে়ডিক্যাল কলেজের ডাক্তার, শিক্ষক সংগঠন, নানাবিধ কর্মী ইউনিয়ন, সকলেরই নজরদারি করার কথা ছিল জনসম্পদের বরাদ্দ-ব্যয়ের হিসেবে। আইন না বলুক, সমাজ সেই কথাই বলে। কই তাঁরা তো এ রাজ্যে সরকারি টাকার অপচয়ের কোনও আন্দাজ দিলেন না রাজ্যবাসীকে? রাজ্য সরকার যে চার বছরে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা বাজার থেকে ঋণ নিল, সে টাকা কোন কাজে লাগল? এখন বছরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা মিলছে কেন্দ্র থেকে। যে খাতে ব্যয় হচ্ছে, তার সবই কি হওয়ার কথা ছিল?

সমাজ যাঁদের স্বাধীন ভাবে নিরীক্ষার দক্ষতা, ক্ষমতা, অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে, তাঁরা যদি হিসেব করার সংস্কৃতি তৈরি করতেন, তবে হয়তো রঞ্জন মালেরাও সাহস করে আর দুটো কথা তুলতে পারত।

হিসেবের কড়ি কোন বাঘের পেটে গেল, বলবে কে? হিসেব যাঁরা করতে পারতেন, তাঁরাই বাঘের পিঠে সওয়ার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE