Advertisement
E-Paper

দীপের আলো তাঁদের ছোঁয় না, যাঁদের মুখ পুড়েছে অ্যাসিডে!

দীপাবলি অতিক্রান্ত। একই অন্ধকারে অ্যাসিড-আক্রান্ত মেয়েরা। উত্তরবঙ্গ নয় শুধু, একই ছবি সর্বত্র। লিখছেন পারমিতা ভট্টাচার্যকখনও প্রেমে প্রত্যাখ্যান, কখনও কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়া আবার কখনও প্রয়োজনীয় দাবি বা পণের টাকা না মেটানোর অপরাধে কিংবা পারিবারিক অশান্তির জেরে অ্যাসিড-হামলার শিকার হয়েছে এই সব মেয়েদের নিষ্পাপ শরীর-মন। 

পারমিতা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:১৬
—প্রতীকী ছবি

—প্রতীকী ছবি

অবচেতনে সন্ধে টুপ করে নেমে আসে চারদিক থেকে। এ যেন উৎসব শেষের মনকেমনের সন্ধে। বারুদ পোড়া গন্ধ শিরশিরে বাতাসের গায়ে। জবুথবু শীতের ইঙ্গিত। কোজাগরী জ্যোৎস্না তার রাজ্যপাট গুটিয়ে নিয়েছে বেশ কিছুদিন। দীপাবলির মাতৃবন্দনাও শেষ। অমার গাঢ় রঙ ধূসর আকাশে। হেমন্তের কচি হিমে নিঃশব্দে ভিজে যায় সবুজের শীর্ষভাগ। রিমোটের যুগে রয়েছি, তাই আশেপাশে তাকালেই দেখি লেজার, এলইডি আলোর চকমকি। যেন অন্ধ গুহার বুক চিরে বেরিয়ে আসা মেরুজ্যোতি। সেখানে আমাদের ছোটবেলার মাটির প্রদীপ ও মোমের আলো ম্রিয়মান। স্মৃতির মিটিমিটি চাউনি ছাড়া আর কিছুই না। আধুনিক সভ্যতায় পা রাখলেও আদতে মধ্যযুগের অন্ধকারই ঘিরে রয়েছে আমাদের।

জাকজমক পোশাক পরা উৎসবের নাটক প্রায় শেষের দিকে। কুয়াশার হালকা পরদা সরিয়ে দূর থেকে ভেসে আসে শ্যামাসঙ্গীতের সুর। আলোর বৃত্তে ভিড় করে শ্যামাপোকার মিছিল। ব্যালকনিতে জ্বালিয়ে দেওয়া রঙিন মোমগুলি সময়ের তুলনায় একটু তাড়াতাড়িই পুড়ে গেল। নিষ্প্রভ সলতের বিষণ্ণ ধোঁয়ায় দীর্ঘশ্বাসের ছোঁয়া।

আতসবাজির ঔজ্জ্বল্য অদ্ভুত এক আঁধার ভেদ করে ঢুকে পড়ে অমা-তিমিরে লুকিয়ে থাকা চির লজ্জার ঘরে। ঘরের এক কোণে বসে আঁধারের ক্যানভাসে আবছায়া ভবিষ্যতের ছবি এঁকে চলেছেন সেই সব মেয়ে, নানা তুচ্ছ অজুহাতে যাঁরা অ্যাসিড-হামলার শিকার। রঙিন মোমগুলির মতোই পুড়ে গিয়েছে তাঁদের রূপ-সৌন্দর্য। পুড়ে গিয়েছে অন্তরের স্বপ্নের নিলয়। পোড়া মুখ, ঝলসানো চেহারা,আশাহত মন নিয়ে নির্মম বাস্তবের সঙ্গে নিত্য সহবাস— এ ছবি গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র!

আরও পড়ুন: বাঘ হত্যা ভাবিয়ে তুলেছে উত্তরবঙ্গকেও

কখনও প্রেমে প্রত্যাখ্যান, কখনও কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়া আবার কখনও প্রয়োজনীয় দাবি বা পণের টাকা না মেটানোর অপরাধে কিংবা পারিবারিক অশান্তির জেরে অ্যাসিড-হামলার শিকার হয়েছে এই সব মেয়েদের নিষ্পাপ শরীর-মন।

সম্পত্তির জন্য পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মেয়ের গায়ে অ্যাসিড দেয় স্থানীয় প্রোমোটার। কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় বিবাহবিচ্ছিন্না মা ও তার শিশুর গায়ে অ্যাসিড ঢেলে দেওয়া কি অমা-অন্ধকারের কলঙ্ক নয়? শুধু কুপ্রস্তাব কেন, প্রেম প্রত্যাখ্যান করার অজুহাতেও ঘুমন্ত মা-মেয়ে অ্যাসিড-হামলার শিকার হন। আবার বাবা-মা অনেক ভরসা করে নিজের কন্যারত্নটিকে যে পুরুষের হাতে তুলে দেন, সেই রক্ষকই ভক্ষক হয়। পণের লোভে প্রতিহিংসা পরায়ণ স্বামী তার স্ত্রীর সর্বাঙ্গ পুড়িয়ে দেয় তীব্র তরল আগুনের শিখায়। ছাত্রী থেকে বৃদ্ধা— সব স্তরের মহিলারাই এই মরণখেলার সহজ শিকার। দিন দিন বেড়েই চলছে এই ঘৃণ্য খেলার তীব্রতা। ভাবলে অবাক হতে হয়, গোটা দেশে অ্যাসিড হামলায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমাদের রাজ্য!

২৭ মে, ২০১৭। শিলিগুড়ির ফুলবাড়িতে জামাইবাবুর কুপ্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় শ্যালিকা অ্যাসিড হামলার শিকার হন। ৭ মে, ২০১৮। মালদহের ইংরেজবাজার এলাকার নাবালিকা প্রেমিকাটিকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তথাকথিত ‘প্রেমিক’ তাঁর গায়ে অ্যাসিড ছুড়ে দেয়। এ বছরই অক্টোবরের ২ তারিখে কোচবিহারের গৃহবধূ শিকার হলেন অ্যাসিড হামলার। অপরাধ— স্বামীর বর্বর, অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করা। শুধুই কি উত্তরবঙ্গ? দেশজুড়েই এই বিষাক্ত ছোবলে ঘায়েল নারীসমাজ। সাজানো বাগানে বিষাক্ত কীটের উপদ্রবে অকালেই ঝরে যায় ফুল।

এই ঘটনায় আক্রান্তদের শুধু শরীর বা মুখের সৌন্দর্য‍ই পুড়ে যায় না, পুড়ে যায় মনোভাবনার জগতও। কোনও না কোনও ভাবে তাঁরা স্বাভাবিক জীবনের মূলস্রোতের গতিপথ হারিয়ে ফেলেন। মেকি ভদ্র সমাজের আবাসিক হয়েও কি আমরা তাঁদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি? উপর-উপর সহানুভূতি দেখিয়েছি মাত্র! আর অপরাধীদেরই-বা কী এমন শাস্তি হয়? সব সময় অপরাধী ধরা পড়ে, এমনও নয় এবং ধরা পড়লেও হয় অল্প কয়েকদিনের হাজতবাস, অল্প কিছু আর্থিক জরিমানা! দীর্ঘদিন মামলা চলাকালীন অভিযুক্ত জামিনে মুক্তি পেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায়!

কিন্তু অপরাধীর শিকার যে মেয়েটি, তিনি কী ভাবে থাকেন? মানসিক অবসাদে নিজেকে শামুকের খোলসে গুটিয়ে রাখেন। শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র বা সাংসারিক ক্ষেত্রে করুণার পাত্রী হয়ে থাকতে হয় তাঁকে। হীনম্মন্যতার বিষাদসাগরে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে তাঁর নীরব গল্পকথা। ভুসোকালিমাখা সমাজে আড়ম্বরের হ্যাজাকের নীচে দাঁড়িয়ে লণ্ঠনের পোড়া সলতের মতো মনে করেন নিজেকে! অনেকে আবার মৃত্যুর পথও বেছে নেন!

সমাজের কোণায় কোণায় অমা-তিথির গ্রহণ লেগেছে। রক্তবীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আনাচে কানাচে। ‘ওয়েস্টবেঙ্গল ভিকটিম কম্পেনসেশন স্কিম ২০১২’ অনুসারে সরকারের পক্ষ থেকে অ্যাসিড-হামলার শিকার মেয়েদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার কথা। তবে, সে সাহায্য কত জন পেয়েছেন বা পান, তা নিয়ে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা রয়েছে। আর এই ক্ষতি কি আদৌ অর্থের বিনিময়ে মেটানো সম্ভব? এ যে জীবন্ত লাশের পথচলা! এই ঘটনাকে বিসর্জন বলা যায় কি? বিসর্জন না বলে বলা ভাল— ভগ্ন, জরাজীর্ণ অন্ধকার মন্দিরে আটকে রাখা দেবী প্রতিমা! যাঁর সৌন্দর্য কালের ওলোট-পালটে ঝরে পড়ে! নীরবে ঝড়ে পড়ে!

প্রতিহিংসার লেলিহান শিখায় পুড়ে খাক হয়ে যান মেয়েরা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁদের মুখ। কিন্তু কেন মেয়েরাই এই ঘৃণ্য অপরাধের শিকার? সমাজ মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রতীক বলে মনে করে, সেই কারণে?

তবে, ব্যতিক্রমও আছে। অনেক সময় অ্যাসিডে বাহ্যিক রূপ পুড়ে গেলেও অনেকের অন্তরের ইচ্ছাশক্তি অমলিন থাকে। সমাজের নিন্দক দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁরা এগিয়ে চলেন। অবশ্য সেই সংখ্যাটা খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের বোবাকান্নায় ভিজে যায় হেমন্তের বিষণ্ণ দীপান্বিতা। তাঁরা যেন আলোর উৎসবে অন্ধকার জ্যোৎস্নার আঁতুরঘরে জীবন্ত মহেঞ্জাদারো!

(লেখক ইসলামপুরের মণিভিটা হাইস্কুলের শিক্ষক। মতামত নিজস্ব)

Acid Attack Diwali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy