Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

কলেরার চিকিৎসা আবিষ্কারে ভূমিকা বাংলার ডাক্তারদেরও

‘ওআরটি’-র পিছনে জড়িয়ে আছে বাংলার দুই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর নাম। তাঁরা হলেন হেমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং দিলীপ মহলানবিশ। ঘটনাচক্রে তাঁদের জীবনপঞ্জিতে এই নভেম্বর মাসের আছে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। লিখছেন অরুণাভ সেনগুপ্ত ‘ওআরটি’-র পিছনে জড়িয়ে আছে বাংলার দুই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর নাম। তাঁরা হলেন হেমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং দিলীপ মহলানবিশ। ঘটনাচক্রে তাঁদের জীবনপঞ্জিতে এই নভেম্বর মাসের আছে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। লিখছেন অরুণাভ সেনগুপ্ত

চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ। ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশ। ছবি: সংগৃহীত

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৩৩
Share: Save:

বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকে প্রতিষ্ঠা পেল একটি সরল সহজ চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কার যা ন্যূনতম ব্যয়ে ব্যবহারযোগ্য। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই আবিষ্কার প্রতিহত করতে পারল কলেরা বা উদরাময় রোগে মৃত্যুর অবিরাম ধারাকে। ‘ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট’ বা ‘ওআরএস’ ব্যবহারের সেই পদ্ধতির নাম ‘ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি’ বা ‘ওআরটি’। ‘ওআরএস’ হল গ্লুকোজ বা চিনি এবং লবণের সঙ্গে জলের যথাযথ অনুপাতের মিশ্রণ।

‘ওআরটি’-র সফল ব্যবহারের এই আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার দুই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর নাম। তাঁরা হলেন হেমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং দিলীপ মহলানবিশ। ঘটনাচক্রে তাঁদের জীবনপঞ্জিতে এই নভেম্বর মাসের আছে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। প্রথম জনের ‘ওআরটি’-র উপরে গবেষণাপত্র গৃহীত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল অভিজাত চিকিৎসা-জার্নাল ‘ল্যান্সেট’-এ ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাসে। আর দ্বিতীয় জনের জন্মদিন ১৯৩৪ সালের ১২ নভেম্বর।

উদরাময় বা কলেরায় মৃত্যুর প্রধান কারণ জলশূন্যতা। কলেরা আক্রান্তের শরীর থেকে প্রতিদিন কুড়ি লিটার পর্যন্ত জল বেরিয়ে যেতে পারে, পরিণতি মৃত্যু। ‘ওআরএস’ এই জলশূন্যতার অমোঘ প্রতিকার।

‘ওআরটি’ আবিষ্কারের আগে কলেরা বা উদরাময় রোগ ছিল প্রাণহানির এক ভয়াল কারণ, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। ওই রোগে পাঁচ বছরের কমবয়সী শিশুদের মৃত্যুহার ছিল প্রতি বছর অন্তত পঞ্চাশ লক্ষ। ‘ওআরটি’ ব্যবহারের অব্যবহিত পরে তা নেমে আসে বছরে তেরো লক্ষে।

‘ওআরএস’-এর কর্মকৌশলের শারীরবৃত্তীয় তত্ত্ব ১৯৫৩ সাল থেকে শুরু করে আট-দশ বছরের মধ্যেই আবিষ্কৃত হয়। গবেষণাগারে পশুর অন্ত্র ব্যবহার করে আবিষ্কৃত হয়েছিল ক্ষুদ্রান্ত্রের কোষে খাদ্যনালি থেকে শোষণ করার জন্য সোডিয়াম-গ্লুকোজ় সহ-পরিবহণ তত্ত্ব। অর্থাৎ, খাবার পরে ক্ষুদ্রান্ত্রের কোষ যখন গ্লুকোজ শোষণ বা গ্রহণ করে, তখন সেই গ্লুকোজ সঙ্গে নিয়ে নেয় সোডিয়ামকেও। সঙ্গে আস্রবণ বা ‘অসমোসিস’-এর নিয়মে শোষিত হয় জলও। কাজেই লবণমিশ্রিত পানীয় জল এমনিতে শোষণ না হলেও সঙ্গে গ্লুকোজ মিশিয়ে খাইয়ে দিলে অন্ত্র তা শরীরে গ্রহণ করে নেয়। কলেরা বা উদরাময় রোগেও অন্ত্রের এই শোষণক্ষমতা অটুট থাকে। কিন্তু কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য হল এই যে, ‘ওআরএস’-এর ব্যবহার বাস্তবে সফল প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এই শারীরবৃত্তীয় আবিষ্কারের সঙ্গে সম্পর্করহিত ভাবে।

‘ওআরএস’-এর উদ্ভাবনা বা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে যে সেটি সম্পর্কযুক্ত ভাবে হয়নি, বরং হয়েছে ছাড়া ছাড়া ভাবে এবং খানিকটা কাকতালীয় ভাবেও।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল নাগাদই আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জনক শুশ্রূত লিখিত ‘চরকসংহিতা’য় উদরাময় রোগের চিকিৎসায় খনিজ লবণ ও গুড় মিশিয়ে প্রচুর জল খাওয়ানোর বিধান রয়েছে। উদরাময়ের কথা রয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর গ্রিক নথি ‘হিপোক্রিটিক’ সংগ্রহেও। কিন্তু আক্ষেপের কথা, যে উদরাময়ের চিকিৎসার সঠিক পথ বুঝতে কয়েক হাজার শতাব্দী পার হয়ে গেল!

১৮৩২ সালে চিকিৎসক থমাস লাটা কলেরার চিকিৎসায় ‘ইন্ট্রাভেনাস (আইভি) স্যালাইন’ ব্যবহার করে ফল পেয়েছিলেন। কিন্তু এই কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাননি। ‘আইভি স্যালাইন’-এর প্রয়োগ সার্থক ভাবে শুরু হয় ১৯৫০ এর পর থেকে। কিন্তু ‘আইভি স্যালাইন’-এর প্রয়োগ ব্যয়সাপেক্ষ, ব্যথাদায়ী এবং স্বাস্থ্যকর্মীনির্ভর। এক সঙ্গে অনেক রোগীর উপস্থিতিতে (মহামারিতে যা স্বাভাবিক) তার প্রয়োগও অসুবিধাজনক। অতএব সন্ধান চলছিল পরিবর্ত চিকিৎসা পদ্ধতির।

এই প্রয়াসেই পথ দেখিয়েছিলেন কলকাতার বাঙালি চিকিৎসক হেমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। তিনি ১৮৬ জন রোগীকে ‘আইভি স্যালাইন’ না দিয়ে গ্লুকোজ় ও লবণজল খাইয়ে চিকিৎসা করেছিলেন। সাফল্যের খতিয়ান-সহ তাঁর গবেষণাপত্র গৃহীত হয়ে প্রকাশিত হল চিকিৎসা জার্নাল ‘ল্যান্সেট’-এ। কিন্তু শ্বেতাঙ্গপ্রধান বিজ্ঞানীমহল বর্ণবৈষম্যমুক্ত দৃষ্টি নিয়ে এই আবিষ্কারকে দেখতে পারেননি। জলশূন্যতার এত সহজ সমাধান, তা-ও আবার ভারতবর্ষের চিকিৎসকের কাছ থেকে, তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। বঞ্চনার কারণ দেখানো হল অনেক কিছুই—ঠিকমতো ‘কন্ট্রোল’ না দেখানো, বমি ইত্যাদি রোধ করার জন্য ভারতীয় ভেষজের ব্যবহার ইত্যাদি।

১৯৬২ সালে চিকিৎসক-বিজ্ঞানী রবার্ট এ ফিলিপস ফিলিপিন্সের দুই কলেরা রোগীকে লবণজলের সঙ্গে ঘটনাচক্রে গ্লুকোজ় মিশিয়ে খেতে দিলেন। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন যে এতে শরীরে লবণের শোষণ বেড়ে গিয়েছে। নিতান্তই কাকতালীয় আবিষ্কার! এর পর তিনি বৃহৎ ভাবে এই পরীক্ষাটি করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। কারণ, তিনি পরের বার গ্লুকোজ়ের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৬৭ সালে একই সময়ে দুই জায়গায় ‘ওআরএস’ নিয়ে পরীক্ষা করলেন চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা। ঢাকায় করলেন নরবার্ট হিরচর্ন। কলকাতায় করলেন নাথানিয়েল এফ পিয়ার্স। কিন্তু তাঁরা ‘ওআরএস’ দ্রবণ খাদ্যনালিতে নল ঢুকিয়ে পাঠিয়েছিলেন এবং ‘আই়ভি স্যালাইন’ ব্যবহার না করার সাহস দেখাতে পারেননি বললেই হয়। তরুণ চিকিৎসক ডেভিড নালিন এবং রিচার্ড ক্যাশ-এর হাত ধরে ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে ঢাকার কলেরা রিসার্চ হসপিটালে রোগী নিয়ে চিকিৎসা-গবেষণায় সত্যিকারের সাফল্য এল। তাঁরা শুধু ‘ওআরএস’ দ্রবণ খাইয়ে সাফল্য পেলেন।

এর পর আসবে চিকিৎসক দিলীপ মহলানবিশের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা। তিনি ১৯৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। বিদেশ থেকে শিশুচিকিৎসার বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। যোগ দেন ‘জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটি’র ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারের কলকাতা কেন্দ্রে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি সংস্থার হয়ে উদ্বাস্তুদের বনগাঁ শিবিরে ‘ওআরটি’ নিয়ে চিকিৎসা-সেবা ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন। প্রায় চার হাজার রোগীকে ‘ওআরটি’ ব্যবহার করে সুস্থ করে তুললেন তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা। দিলীপবাবু এবং তাঁর দল প্রমাণ করল, বড় রকমের জরুরি প্রয়োগক্ষেত্রেও ‘ওআরটি’ সফল ভাবে ব্যবহার করা যায়। স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যার অপ্রতুলতার ক্ষেত্রে রোগীর আত্মীয়-পরিজনদের কাজে লাগিয়ে ‘ওআরএস’-এর ব্যবহার যে কত সহজ তা-ও তাঁরা প্রমাণ করতে পারলেন।

এক প্রাণদায়ী পদ্ধতি হিসেবে ‘ওআরটি’ গৃহীত হল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে। ইউনিসেফ ১৯৮৭ সালে ঘোষণা করল, ‘বিংশ শতাব্দীতে আর কোনও আবিষ্কার এত কম সময়ে এত প্রাণ রক্ষা করতে পারেনি’।

লেখক আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cholera Doctor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE