Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দুর্লক্ষণ

নির্বাচন কমিশন নিজেকে সেই ঊর্ধ্বে রাখিতে পারে নাই। অভিযোগের পর অভিযোগে কলঙ্কিত হইয়াছে। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার রেফারির পক্ষে যাহা সর্বাধিক মর্যাদাহানিকর।

ছবি: সংগৃহীত।

ছবি: সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সাত দফার নির্বাচন শেষে দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানাইয়াছেন। দেশবাসী নিশ্চয়ই কমিশনকে প্রত্যভিবাদন জানাইবেন— সবার উপরে সৌজন্য সত্য। কিন্তু দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রে এই যাবৎ সর্বকালের বৃহত্তম নির্বাচন সমাপন করিয়া যে অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায় ও সম্মানে নির্বাচন কমিশনের বন্দিত হইবার কথা ছিল, দুর্ভাগ্যের কথা, সেই অর্ঘ্য তাহাদের অধরাই থাকিয়া গেল। কমিশনের দায়িত্ব ছিল কঠোর অভিভাবকের, নিরপেক্ষ পরিচালকের। দল বা নেতার পরিচয় না দেখিয়া, কোনও ধরনের প্রভাব-প্রতিপত্তির তোয়াক্কা না করিয়া নির্বাচনী বিধি বাস্তবে প্রয়োগ করিবার দায়িত্ব। সেই কর্তব্য সম্পন্ন করিতে পারিলে আজ দলমতনির্বিশেষে দেশবাসী কমিশনকে সর্বান্তঃকরণে ধন্যবাদ জানাইতেন। আনুষ্ঠানিক নহে, আন্তরিক ধন্যবাদ। কোনও দল বা জোটের নির্বাচনী সাফল্য অপেক্ষা সেই সম্মানের মহিমা বহুগুণ অধিক, কারণ তাহা গণতন্ত্রের মহিমা। তাহার স্থান দলমতের ঊর্ধ্বে।

নির্বাচন কমিশন নিজেকে সেই ঊর্ধ্বে রাখিতে পারে নাই। অভিযোগের পর অভিযোগে কলঙ্কিত হইয়াছে। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ, বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার রেফারির পক্ষে যাহা সর্বাধিক মর্যাদাহানিকর। শাসক দল ও দলনেতারা প্রচারের স্বাভাবিক লক্ষ্মণরেখা ক্রমাগত লঙ্ঘন করিয়াছেন, কমিশন— অভিযোগ সত্ত্বেও— তাঁহাদের সেই অনাচারের প্রতি উদাসীন থাকিয়াছেন। শাসক দলের সর্বাধিনায়ক তথা দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বারংবার নির্বাচনী বিধি ভাঙিবার অভিযোগ উঠিয়াছে, বিশেষত সেনাবাহিনীর নামে ভোট চাহিবার অভিযোগ, ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস যাহা কার্যত অভূতপূর্ব। কমিশন তিরস্কার অবধি করে নাই। এমনকি কমিশনের অন্যতম সদস্য এই বিষয়ে একাধিক বার ভিন্নমত জানাইলে সেই মত নথিভুক্তও করা হয় নাই! এই অভিযোগের উত্তরে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার যে সকল ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা সাধারণ বুদ্ধির ধোপে টেকা কঠিন। অভিযোগের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা এবং সদুত্তরের ঘোর অনটন, দুইয়ে মিলিয়া কমিশনের ভাবমূর্তি কোথায় পৌঁছাইয়াছে, লোকচক্ষুর অন্তরালে না সরিয়া যাইলে তিরুনেল্লার নারায়ণ আয়ার শেষন তাহা বলিতে পারিতেন।

ডিসেম্বর ১৯৯০ হইতে ছয় বৎসর মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে অধিষ্ঠিত টি এন শেষন এই প্রতিষ্ঠান তথা ভারতের নির্বাচন পরিচালন ব্যবস্থাকে কোথা হইতে কোথায় পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন, তাহা সর্বজনবিদিত। অথচ তাহার জন্য সংবিধান সংশোধন বা আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় নাই। বস্তুত, তাঁহার কার্যকালের মধ্যপথে, তাঁহাকেই ‘নিয়ন্ত্রণ’ করিবার তাগিদে আইন বদলাইয়া নির্বাচন কমিশনের সদস্যসংখ্যা একের পরিবর্তে তিন হয়। শেষনকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহাও অস্বীকার করা কঠিন— তাঁহার অতিরিক্ত দাপট লইয়া নানা আপত্তির কারণ ছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তিনি শিথিল নির্বাচন বিধিকে কঠোর করিয়া, সেই বিধি প্রার্থীদের উপর কঠোর ভাবে প্রয়োগ করিয়া এবং নির্বাচনী ব্যয়ের উপর নজরদারি বাড়াইয়া রাজনৈতিক দল ও নেতাদের যথেচ্ছাচার দ্রুত অনেকখানি কমাইতে পারিয়াছিলেন। ভারতীয় রাজনীতিতে এক অত্যন্ত অস্থির সময়ে দেশে, বিশেষত উত্তর ভারতে নির্বাচনী অশান্তির মাত্রা লক্ষণীয় ভাবে কমিয়াছিল। অর্থাৎ অস্ত্র পূর্বাবধি প্রস্তুত ছিল, কিন্তু শেষন তাহার সদ্ব্যবহার করেন ও সুফল পান। গত দুই দশকে নির্বাচন কমিশনের কাজে, নানা অভিযোগ সত্ত্বেও, সুপরিবর্তন সক্রিয় থাকিয়াছে। ইহাকেই বলা হয় ‘ভার্চুয়াস সাইক্‌ল’ বা সুস্থচক্র। গণতন্ত্রের পক্ষে গভীর উদ্বেগের কথা, এই বার তাহা হইতে বিচ্যুতির দুর্লক্ষণ প্রকট হইল। ইহা দুষ্টচক্রের অশুভ আরম্ভ কি না, তাহা ভবিষ্যৎই বলিবে। এই উদ্বেগের দায় নির্বাচন কমিশনের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 Election Commission of India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE