Advertisement
E-Paper

সাত্তোরের বধূ কেন এত বিপজ্জনক

এ রাজ্যে নির্যাতিত মেয়েদেরই ঘর ছাড়তে হয়। নইলে বাঁচতে হয় পাহারায়। বিপন্নরাই কী করে এত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে?আমাদের নেতারা আর কিছু পারুন আর না-ই পারুন, তাক লাগাতে পারেন। তাঁদের কথা শুনে বিষম খেয়ে, দাঁতকপাটি লেগে-টেগে এক এক বার মনে হয়, আর বুঝি কোনও কিছুতেই অবাক হওয়ার নেই। তখনই ফের নতুন একটা কথায় হতভম্ব, বাক্যিহারা হতে হয়। এ-ও সম্ভব? এ-ও শুনতে হল কানে?

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
খুবই বিপজ্জনক! সিউড়ির আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাত্তোরের নির্যাতিতাকে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

খুবই বিপজ্জনক! সিউড়ির আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাত্তোরের নির্যাতিতাকে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

আমাদের নেতারা আর কিছু পারুন আর না-ই পারুন, তাক লাগাতে পারেন। তাঁদের কথা শুনে বিষম খেয়ে, দাঁতকপাটি লেগে-টেগে এক এক বার মনে হয়, আর বুঝি কোনও কিছুতেই অবাক হওয়ার নেই। তখনই ফের নতুন একটা কথায় হতভম্ব, বাক্যিহারা হতে হয়। এ-ও সম্ভব? এ-ও শুনতে হল কানে?

সাত্তোরের নির্যাতিতা নাকি ‘ডেঞ্জারাস’ মহিলা। ‘ডেঞ্জার’ মানে বিপদ। যে বিপদে সে মেয়েটি পড়েছিল বলে জানিয়েছে, তেমন কমই হয়। পুলিশ নাকি তাকে বাপের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সারারাত নির্যাতন চালিয়েছে। শরীরে বিছুটি ঘষে দিয়েছে। সেই রাত, আর তার পরের দিনগুলো মেয়েটির উপর কতখানি বিপদ গিয়েছে, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। কিন্তু সরকারি উকিল আদালতে সাত্তোরের বধূকে খাগড়াগড়ের বোমা-বাঁধা মহিলাদের সঙ্গে তুলনা করলেন। পার্ক স্ট্রিটের সু জেট মিথ্যেবাদী, কামদুনির মৌসুমী-টুম্পা ‘মাওবাদী’ শুনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল, সাত্তোরের নির্যাতিতাকে ‘ডেঞ্জারাস’ বলায় তাতে যেন নুনের ছিটে পড়ল। যে বিপদগ্রস্ত, সে-ই বিপজ্জনক?

বিপদের ভয় যে একটা আছে, তা টের পাওয়া যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ধর্ষিতা আর তার পরিবারকে যেন প্রায় নিয়ম করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়িঘর, পাড়ামহল্লা থেকে। কামদুনির গণধর্ষিত হয়ে খুন হওয়া কলেজছাত্রীর পরিবার কামদুনি গ্রাম থেকে চলে গিয়েছে। মধ্যমগ্রামে বাসরত বিহারের সমস্তিপুরের যে কিশোরী দু’বার গণধর্ষিত হয়, তার পরিবার বাধ্য হয়েছিল এয়ারপোর্টের কাছে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে। সেখানেও অবশ্য রক্ষা পায়নি সে, অভিযুক্তরা তাকে সেই বাড়িতে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে বলে অভিযোগ। তার বাবা-মা রাজ্য ছেড়েই চলে গিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁরা বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ তাঁদের রাজ্য ছাড়তে চাপ দিচ্ছে।

নজরের আ়ড়ালে চলে গিয়েছে আরও কত ঘটনা। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের এক স্কুলছাত্রী বছর তিনেক আগে স্কুল থেকে ফেরার পথে গণধর্ষিত হয়েছিল, তার পর থেকে সে আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। পড়াশোনা করছে শিলিগুড়িতে থেকে। বনগাঁর এক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে টেস্ট পেপার কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাবরায় ধর্ষণ করেন এক ব্যক্তি। মেয়েটিকে কৃষ্ণনগরে থেকে কলেজের পড়াশোনা শেষ করতে হয়।

১ জুলাই বনগাঁ শহরের এক দম্পতিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় থানায়। তাঁদের সম্পর্ক অবৈধ, এই সন্দেহে মারধর করে। বনগাঁ আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন মহিলা। তার পর থেকেই তিনি বাড়িছাড়া। মাসখানেক আগে মধ্যমগ্রামে ছেলের গলায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গণধর্ষণ করা হয় এক মহিলাকে। মামলা তোলার চাপ সামলাতে না পেরে এখন তিনি বাপের বাড়ি। গত বছর চিৎপুরের রেলওয়ে ইয়ার্ডে যে অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গণধর্ষণ হয়েছিল, তিনিও হুমকি (এখন তাতে আত্মীয়রাও যোগ দিয়েছেন) সইতে না পেরে বাপের বাড়িতে। বীরভূমের পদুমা গ্রামের আদিবাসী বধূ দু’জনের নাম বলে দিয়েছেন যাঁরা ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। গত চার মাস বধূর ঠিকানা সরকারি হোম।

অনেকে ফিরেছে অতি কষ্টে, অনেক পরে। গত সেপ্টেম্বরে হলদিবাড়ির এক কলেজছাত্রীকে চাকরি দেওয়ার নাম করে ধর্ষণ করেছিল স্থানীয় তৃণমূল নেতা। দু’ মাস বাড়ি ফিরতে পারেনি মেয়েটি। সালিশি সভা থেকে পালানো ধূপগুড়ির যে ছাত্রীর বিবস্ত্র দেহ মিলেছিল রেল লাইনের ধারে, তার বাবা-মাকে প্রায় তিন মাস অন্য গ্রামে থাকতে হয়েছে। এমন দৃষ্টান্ত অগুন্তি। বোধহয় পশ্চিমবঙ্গে এমন জেলা নেই, এমন ব্লক নেই, যেখানে নির্যাতিত হওয়ার ‘অপরাধে’ ঘর ছাড়তে হয়নি কোনও না কোনও মেয়েকে। এরাও রাজনৈতিক রিফিউজি। রেপ নিয়ে রাজনীতিই ঘর ছাড়তে বাধ্য করেছে তাদের।

এত আড়াল কেন

এই রাজনীতি অনেকটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের হাতে তৈরি। মূক ও বধির তরুণী দীপালি বসাককে তিনিই রাজনীতির কেন্দ্রে এনেছিলেন। গর্ভবতী মেয়েটিকে নিয়ে মহাকরণে ঢুকে জ্যোতি বসুর কাছে তাঁর পুলিশের পক্ষপাতিত্ব নিয়ে নালিশ করতে গিয়েছিলেন মমতা। দু’জনকেই পুলিশ বার করে দিয়েছিল। তার প্রতিবাদে সেই ১৯৯৩ সালে অবরোধে গোটা কলকাতা অচল হয়েছিল। ফুলিয়ার দীপালি বসাক থেকে সিঙ্গুরের তাপসী মালিক— ধর্ষণকে ব্যবহার করে শাসক বামফ্রন্টকে বিব্রত করার কোনও সুযোগ মমতা ছাড়েননি। আজ তিনি বিরোধীদের সেই জমি ছাড়তে চাইবেন না, এ তো স্বাভাবিক। তাই ধর্ষণের খবর ফাঁস হলে স্থানীয় কোনও নেতা কার্যত মেয়েটি ও তার পরিবারকে ‘হেফাজত’-এ নিয়ে নেন। মিডিয়া, মানবাধিকার কর্মীদের ‘হয়রানি’ থেকে আড়াল করেন। পরিবারের কোনও কর্তা এসে জানিয়ে যান, পুলিশের উপর তাঁদের সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে।

এখানে আর একটা উলটপুরাণ কাজ করে: যারা বিপন্নের পাশে দাঁড়াতে যায়, তারাই নাকি ‘বিপদ।’ নারী আন্দোলনের কর্মী শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত বলেন, ‘স্থানীয় মহিলা সংগঠনের সদস্যরা নির্যাতিত মেয়েদের কাছে, বা তাদের মা, দিদি, বউদির কাছে পৌঁছতে পারে না। আটকে দেয় এলাকার কিছু মুরুব্বি। কর্তাগোছের পুরুষ ‌আত্মীয়রাও বাধা দেন। যার সাহায্যের দরকার ছিল, তার কাছেই পৌঁছনো যায় না।’ গ্রামের মানুষ, স্কুলকলেজের বন্ধুরা কথা বলতে চাইলে আড়াল খোঁজেন। বার বার বলেন, ‘আপনারা তো চলে যাবেন, আমাদের কী হবে?’

সাত্তোরের বধূ বাড়ি ছাড়েনি, কারও গার্জেনিও মানেনি। তাই কি তাকে জেলে পাঠিয়ে মিডিয়া আর বিরোধী থেকে আড়াল করার চেষ্টা? কিন্তু সর্বত্রই তো শেষ অবধি ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছে তৃণমূল। কামদুনিতে নির্বাচন জিতেছে। সুটিয়াতে বরুণ বিশ্বাসের স্মরণসভায় লোক হয় না। ধূপগুড়ি থেকে বীরভূম, এক ছটাকও জমি খোয়া যায়নি। তা হলে এত মরিয়া চেষ্টা কেন?

বিপদটা হয়তো অন্য জায়গায়। কার ক্ষমতা কত বেশি, এই হল রাজনীতির লড়াই। নেতাদের যুক্তি বলে, যে যত ক্ষতি করে দিতে পারে, তার তত ক্ষমতা। পুলিশ দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া, মামলা দিয়ে জেলে ভরার ক্ষমতা সরকারের আছে। তাই সরকার শক্তিমান। জনতার যুক্তি বলে, যে যত ক্ষতি সহ্য করতে পারে, তার তত ক্ষমতা। প্রবল আঘাতের পরেও ঘরগেরস্তালি, স্কুলকলেজ, কোর্টকাছারি ছেড়ে যে পালায়নি, সে ধনহীন, বিদ্যাহীন, সহায়হীন হয়েও সম্ভ্রম আকর্ষণ করে। তাকে ঘিরে একটা স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন তৈরি হয়। ‘এর সঙ্গে যা হচ্ছে তা ঠিক নয়,’ এই বোধটা নিরীহ মানুষকেও উত্তেজিত করে তোলে। এক অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার ইচ্ছেটা অনেক অন্যায়ের প্রতিকার না-পাওয়ার ক্রোধ দিয়ে চালিত হয়। সেই আবেগ কোন দিকে আছড়ে পড়বে, বোঝার আগাম উপায় নেই।

এই অনিশ্চয়তার জন্যই জনতার সামনে অপরাধীদের হাত-পা কেটে, পুড়িয়ে, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরে ফেলার রেওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মধ্যযুগে বিচার হত মানুষের নজরের আড়ালে, শাস্তি সর্বসমক্ষে। অপরাধীর দেহ ছিন্নভিন্ন করে রাজা তার ক্ষমতা বোঝাত। কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে মনে করলে দর্শকরা অনেক সময়ে জল্লাদকেই আক্রমণ করে বসত, ছিনিয়ে নিত অপরাধীকে। ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে ক্ষমতার সীমা স্পষ্ট হয়ে যেত। আজ তাই বিচারটা হয় জনসমক্ষে, ফাঁসি হয় চুপিসাড়ে। ১

এ রাজ্যে চুপিসাড়ে নির্যাতিত মেয়েদের সরিয়ে ফেলার এত চেষ্টা, সেই কারণেই। মেয়েদের ক্ষতি করার ক্ষমতা এই সমাজের ক্ষমতাবিন্যাসের কেন্দ্রে। নেতা-মন্ত্রী-পুলিশ সে ক্ষমতা যদি প্রকাশ্যে দেখাতে না পারে (তাপস পালের ‘ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব’ স্মরণ করুন), তা হলে দাপট দেখানো হবে কী করে? কিন্তু মেয়েটি যখন ক্ষতি সহ্য করেও উঠে দাঁড়ায়, যখন তামাশা-দেখা ‘পাবলিক’ হঠাৎ উত্তেজিত জনতা হয়ে ওঠে, তখন জামিন-অযোগ্য ধারা, ক্ষতিপূরণের টাকা, চাকরির টোপ দিয়েও এঁটে ওঠা না গেলে হঠাৎ টের পাওয়া যায়, ক্ষমতার সীমা আছে।

এমন ভয়ানক কথা যে মনে করিয়ে দেয়, তার চাইতে ‘ডেঞ্জারাস’ আর কে আছে।

১: মিশেল ফুকো, ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ।

swati bhattacharya abp post editorial dangerous wife endangered wife raped wife tortured wife priyanka dubey west bengal ladies
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy