উত্তরবঙ্গের নাম শুনলে আজও চোখে ভাসে এক সবুজ মায়া। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালেই লুকিয়ে আছে এক গভীর ক্ষত, আর্থ-বাস্তুতান্ত্রিক সঙ্কট। জলবায়ুর ভঙ্গুরতা, অপরিণামদর্শী উন্নয়ন আর স্বশাসনের অভাব— তিনের ককটেল উত্তরবঙ্গকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনিবার্য বিপর্যয়ের দিকে।
উত্তরবঙ্গের ইতিহাসটাই যেন একটা ভাঙাগড়ার খেলা। ব্রিটিশদের হাতে এর প্রশাসনিক সীমানা ছিল স্থিতিস্থাপক। কিন্তু এই প্রশাসনিক অস্থিরতার মূল লক্ষ্য ছিল একটাই— সম্পদ আহরণ। ১৮৬৫ সালে দার্জিলিং ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮৬৫ সালে সিঞ্চুলা চুক্তির মাধ্যমে ডুয়ার্স ব্রিটিশ ভারতে ঢুকল, ১৮৬৬ সালে কালিম্পং এল ভুটান থেকে। এই ঔপনিবেশিক পদক্ষেপগুলোই সীমান্ত সংঘাত আর প্রশাসনিক দুর্বলতার ভিত্তি তৈরি করেছিল।
১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলার সূচনা, ওই সালেই নির্মিত হয় শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত হিলকার্ট রোড, ১৮৮১ সালে দার্জিলিং হিমালয়ান রেল (ডিএইচআর) চালু হওয়া— এগুলো ছিল উন্নয়নের মাইলফলক, কিন্তু একই সঙ্গে প্রকৃতির উপর হিংসার শুরু। বিশেষত দার্জিলিং ও ডুয়ার্সে ব্রিটিশরা চালু করল ‘অ-নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা’। এর সবচেয়ে মারাত্মক প্রভাব পড়ল ভূমি আইনের ক্ষেত্রে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির সাধারণ আইন (যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত) এখানে কার্যকর ছিল না। এই আইনি শূন্যতা কাজে লাগিয়ে প্লান্টাররা ‘ওয়েস্টল্যান্ড রুলস’ ব্যবহার করে জনজাতি গোষ্ঠীর জমির অধিকার অগ্রাহ্য করল, নির্বিচারে জঙ্গল সাফ করে চা বাগান তৈরি করল। প্রাক্-উপনিবেশ দার্জিলিং ছিল ঘন অরণ্যে পরিপূর্ণ।
নেপাল, ছোটনাগপুর, ওড়িশার আমদানি করা শ্রমিকদের শোষণের মাধ্যমে শুরু হল ‘প্লান্টেশন ক্যাপিটালিজ়ম’। তাঁরা ছিলেন অবাধ মজুরি-শ্রম ব্যবস্থার অধীনে, কার্যত দাস শ্রমিকের মতোই। ব্রিটিশদের লক্ষ্য ছিল চা আর কাঠ রফতানি, উৎপাদন ভিত্তিক শিল্পায়ন নয়। উনিশ শতকে ম্যালেরিয়া-কালাজ্বর প্রবণ তরাই অঞ্চলকে গণ্য করা হত অস্বাস্থ্যকর স্থান হিসাবে। ফলে বহু মানুষ শারীরিক শাস্তি বা বদলি হিসাবে সেখানে যেতে বাধ্য হতেন। এই ঐতিহাসিক বঞ্চনা, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট আর আইনগত কাঠামোর দুর্বলতা— এগুলোই উত্তরবঙ্গের আজকের ভূমিহীনতা এবং পরিবেশগত ভঙ্গুরতার প্রধান কারণ।
উত্তরবঙ্গ, বিশেষত পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশ, এক জৈব বৈচিত্রের হটস্পট। এখানে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি জাতীয় উদ্যান, একাধিক বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, বাঘ ও হাতি সংরক্ষণ কেন্দ্র আছে। তফসিলি জাতি ও জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি আজও এই অরণ্য ও ভূমির সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিক সুরক্ষা আজ আর বাস্তুতান্ত্রিক নিরাপত্তা দিতে পারছে না। মানব-বন্যপ্রাণী সংঘাত এখন নিত্যদিনের ঘটনা। খাদ্যাভাবে বন্যপ্রাণীরা জঙ্গল ছেড়ে চা-বাগান, লোকালয়, এমনকি শিলিগুড়ির মতো শহরে ঢুকছে। এর মূল কারণ, ব্রিটিশ আমলের প্রথা মেনে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণার মাধ্যমে জনজাতি গোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী কার্যকলাপকে ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করা। জনজাতি গোষ্ঠীর লোকজন যখন তাঁদের জমির অধিকার হারান, তখন তাঁরা আর পরিবেশ সংরক্ষণে উৎসাহী হন না। উপরন্তু, সংরক্ষিত এলাকার ‘বাফার জ়োন’ এবং হাতি করিডরে অবৈধ নির্মাণ ও পর্যটন শিল্পের অনুপ্রবেশ এই সংঘাতকে আরও তীব্র করেছে।
উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চল হল পূর্ব হিমালয়ের ভঙ্গুর ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর অংশ। এই তরুণ পর্বতমালা চ্যুতি ও ফাটলযুক্ত নরম শিলা দিয়ে তৈরি। ফলে সামান্য জল সম্পৃক্ত হলেই ভূমিধসের সম্ভাবনা বাড়ে। উচ্চ সিসমিক কার্যকলাপের কারণে সংবেদনশীল এই অঞ্চলে এখন বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুব বেশি।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। মেঘভাঙা বৃষ্টি এখন ভূমিধস ও হড়পা বানের মূল কারণ। এই বিপর্যয় পাহাড় থেকে ধ্বংসাবশেষ এনে সমতলের নদীর খাত উঁচু করে দিচ্ছে, ফলে নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমছে, বাড়ছে বন্যার প্রবণতা। পাহাড়েও বাড়ছে তাপমাত্রা। বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তিস্তা অববাহিকায় বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্রুত নির্মাণ। তিস্তা-থ্রি এবং তিস্তা-ফাইভ জলবিদ্যুৎ বাঁধের ত্রুটি ২০২৩ সালের বন্যায় বিপর্যয়ের ভয়াবহতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই ঘটনা বিজ্ঞানীরা হিমালয়ের ইতিহাসে অন্যতম বিধ্বংসী বন্যা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। সিকিম পর্যন্ত পাহাড় কেটে সেবক-রংপো রেল প্রকল্প তরুণ হিমালয়ের ভূ-গর্ভস্থ কাঠামোতে চরম চাপ সৃষ্টি করছে। সুড়ঙ্গ খননে দুর্বল শিলাস্তর ও বিকৃতি দেখা যাচ্ছে। বড় বাঁধ নির্মাণ এবং সুড়ঙ্গ খনন জলাধার-প্ররোচিত ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ায়। এই সম্মিলিত মানবিক হস্তক্ষেপের ফল ‘মানবসৃষ্ট দুর্যোগের বর্ধিত রূপ’। প্রকৃতি শুধু প্রতিশোধ নিচ্ছে না, মানুষ নিজেই সেই প্রতিশোধের পথ তৈরি করে দিচ্ছে।
পর্যটন শিল্প উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হলেও এর অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি স্থানীয় পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। হোমস্টে-র নামে পাহাড় ও ডুয়ার্সে গজিয়ে ওঠা হোটেল, রিসর্টগুলি প্রায়শই সরকারি জমিতে বা জনজাতিভুক্ত মানুষদের জমিতে অবৈধ দখলদারির মাধ্যমে নির্মিত। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল অঞ্চলে এই নির্মাণ চলছেই। বক্সা টাইগার রিজ়ার্ভের কাছে লজ ও রিসর্ট রাতের বেলা বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক পরিবেশকে ব্যাহত করছে। এ যেন ‘জমি লুট’ আর ‘নদী লুট’-এর এক রাখঢাকহীন খেলা, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর মুষ্টিমেয় বাইরের মানুষের আধিপত্য বাড়ছে।
এর সরাসরি ফল ভুগতে হচ্ছে স্থানীয়দের। ঔপনিবেশিক আমলের মতো আজও চা বাগানের শ্রমিকরা তাঁদের বাসস্থানের জন্য পারজা পাট্টা (জমির আইনি অধিকার) থেকে বঞ্চিত। রাজ্য সরকার যখন ৩০% চা বাগানের জমি অন্য উদ্দেশ্যে সরানোর কথা ভাবছে, তখন ভূমিহীনদের স্থানচ্যুতির হুমকি আরও তীব্র হচ্ছে। এই বঞ্চনা এবং আইনি ভূমি অধিকারের অভাব বিপর্যয়ের সময় পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে। বনগ্রামের অনেক বাসিন্দার আইনি ভূমি অধিকার না থাকায়, তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত পুনর্বাসন প্যাকেজ নিশ্চিত করা কঠিন। দিন কয়েক আগে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত মিরিকের কয়েকটি আশ্রয় শিবিরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাঁরা তখন আমাকে জানিয়েছিলেন তাঁদের একই বাসস্থান তিন বার ধসে বিধ্বস্ত হয়েছে। তাঁরা চান, ভূমিগত ভাবে নিরাপদ একটি স্থানে পুনর্বাসন।
এই ভঙ্গুর অঞ্চলকে রক্ষা করতে চাই স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি। শিলিগুড়ি পুর নিগম কর্তৃক গৃহীত ‘ক্লাইমেট রেজ়িলিয়েন্ট সিটি অ্যাকশন প্ল্যান’ (সিআরসিএপি) এক কার্যকর মডেল। লেখক ২০১৮ সালে মেয়র হিসাবে দায়িত্বে থাকাকালীন শিলিগুড়ি ভারতের প্রথম শহর হিসাবে সিআরসিএপি গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনায় ২০১৫-১৬ সালকে ভিত্তি বছর ধরে বছরে ১৪.৬ শতাংশ হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল। শিলিগুড়ি যে হেতু তরাই অঞ্চলের প্রবেশদ্বার, তাই এই মডেলের নীতিগত কাঠামোর সফল প্রয়োগ পাহাড় ও ডুয়ার্স অঞ্চলের বৃহত্তর জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা পরিকল্পনা (ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাকশন প্ল্যান)-এর জন্য একটি কার্যকর উদাহরণ হতে পারে। প্রয়োজন এর পরিধি সম্প্রসারণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক মাত্রা বৃদ্ধি, এবং বৈষম্য হ্রাস।
এই মুহূর্তে কিছু পদক্ষেপ আজ সময়ের দাবি— প্রথমত, জলাশয় ও সবুজ এলাকা রক্ষা করে জমির ব্যবহার পরিবর্তনের মানচিত্র কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে। পাহাড়ের ১১ মিটারের বেশি উচ্চতার গৃহ নির্মাণ এবং বেআইনি হোমস্টে চিহ্নিত করে ভেঙে দেওয়া জরুরি। দ্বিতীয়ত, তিস্তা অববাহিকায় নতুন বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রেখে বিদ্যমান বাঁধগুলির ঝুঁকি ও পরিবেশগত প্রভাবের উপর নিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। চলমান রেলপথ নির্মাণ কাজ সাময়িক ভাবে স্থগিত রেখে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দ্বারা ভূতাত্ত্বিক স্থিতিশীলতার মূল্যায়ন প্রয়োজন। নদী লুট কঠোর ভাবে বন্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নিরাপদ স্থানে পুনর্বাসন এবং চা বাগান শ্রমিক ও বনগ্রামের বাসিন্দাদের জন্য বকেয়া পারজা পাট্টা দ্রুত নিশ্চিত করা আবশ্যক।
সবচেয়ে জরুরি, পাহাড়ের মানুষের ক্ষমতায়ন। এর জন্য ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-কে (জিটিএ) সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি বিবেচনা করা উচিত। ষষ্ঠ তফসিল স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদকে ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন প্রশাসন এবং সামাজিক রীতির উপর আইন তৈরির ক্ষমতা দেয়। এটি পরিবেশগত শোষণ প্রতিরোধের জন্য একটি মৌলিক সাংবিধানিক হাতিয়ার। সাংবিধানিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই স্থানীয় জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম হবে এবং ভূ-সম্পত্তিগত বঞ্চনার উত্তরাধিকারকে অতিক্রম করা সম্ভব হবে।
অর্থাৎ, উত্তরবঙ্গকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন এক শক্তিশালী জন-আন্দোলন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)