E-Paper

মৌলবাদীর জন্ম

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, সংবাদমাধ্যমও কী ভাবে সক্রিয় শরিক হচ্ছে এই বিভাজন তৈরির খেলায়। তার চেয়েও বিপজ্জনক সমাজমাধ্যম। এখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিন থেকেই মানুষ যুদ্ধ করে। এক-একটা পোস্ট যেন এক-একটা কামানের গোলা!

স্বাগতম দাস

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২৫ ০৪:৪১
এক: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আর্জি নিয়ে নাগরিক সমাজের মিছিল। ৫ মে, কলকাতা।

এক: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার আর্জি নিয়ে নাগরিক সমাজের মিছিল। ৫ মে, কলকাতা। ছবি: পিটিআই।

পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হামলা আর অপারেশন সিঁদুর-এর পর বারে বারেই আশঙ্কা হচ্ছে। দেশটা বুঝি একেবারে মাঝখান থেকে ভাগ হয়ে গেল। অফিস-কাছারি, ট্রেন-বাস, পাড়ার চায়ের দোকান, সর্বত্র উত্তেজিত আলোচনা শুনে স্মৃতিতে ভেসে উঠছে এক প্রাক্তন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সেই অবিস্মরণীয় উক্তি: “হয় তোমরা আমার দলে, নয় তোমরা সন্ত্রাসবাদী।”

কিন্তু সত্যি কি তাই? বিহারের গ্রামের এমন মানুষকে তো চিনি, যিনি মন্দিরেও যান, আবার তাঁর মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধানও কাটেন। কলকাতাতেই এমন মানুষকে চিনি, মন্দিরে পুজো করেও যিনি সন্ধ্যায় মুসলমান প্রতিবেশীর ছেলের বিয়েতে গিয়ে হাতের তালুতে মেহেন্দি লাগিয়ে আসেন। মনে পড়ে দিল্লির শাহিন বাগের আজিজ়া বেগমকে— যিনি প্রতি দিন ফজরের নমাজ পড়েন, কিন্তু নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে রাস্তায় বসে সংবিধানের পৃষ্ঠা উঁচিয়ে ধরেন। বা, পঞ্জাবের সেই কৃষক হারভিন্দর সিংহের কথাই ভাবুন, যিনি গুরুদ্বারে মাথা নত করেন, আবার কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মুসলিম কৃষক আমিরুদ্দিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দিল্লির ঠান্ডায় রাস্তা আটকে বসে থাকেন।

এই মানুষগুলোর পরিচয় কি এক লাইনে লিখে ফেলা যায়? না। ওঁরা ধর্মপ্রাণ, অধিকার-সচেতন, প্রতিবাদী, পাড়া-পড়শির বন্ধু— সব এক সঙ্গে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারতীয় ভোটাররা শুধুমাত্র জাতি বা ধর্ম দেখে ভোট দেন না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্থানীয় সমস্যা, নেতার ব্যক্তিত্ব— এ সবেরও বড় ভূমিকা আছে ভোটদানের সিদ্ধান্তে। যেমন ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বহু মুসলিম ভোটারও স্থানীয় উন্নয়নের ভিত্তিতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, যা প্রমাণ করে যে, ভোটের সিদ্ধান্ত বাইনারি চিন্তার বাইরে গিয়ে ঘটে।

সমাজবিজ্ঞানীরাও একই কথা বলে আসছেন। হিটলারের ইহুদি-নিধন যজ্ঞ থেকে কম বয়সে বেঁচে ফেরা পোলিশ সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদ হেনরি তাজফেল তাঁর ‘সোশ্যাল আইডেন্টিটি’ তত্ত্বে বলেছিলেন, মানুষের কখনওই একটিমাত্র পরিচয় নেই। এক-এক সময়ে এক-একটা পরিচয় জেগে ওঠে। তিনি দেখিয়েছিলেন, মানুষ সহজেই নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত করে ও ‘আমরা বনাম ওরা’ মনোবৃত্তি তৈরি করে। রাজনীতির কারবারিরা এই প্রবৃত্তিকে ব্যবহার করেন নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে। অমর্ত্য সেন তাঁর আইডেন্টিটি অ্যান্ড ভায়োলেন্স: দি ইলিউশন অব ডেস্টিনি বইয়ে বলেছিলেন, মানুষের পরিচয় একটা ঋজুরেখ রাস্তার মতো নয়; বরং অনেকগুলো মোড় ও চত্বরের জটিল শহর। আমরা একই সঙ্গে বহু পরিচয়ের অধিকারী। একটি পরিচয়কে একমাত্রিক করে দেখা মানেই সহিংসতার বীজ বপন করা।

রাজনীতিকরা অবশ্য মানব মনস্তত্ত্বের এই জটিলতাকে দেখাতে চান না। তাঁদের দরকার কোনও একটা সোজা রাস্তা: হয় তুমি হিন্দু, না হলে মুসলিম। তুমি হয় দেশভক্ত, না হলে দেশদ্রোহী। আবার অঞ্চল বা মানুষ দেখে এই বাইনারি বিভাজনের রকমসকমও বদলায়: হিন্দু হলে, হয় তুমি সত্যিকারের তিলকমণ্ডিত নিরামিষাশী হিন্দু, নয় তুমি আমিষাশী, হিন্দুর ছদ্মবেশে ম্লেচ্ছ— এই রকম আর কী! কারণ সহজবোধ্য— দু’ভাগে ভাগ করে দিলে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করাটা সোজা হয়— উল্টো দিকের লোকেদের প্রতি রাগ তৈরি করে ভোট টানা যায়, আড়াল করা যায় দুর্নীতি থেকে বেকারত্ব, যাবতীয় সমস্যাকে।

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, সংবাদমাধ্যমও কী ভাবে সক্রিয় শরিক হচ্ছে এই বিভাজন তৈরির খেলায়। তার চেয়েও বিপজ্জনক সমাজমাধ্যম। এখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিন থেকেই মানুষ যুদ্ধ করে। এক-একটা পোস্ট যেন এক-একটা কামানের গোলা! সমাজমাধ্যম আমাদের বোঝাতে থাকে: তুমি হয় এ পাশে, নয় ও পাশে— মাঝের কিছু নেই। সমাজমাধ্যমের ব্যবসা করা অতি বৃহৎ সংস্থাগুলো আমাদের রাগ, ভয় আর ঘৃণা বিক্রি করে— এগুলোর উপরেই টিকে থাকে তাদের ভিউ, ক্লিক, শেয়ার, রিঅ্যাকশন। যখন আমরা রেগে যাই, তখন নিজেদের সমর্থনে আরও তথ্য পাওয়ার আশায় আরও বেশি স্ক্রল করতে থাকি। যখন আমরা কাউকে শত্রু ভাবি, আমরা তার বিরুদ্ধে নানান পোস্ট আরও বেশি শেয়ার করি। ফলে সে সব পোস্টের রিচ বাড়ে, টাকা কামানোর রাস্তাটি সুগম হয়।

প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা জ়েনেপ তুফেকচি দেখিয়েছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদমগুলো সবচেয়ে বিতর্কিত, বিভাজনমূলক কনটেন্টকেই বেশি করে সামনে আনে, কারণ সেগুলো মানুষকে অনেকটা সময় স্ক্রিনে আটকে রাখে। এর সঙ্গে আর একটি বিষয় জুড়ে দেখা জরুরি— মাস সাইকোলজি বা ভিড়ের মনস্তত্ত্ব। গ্যাব্রিয়েল তার্দ এবং গুস্তাভ লে বঁ-র মতো সমাজমনোবিজ্ঞানীরা বহু আগেই দেখিয়েছিলেন, ব্যক্তি যখন জনতার অংশ হয়ে যায়, তখন যুক্তি নয়, আবেগই চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আজকের ডিজিটাল যুগে এই মনস্তত্ত্ব আরও জটিল ও বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। আমরা এমন সব অনলাইন বলয়ে ঢুকে পড়ি— যাকে বলা যেতে পারে ইকো চেম্বার— যেখানে আমাদের মতের সঙ্গে মিল রয়েছে, এমন মতই বার বার প্রতিধ্বনিত হয়; আর যে কোনও ভিন্নমত আক্রান্ত হয় কুৎসিত ভাবে। একে বলা যায় এক ধরনের ভ্যালিডেশন লুপ— যখন আমার মত, বিশ্বাস, রাগ বা ঘৃণা একাধিক মানুষের কাছ থেকে সমর্থন পায়, তখন সেটা আমার কাছে ধ্রুব সত্য হয়ে দাঁড়ায়, প্রশ্নাতীত হয়ে ওঠে। এই সামাজিক স্বীকৃতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও কঠোর করে তোলে, এবং এমন এক মনস্তাত্ত্বিক সান্ত্বনা তৈরি করে, যেখানে “আমি যা ভাবছি, তাই সঠিক” — কারণ আমার মতো অনেকেই তাই ভাবছে।

এই দ্বিমাত্রিক ভাবনার অনিবার্য শেষ গন্তব্য মৌলবাদ। প্রথমে যুদ্ধ হয় ‘আমরা বনাম ওরা’র, তার পর আসে ঘৃণা, তার পর একরোখা অন্ধত্ব। সব শেষে আসে ধ্বংস। যখন মানুষকে ক্রমাগত বলা হয়— ‘তুমি হয় হিন্দু, নয় মুসলিম’, ‘হয় দেশভক্ত, নয় দেশদ্রোহী’, ‘হয় শহুরে নকশাল, নয় গ্রামের সাচ্চা ভারতীয়’— তখন এক সময় মানুষের নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতাই হারিয়ে যায়। চিন্তা কমে, রাগ বাড়ে। এই রাগ থেকেই আসে কট্টরবাদ— নিজের গোষ্ঠী বা চিন্তাধারার বাইরে কোনও কিছু ভাবতেই অস্বীকার করা। মৌলবাদী আন্দোলনগুলো সব সময় তীব্র বিভাজন আর ক্রোধের উপর দাঁড়িয়ে গড়ে ওঠে। তখন সেখানে ব্যক্তিগত জটিলতা মুছে দিয়ে একটিমাত্র পরিচয়কে বড় করে দেখা হয়— “তুমি কেবল এই দলের লোক, তুমি কেবল এই মতে বিশ্বাসী, আর নইলে তুমি শত্রু।”

এ ভাবে সমাজের সমস্ত মধ্যবর্তী অঞ্চল মুছে ফেলা হয়। বিপদে পড়ে যান মাঝখানে থাকা সেই মানুষগুলো, যাঁরা অবাক হয়ে ভাবেন— একটা দলকে সমর্থন করা মানে কি তার যাবতীয় অন্যায়কে যে ভাবে হোক ঢাকার চেষ্টা করে যাওয়া? একটা রাজনৈতিক মতকে বিশ্বাস করা মানে কি এটাও বিশ্বাস করা যে, অন্য সমস্ত মত-ই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর? তবে তো সেই বিশ্বাসের সঙ্গে ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের বিশ্বাসের খুব একটা পার্থক্য থাকে না। সেই বিশ্বাসের জমিতেই পুষ্ট হয় রাজনৈতিক চরমপন্থী দল, জাতিগত উগ্রবাদী আন্দোলন। সেখানে যুক্তিঋদ্ধ কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়, থেকে যায় কেবল চিৎকার।

সমাজমাধ্যমের বাড়তি ভূমিকাও এখানেই। সমাজমাধ্যম এই মৌলবাদের মাটিতে সার ঢেলেও রোজগারের পথ দেখায়— এক-একটা ভাইরাল ভিডিয়ো, এক-একটা হ্যাশট্যাগ যুদ্ধ, এগুলো আমাদের আরও নিশ্চিত করে তোলে যে আমরাই ঠিক, ওরা ভুল। আর, আমি যা বিশ্বাস করি সেটাই শুধু ঠিক, অন্য মতের সবাই বিরুদ্ধপক্ষ— এই কথাটা আমার মনের দখল নিলে আমিও, হয়তো নিজের অজানতেই, হয়ে উঠি মৌলবাদী।

মৌলবাদকে যাঁরা ঘৃণা করেন, নিজের দিকে ফিরে তাকানো এই মুহূর্তে তাঁদের সবার কর্তব্য। নিজের ভিতরে যেন জন্ম না নেয় সেই দানব, তা নিশ্চিত করতে হবে তো।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Social Media Abuse Social Media Pahalgam Terror Attack Operation Sindoor Communal Clash

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy