Advertisement
০৬ মে ২০২৪
AI

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সত্যিই কাজের বাজারে থাবা বসিয়েছে?

চারিদিকে গেল গেল রব। সবাই মনে করছে সবার কাজ গেল। বাজারে এই ভয়টাই চেপে বসেছে।

কাজ কমাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?

কাজ কমাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? প্রতীকী ছবি।

সুপর্ণ পাঠক
সুপর্ণ পাঠক
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ ১৩:৩৯
Share: Save:

এটা সাম্প্রতিক ঘটনা। কথা হচ্ছিল দুই তথ্য বিজ্ঞানির সঙ্গে। আর দু’জনেই মনে করেন যে বাজারে কর্মসংস্থান কমবে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সত্যিই আমাদের সবার কাজে থাবা বসাবে? চেপে ধরায় দু’জনেই স্বীকার করলেন যে এটা তাঁদের ধারণা। আর আমরা যতই বিজ্ঞান পড়ি না কেন, হ্রদয়কে কী করে অস্বীকার করি। তাই জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম, “এটা তথ্য বলছে না মনের ভয় বলছে?” কোনও উত্তর তখনই পেলাম না। এর পর যখন ফিরছি তখনই পর পর দুটো হোয়াটসঅ্যাপ ঢুকল। দুটোরই বক্তব্য এক। তথ্য নয়। এ মতামত ভয়সঞ্জাত।

ভয়। বাজারে এই ভয়টাই চেপে বসেছে। চারিদিকে গেল গেল রব। সবাই মনে করছে সবার কাজ গেল। আর এ প্রসঙ্গ উঠে আসছে অ্যামাজ়ন বা অন্য রাক্ষুসে আইটি সংস্থাগুলিতে ছাঁটাইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু যদি তলিয়ে দেখা যায় তা হলে হয়ত দেখব এই ছাঁটাই ছিল অবশ্যম্ভাবী। কারণ, এই সংস্থাগুলি গত কয়েক বছরে বিরাট সংখ্যক নিয়োগের রাস্তায় হেঁটেছিল। আর এদের প্রত্যেকেই তাদের যে সব শাখায় বিনিয়োগ করেছিল ভবিষ্যতের বাজার ধরার আশায় সেই সব শাখাগুলি লাভের মুখ তো দেখেইনি, উল্টে হাজার হাজার কোটি ডলার ক্ষতির মুখ দেখেছে অনেক দিন ধরে। অ্যামাজনের কথা যে হেতু লিখেছি, তাই বলি এই সংস্থাটির বইয়ের ব্যবসাটি এত ক্ষতি করেছে যে খরচ কমাতে যত কর্মী ছাঁটাই হয়েছে তার একটা বড় অংশই গিয়েছে এই জাতীয় ব্যবসা থেকেই।

অ্যামাজ়নের খুচরো ব্যবসার প্রধান, ডউগ হেরিংটন সহকর্মীদের পাঠানো ইমেলে যা লিখেছিলেন তার সারমর্ম হল, কোভিডের সময় সংস্থা যে ভাবে কর্মী সংখ্যা বাড়িয়েছিল তা আজকের বাজারের নিরিখে বড্ড বেশি। তাই খরচ কমাতে এই সঙ্কোচনের রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে তারা। তবে আগামী দিনে, খুচরো বিক্রির ব্যবসায়, যার মধ্যে ওষুধও থাকবে, সেখানেই নতুন বিনিয়োগ করবে সংস্থাটি।

এই যে ১৮ হাজার কর্মী ছাঁটাই হলেন, তা কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগ্রাসী প্রসারের কারণে নয়। ছাঁটাই হয়ে সংস্থার ভুল সিদ্ধান্তের মূল্য দিলেন তাঁরা।

তার মানে এই নয় যে নতুন এই প্রযুক্তি কাজের বাজারে নতুন চ্যালেঞ্জ আনবে না। কিন্তু তার চরিত্রটা কী হবে প্রশ্ন সেটাই। ম্যাকিনসে এটা নিয়ে সমীক্ষা করেছে। তাদের সমীক্ষা বলছে আগামী দিনে কাজের বাজারে একটা বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। আমরা ভাবছি এর ফলে বাজারে কাজের বাজার সঙ্কুচিত হবে। কিন্তু সব সমীক্ষাই বলছে এই ধারণাটা বোধহয় ঠিক নয়। ঠিক কী হবে তা নিয়ে কিন্তু এখনও কোনও নিশ্চিত তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তে কেউ আসতে পারছেন না।

উদাহরণ হিসাবে কম্পিউটার গেমসের কথা উঠে আসছে। অথবা রোবোটিকস। কম্পিউটার গেমসের বাজার এখন এতটাই বড় যে এই গেমস তৈরির ব্যবসায় আমেরিকাতেই ২ লক্ষ ৬৮ হাজার কর্মী কাজ করছেন। ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত এই ব্যবসা বছরে বেড়েছে ৩.৫ শতাংশ হারে। ইংরেজিতে এই শিল্পকে গেমিং বলা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে স্টুডিও। কাজ হচ্ছে গল্প লিখিয়ে থেকে শুরু করে অঙ্কন শিল্পীদেরও। প্রোগ্রামারদের কথা বাদই দিলাম।

তাই আলোচনাটা আসলে বদলের দিশা নিয়ে। কাজের ধরনের পরিবর্তনের দিশা নিয়ে। রোবোটিকসেও একই ব্যাপার। রোবট নাকি কাজ খাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই শিল্পের বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে বাড়ছে কর্মী নিয়োগের সংখ্যাও।

তা হলে প্রশ্ন হল, কাদের কাজ থাকবে আর কাদের থাকবে না। সমীক্ষা বলছে নতুন প্রযুক্তিতে কাজ কমবে না। কাজ করাটা আরও সহজ হয়ে উঠবে। এ দুটোর মধ্যে ফারাক আছে। আমরা জানি ব্যাঙ্কে কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদের কথা। কিন্তু কম্পিউটার চালু হওয়ার পরে ব্যাঙ্কে কাজ সহজ হয়েছে এবং নতুন কাজের জায়গা তৈরি হয়েছে। কাজটা আরও সহজ হয়েছে।

এ ব্যাপারে সবাই সহমত যে এই প্রযুক্তি কখনই মানবিকতাকে আত্মস্থ করতে পারবে না। আর তা পারবে না বলেই চ্যাটজিপিটি যতই লিখুক সে রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে পারবে না। তাই শিক্ষকের জায়গা নিতে পারবে না, লেখক হয়ে উঠতে পারবে না, উকিলও না, ডাক্তারও না। ডাল-ই কোনওদিনই সালভাদর ডালি হয়ে উঠতে পারবে না। শুধু তাকে নকল করতে পারবে।

আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজ করে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। নির্দিষ্ট যৌক্তিক পরিসরে। আমরা কিন্তু অজানা পরিসরেও উদ্ভাবনী হতে পারি। কৌশলী হতে পারি। হতে পারি অযৌক্তিক। আর পারি হ্রদয়ের ডাক শুনতে যার একটা বড় অংশই হল মানবিকতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর কোনওটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দক্ষতার পরিসরে নেই।

আসলে আমরা ভুলে যাই যে প্রযুক্তির চাহিদা যত বাড়ে ততই আরও বেশি সংখ্যক মানুষ সেই চাহিদার জোগান দিতে জড়িয়ে পড়ে। কাজের বাজারের পরিসর বাড়তে থাকে।

আসলে ভয়টা কোথায়? এক দিকে যেমন কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হওয়ার ভয়, আর এক দিকে আবার মানুষের অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার ভয়। আমরা আসলে যা বলছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে, বা যা ভাবছি নতুন প্রযুক্তির আগ্রাসী প্রসার নিয়ে তা হল অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার ভয়। আর এখানেই আমাদের জিত। কম্পিউটার ভালবাসতে পারবে না। আর তাই সে মানুষের মতো সৃজনশীল হতে পারবে না। কম্পিউটার ভয় পেতে পারে না। তাই সে মানুষের মতো কৌশলী হতে পারবে না। কিন্তু যে কাজে পৌনঃপুনিকতা আছে সেখানে এর প্রসার হবে।

তবে অন্য দিকটাও যে একেবারেই নেই তা নয়। একটা সময় আসবে যখন নতুন এই প্রযুক্তি মানুষের কাজের চাপ কমাবে। আসবে সম্পদ পুনর্বণ্টনের জন্য আর্থিক ব্যবস্থা। শিল্পবিপ্লবের পরে যেমন প্রয়োজন হয়েছিল কাজের বাজার নিয়ে আইনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের। না হলে হতেই পারে যে বিশ্বে শুধু দুটো শ্রেণির মানুষ থাকল। গরিব আর বড়লোক। আসল ভাবনাটা বোধহয় এখানেই। আর তা কিন্তু ভাবতে শুরু করতে হবে এখনই। কাজ কমবে। কারণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের সহায়ক হবে। কিন্তু তাতে খরচ কমায় যেন তা শুধুই সংস্থার লাভের উপজীব্য না হয়ে ওঠে। আর এই ভাবনাটা কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব নয়। আর এখানেই তার হার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

AI Job
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE