১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার করেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে অনধিকার হস্তক্ষেপ করছে ভারত। উত্তরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিসভার প্রধান সদস্যদের পাঠান নানা দেশে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের উপর কী ধরনের নির্যাতন চালাচ্ছে পাক সেনা, তা বোঝাতে। সে সময়ের প্রবীণ সমাজবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণকেও (জেপি) এই প্রচারে আহ্বান করেছিলেন ইন্দিরা। এর কয়েক বছর পরে জেপি-ই ইন্দিরা-বিরোধীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একাত্তরে কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সাড়া দিয়ে মাত্র ছ’সপ্তাহে জেপি সফর করেছিলেন ইউরোপ, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার ১৬টি দেশ। আবেদন করেছিলেন, নেতারা যেন তাঁদের প্রভাব ব্যবহার করে বাঙালিদের উপর পাক অত্যাচার বন্ধ করেন। বেশির ভাগ নেতাই তখন নিরপেক্ষ থেকে দায় এড়িয়েছেন। কিন্তু এই সব দেশে জনমত ক্রমশ বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে, ঝোঁকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।
এখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে, পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের মদতদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে এবং আন্তর্জাতিক মত ভারতের দিকে আনতে। ভারত সরকার বার্তা দিতে চায় যে সংসদে বা তার বাইরে বিরোধীরা যা-ই বলুন, সন্ত্রাস-বিরোধিতার প্রশ্নে ভারত এক স্বরে কথা বলে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অভিযানকেও জোরালো সমর্থন এসেছে সমস্বরে। পাকিস্তানের প্রত্যাঘাতের ফলে এক সংক্ষিপ্ত কিন্তু তীব্র সংঘাত ঘটে গেলেও সর্বদলীয় সমর্থন অটুট ছিল। এমনকি প্রধান বিরোধী কংগ্রেস, যা ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময়ে সরকারের পাকিস্তান-বিরোধী প্রচেষ্টায় সংশয়ী ছিল, এ বার সামরিক কার্যসূচিকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছে।
যে সাতটি প্রতিনিধি দলকে নানা দেশে পাঠানো হল, তার মধ্যে এনডিএ-র সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন কংগ্রেস, ডিএমকে, জেডিইউ, শিবসেনা, তৃণমূল প্রভৃতি বিরোধী দলের সদস্যরাও। সেই সঙ্গে প্রাক্তন কূটনীতিকরাও। মোট ৩২টি দেশ গন্তব্য, যার মধ্যে ১৩টি দেশ রয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ১৫-সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে। এ ছাড়া ব্রাসেলস-এ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রধান কার্যালয়েও যাবেন তাঁরা। কী অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁদের?
দেখা যাচ্ছে, যদিও পহেলগামে সন্ত্রাসী হানার নিন্দা করছে সব দেশ, কিন্তু পাকিস্তানের সমালোচনা করা এড়াচ্ছে তারা। হতে পারে সন্ত্রাসী হানার সঙ্গে পাকিস্তানের যোগ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নয়। তবে এই সম্ভাবনাই বেশি যে, তারা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এখনই ছিন্ন করতে চায় না। অথবা, ইউক্রেন আর গাজ়ায় যুদ্ধ চলাকালীন দক্ষিণ এশিয়ায় আরও একটা দীর্ঘ সংঘাতের সূচনা তারা চায় না।
ভারতীয় প্রতিনিধিরা চাইছেন, সন্ত্রাসে মদত জোগানোর জন্য পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মহল যেন ব্রাত্য, কোণঠাসা করে। কিন্তু পাকিস্তানও একই রকম ভাবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে। উদ্দেশ্য, ভারত যে ভাবে পাকিস্তানকে ‘শাস্তি’ দিতে সিন্ধু নদের জলের জোগান বন্ধ করে দিচ্ছে, তা তুলে ধরে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মত গঠন করা। ভারত-পাক যুদ্ধের পরবর্তী অধ্যায় শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে— কে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মত গঠন করতে পারে, কে পরিস্থিতির ব্যাখ্যার উপর বেশি প্রভাব তৈরি করতে পারে। প্রায় একই সময়ে এই দুই দেশের প্রতিনিধি দল সফর করবে আমেরিকাতে। দু’পক্ষই চেষ্টা করবে আমেরিকার কংগ্রেসের সদস্য, সেনেট সদস্য, কূটনৈতিক মহলে নানা প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে দলে টানতে। পহেলগাম সঙ্কটের ব্যাখ্যা যাতে নিজেদের দিকে ঝোঁকে, তার জন্য চেষ্টা করবে দু’টি দলই। আমেরিকার সরকার অবশ্য এখনও অবধি স্পষ্ট কোনও অবস্থান নেয়নি।
বর্তমানে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে দশটি অস্থায়ী সদস্যের একটি পাকিস্তান। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশনস) কমিটিতেও পাকিস্তান আছে। যখন ভারত চেষ্টা করছে পাকিস্তানের উপর নিষেধাজ্ঞা আনার, তখন আফগানিস্তানের উপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে রাষ্ট্রপুঞ্জকে সহায়তা করবে পাকিস্তান। পাকিস্তান নিরাপত্তা পরিষদের সন্ত্রাস-বিরোধী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্টও হতে চলেছে। তাই রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের পাক-বিরোধী দরবার কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ভারত-পাকিস্তানের পরস্পর-বিরোধী প্রচারের মুখে অধিকাংশ দেশ সম্ভবত কোনও পক্ষ না নিয়ে একটু সরে থাকবে। অতএব পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক মহলে বিচ্ছিন্ন, সহায়হীন করে তুলতে হলে ভারতকে দীর্ঘ দিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে কূটনৈতিক চাপ রেখে যেতে হবে। সেই চাপ তৈরি করতে পারলেও পাকিস্তান যে সন্ত্রাসকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার থেকে বিরত হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ভারতকেই নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি সংশোধন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের আক্রমণের সম্ভাবনা কমানো যায়।
তবে সর্বাগ্রে জরুরি, কাশ্মীরের মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করা। পহেলগাম আক্রমণের পরে স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে আশা জাগে। তাঁরা অন্যান্য রাজ্যের মানুষের সঙ্গে সহৃদয়, সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্কেই আগ্রহী। কাশ্মীরিদের হৃদয় জয় করাই হবে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রচেষ্টা বানচাল করার সবচেয়ে ভাল উপায়।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)