E-Paper

সংখ্যালঘু ও ভোট রাজনীতি

যুক্তফ্রন্ট সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কংগ্রেস বাহাত্তরে ফের ক্ষমতায় ফিরেছিল। কিন্তু মাত্রপাঁচ বছরের জন্য। তত দিনে জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মুসলিম ভোটের গুরুত্ব টের পেয়ে গিয়েছেন। তাই ১৯৭৭-এ জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পরে কংগ্রেসের পক্ষে আর ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হয়নি।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:০০

তখনও ইভিএম আসেনি। ভোটগণনার কাজ শেষ করে নির্বাচনের ফল প্রকাশ হতে তাই বেশ কয়েকদিন লেগে যেত। তা সত্ত্বেও ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিভিন্ন আসনের ফল প্রকাশের শুরুতেই ইঙ্গিত মিলেছিল, মুসলিম প্রধান এলাকায় কংগ্রেসের ভরাডুবি হচ্ছে। সব মুসলিম প্রধান এলাকাতেই এই ধারা অব্যহত থাকলে কংগ্রেসের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন।

কংগ্রেস, অ-কংগ্রেসি নেতাদের এই আন্দাজ মিলে গিয়েছিল। অ-কংগ্রেসি শিবির ভোটের আগে ইউএলএফ ও পিইউএলএফ নামে দুই শিবিরে বিভক্ত থাকলেও, ভোটের পরে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার। যার অন্যতম কারণ ছিল মুসলিম প্রধান এলাকায় কংগ্রেসের ভোটে ধস।

যুক্তফ্রন্ট সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কংগ্রেস বাহাত্তরে ফের ক্ষমতায় ফিরেছিল। কিন্তু মাত্রপাঁচ বছরের জন্য। তত দিনে জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মুসলিম ভোটের গুরুত্ব টের পেয়ে গিয়েছেন। তাই ১৯৭৭-এ জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পরে কংগ্রেসের পক্ষে আর ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব হয়নি। কারণ মুসলিম ভোটের সিংহভাগ তার পর থেকে বামফ্রন্টের সঙ্গেই থেকেছে।

বামফ্রন্ট সম্পর্কে মুসলিমদের মোহভঙ্গের শুরু ২০০৬ থেকে, সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে। যাতে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে কর্মসংস্থানে চরম অবহেলার শিকার। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে গ্রামের মুসলমান কৃষকদের মধ্যেও ক্ষোভ ছড়ায়। তার উপর ছিল রিজওয়ানুর রহমানের ঘটনা: তাঁর আত্মহত্যার অভিযোগ শিক্ষিত মুসলমানদেরও বামফ্রন্টের থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল।

তার ফল কী দাঁড়ায়? পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১২৫টিতে মুসলমান ভোট নির্ণায়ক ভূমিকা নিয়ে থাকে। ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট এর মধ্যে ১০২টি আসনে জিতেছিল। সেই সুবাদেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ২৩৫টি আসন জেতার বড়াই করেছিলেন। কিন্তু মুসলমান ভোট সরে যেতেই ছবিটা পাল্টে যায়। ২০১১-য় তৃণমূল ক্ষমতায় আসে ওই ১২৫টি আসনের মধ্যে ৯৫টিতে জিতে।

আর মাস চারেক পরেই ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন। দিল্লিতে বসে বিজেপি শীর্ষনেতৃত্বের একাংশ আশা করছেন, এ বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে মুসলিম ভোটে ভাঙন ধরানো যাবে। তাঁদের লক্ষ্য, তৃণমূল থেকে সদ্য নিলম্বিত হুমায়ুন কবীর, যিনি মুর্শিদাবাদে বাবরি মসজিদ তৈরির উদ্যোগ করে ভিড় জড়ো করে গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। নতুন দল গড়ে নির্বাচনে নামার কথা ঘোষণা করেছেন।

২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার মুসলমানদের ভাগ ২৭ শতাংশ। এখন তা ৩০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলেছে অনেকের অনুমান। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর— এই তিন জেলায় মুসলিমদের সংখ্যা সব থেকে বেশি। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল এই তিন জেলার ৪০টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৩২টি আসনই ঝুলিতে পুরেছিল। বিজেপির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের ধারণা, হুমায়ুন কবীর এই তিন জেলার সঙ্গে বাকি রাজ্যেও মুসলমান ভোটে ভাঙন ধরাতে পারলে বিজেপি তার সুবিধা পাবে। ঠিক যে ভাবে অন্যান্য রাজ্যে আসাদুদ্দিন ওয়েইসি-র এমআইএম বিরোধীদের মুসলমান ভোটে ভাগ বসিয়ে বিজেপিকে সুযোগ করে দেয় বলে অভিযোগ। সম্প্রতি বিহারের ভোটেও আরজেডি-কংগ্রেসের মহাগঠবন্ধন ওয়েইসির মুসলিম ভোট বিভাজনের ফল ভুগেছে।

বিজেপি নেতৃত্ব সম্ভবত একটি হিসাবে ভুল করছেন। তা হল, মুসলমান সমাজের কাছে হুমায়ুন কবীরের বিশ্বাসযোগ্যতা। যিনি কংগ্রেস থেকে রাজনীতি শুরু করে তৃণমূলে গিয়ে আবার কংগ্রেসে ফিরেছিলেন। তার পরে কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের হাত ধরে বিজেপিতে গিয়ে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পদ্মফুল চিহ্নে ভোটে লড়েছিলেন। পরের বছরই আবার তৃণমূলে গিয়ে একুশের ভোটে বিধায়ক হয়ে যান। এ-হেন হুমায়ুন বাবরি মসজিদের নামে ভিড় জড়ো করতে পেরেছেন বলে তিনি রাজ্যে মুসলমানদের নেতা হয়ে উঠবেন, এই ভেবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা শুভেন্দু অধিকারীরা অঙ্ক কষে থাকলে, সেই হিসাব না-ও মিলতে পারে। তার উপরে যদি মুসলমানদের সন্দেহ হয়, হুমায়ুন আসলে বিজেপির ‘হাতের পুতুল’, তা হলে মুসলমান ভোট বিভাজনের আশা পূরণ হওয়া কঠিন।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের ভোটের ধরন দেখলে বোঝা যাবে, প্রথমে কংগ্রেস, তার পরে বামফ্রন্ট, শেষে তৃণমূল— মুসলমান সমাজের ভোট রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি মেনেই বাক্স বদলেছে। বিশেষত গত দু’টি বিধানসভা ও লোকসভা নির্বাচনে মুসলমানদের তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার পিছনে প্রধান কারণ ছিল— বিজেপিকে ঠেকানোর চেষ্টা। যেখানে বিজেপিকে ঠেকানোর বাধ্যবাধকতা নেই, সেখানে মুসলিমরা বাম-কংগ্রেসকে পরিস্থিতি অনুযায়ী ভোট দিয়েছেন। উদাহরণ ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসকে মুসলিমরা ভোট দিলেও চব্বিশের লোকসভা নির্বাচন আসতেই সেই ভোট আবার তৃণমূলের দিকে সরে গিয়েছিল।

অনেকেই মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের ময়দানে নামার আগে মুসলিমদের ৩০ শতাংশ ভোট হাতে নিয়ে নামেন। অথচ ২০২১-এর তৃণমূল ৭৫ শতাংশ মুসলমানদের ভোট পেয়েছিল বিজেপিকে ঠেকানোর তাগিদে, কিন্তু তার পর থেকে যে সব পুরসভা, পঞ্চায়েত বা উপনির্বাচনে যেখানে বিজেপিকে ঠেকানোর তাগিদ ছিল না, সেখানে কিন্তু মুসলিম ভোট ভাগ হয়ে গিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ফলেও বোঝা যাবে, উত্তরবঙ্গে মুসলমান ভোট ভাগ হয়ে গিয়েছিল— যার সুফল কুড়িয়েছিল বিজেপি। কিন্তু মুসলমানরা দক্ষিণবঙ্গে এককাট্টা হয়ে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন। সেই বিজেপিকে ঠেকানোর তাগিদেই।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের মধ্যে ক্ষোভ থেকেই আইএসএফ-এর জন্ম হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে মুসলমানদের যে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তাঁদের হাল ফিরে গিয়েছে, এমন কোনও পরিসংখ্যান নেই। বরঞ্চ তৃণমূল জমানার দুর্নীতি, কুশাসনের ফল হিন্দুদের মতো মুসলমানদেরও ভুগতে হয়েছে। নিয়োগ দুর্নীতির ফলে হাজারো শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা কিছু কম নয়। সমাজের নিচু স্তরে থাকা মানুষরা উপরের স্তরে উঠে আসার জন্য সরকারি চাকরির উপরে ভরসা করেন। সেই সরকারি চাকরিতেই নিয়োগ দুর্নীতি আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মুসলমানদেরই বেশি ধাক্কা দিয়েছে। সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে এমন নয়। ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৫.১৯ শতাংশ। ২০১৬ সালের কর্মী-গণনায় দেখা যায়, তা সামান্য বেড়ে ৬.০৮ শতাংশ হয়েছে। তার পর থেকে রাজ্য সরকার আর কর্মী-গণনাই করেনি। ওবিসি তালিকা, ওয়াকফ আইনের রাজনৈতিক বিরোধিতা করেও শেষে ওয়াকফ সম্পত্তি নথিবদ্ধ করার নির্দেশ নিয়েও মুসলমানদের ক্ষোভ রয়েছে।

এই ক্ষোভ সত্ত্বেও গত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল মুসলিম প্রধান এলাকায় ভাল ফল করেছিল। যে ১৭৪টি আসনে মুসলমান ভোটের হার ১৫ শতাংশের বেশি, গত বিধানসভায় তৃণমূল তার মধ্যে ১৪৭টিতে জিতেছিল। আইএসএফ পেয়েছিল একটি। বাকি ২৬টি বিজেপি জিতেছিল। চব্বিশের লোকসভা ভোটেও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। তৃণমূল এই ১৭৪টির মধ্যে ১২৮টি বিধানসভা এলাকায় এগিয়েছিল। কংগ্রেস ১১টিতে এগিয়েছিল। বিজেপি এগিয়েছিল মাত্র ২৬টিতে।

কোনও এক হুমায়ুন কবীরের বাবরি মসজিদের খেলায় ভোটের মেরুকরণ হয়ে চার মাসের মধ্যে এই ছবি আমূল বদলে যাবে? আশা করা যায়, বিজেপির ধুরন্ধর জাতীয় নেতারা এতটাও দিবাস্বপ্ন দেখেন না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP TMC WB assembly election minority vote

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy