E-Paper

বন্ধু যদি প্রতিদ্বন্দ্বীরও বন্ধু হয়

১৯৬২-৬৬ সালের মধ্যে ভারতের অস্ত্রের ৭০ শতাংশই এসেছে রাশিয়া থেকে, যেখানে আমেরিকা আর ব্রিটেন মিলে মাত্র ২৩ শতাংশ।

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৯

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আসছেন ভারতে। প্রবীণদের হয়তো মনে পড়বে ১৯৫৫ সালে সোভিয়েট নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের ভারত সফর। জওহরলাল নেহরু-সহ ভারতীয় নেতাদের ক্রুশ্চেভ বলেছিলেন, দুই দেশ এতই নিকট যে, ভারত পবর্তচূড়ার উপর থেকে ডাক দিলে পর দিন সকালে রাশিয়া পৌঁছে যাবে দোরগোড়ায়। সে সময়ে চিনের সঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়নের রেষারেষি তীব্র হচ্ছে— জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পর কে হবে কমিউনিস্ট দুনিয়ার নেতা? সোভিয়েট ইউনিয়ন চিনের বাইরে নতুন নতুন বন্ধু দেশ খুঁজছে এশিয়ায়। স্তালিন ভারতের স্বাধীনতার আগেই এ দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ করেছিলেন। কিন্তু নেহরুর নির্জোট (নন-অ্যালাইনমেন্ট) নীতি ছিল তাঁর না-পসন্দ। ভারত যে স্বাধীন হওয়ার পরেও ব্রিটেন ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তাতে তিনি বলেছিলেন, ভারত ব্রিটেনের থেকে কেবল আংশিক স্বাধীনতা পেয়েছে।

সোভিয়েট ইউনিয়নের বন্ধুত্বের প্রতি ভারতের দ্বিধাহীন সমর্থন, এই ছিল স্তালিনের দাবি। মস্কোতে ভারতের রাষ্ট্রদূত সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন স্তালিনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারেননি। স্তালিনের মৃত্যুর (১৯৫৩) পর ক্রুশ্চেভ আসায় সম্পর্কে পরিবর্তন আসে। মস্কোর সহায়তায় ইস্পাত কারখানা তৈরি হয় ভিলাইতে। ভারত-সোভিয়েট চুক্তির ফলে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারে ভারত। এ সবের দাম ভারতীয় মুদ্রায় দিত ভারত, তাতে অনেকটাই সাশ্রয় হত বিদেশি মুদ্রার। ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের সময়ে রুশ-ভারত সম্পর্ক আরও জোরালো হয়। ভারতের উপর চিনের প্রভাব যাতে না বাড়ে, সে বিষয়ে সদা-সতর্ক রাশিয়া হয় ভারতের প্রধান অস্ত্র জোগানদাতা। ১৯৬২-৬৬ সালের মধ্যে ভারতের অস্ত্রের ৭০ শতাংশই এসেছে রাশিয়া থেকে, যেখানে আমেরিকা আর ব্রিটেন মিলে মাত্র ২৩ শতাংশ।

১৯৭১ সালের ৯ অগস্ট ভারত-সোভিয়েট চুক্তিকে বলা চলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের শীর্ষ মুহূর্ত। কুড়ি বছরের জন্য বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তির অঙ্গীকারের এই চুক্তি ভারতের বিদেশ নীতির ভিত্তি হয়ে ওঠে। এটি সামরিক চুক্তি না হলেও, ভারতের কাছে নিরাপত্তার আশ্বাস হয়ে আসে। তখন ভারত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত হচ্ছে। আমেরিকা, পাকিস্তান এবং চিন জোট বাঁধছে, তার মোকাবিলাতেও তৈরি হতে হচ্ছে। ভারতে একটি ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল যে মস্কোই ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সহযোগী।

এই বোধ গড়ে উঠেছিল শীতল যুদ্ধের সময়ে, যখন আমেরিকা-প্রভাবিত পশ্চিমের দেশগুলি ভারতকে সহায়তা দিতে নারাজ ছিল। ভারতের নির্জোট নীতি ছিল তাদের ক্ষোভের কারণ। বরং পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে আমেরিকা। সাউথ-ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন, সেন্ট্রাল এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন, এমন কয়েকটি চুক্তিতে পাকিস্তানকে চুক্তি-সঙ্গী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। এর ফলে পাকিস্তানকে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করায় বাধা থাকে না। পাকিস্তান আক্রান্ত হলে আমেরিকা সহায়তার অঙ্গীকারও ছিল। ফলে ভারত আরও সরে যায় সোভিয়েটের দিকে। তা ছাড়া মস্কো আন্তর্জাতিক মঞ্চে দিল্লিকে সমর্থন করে নানা প্রশ্নে। যেমন কাশ্মীরের উপর ভারতের অধিকার, বা গোয়ার উপরে পর্তুগালের নিয়ন্ত্রণের অবসান। সিকিয়োরিটি কাউন্সিলে ভারত-বিরোধী প্রস্তাবগুলি রুখে দেয় মস্কো। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভারতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও প্রথম ছিল সোভিয়েট ইউনিয়ন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ভারত অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও সামরিক সরঞ্জাম কেনা শুরু করে। ফ্রান্স, ইজ়রায়েল, আমেরিকার থেকে অস্ত্র কেনা অনেকগুণ বাড়ে। তবু আজও অস্ত্র আমদানির অর্ধেকই হয় রাশিয়া থেকে। গত কয়েক দশকে ভারত আমেরিকার কাছে এসেছে। অনেকে এখন আমেরিকাকেই ভারতের প্রধান কূটনৈতিক সঙ্গী মনে করেন। আমেরিকাতেও ভারতের সঙ্গে জোরালো সম্পর্কের প্রয়োজন বিষয়ে ঐকমত্য দেখা যাচ্ছে। হয়তো এশিয়ায় চিনের প্রভাব মোকাবিলাতেই আমেরিকা ঝুঁকেছে ভারতের দিকে।

আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়, এবং ভারত ‘কোয়াড’ জোটের (আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত) সদস্য হওয়ায় বেজিং-দিল্লির সঙ্গে মস্কো-দিল্লি সম্পর্কেও কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে। তাই রাশিয়া এখন এশিয়াতে অন্য জোটসঙ্গী খুঁজছে। গত কয়েক বছরে মস্কো-ইসলামাবাদ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অনেকটাই গতি এসেছে। প্রতিরক্ষা-সহ নানা বিষয়ে দু’টি দেশের সহযোগ দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর চিনেরও কিছুটা কাছে এসেছে রাশিয়া। চিন বরাবরই পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সঙ্গী। গত কয়েক মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফের পাকিস্তানকে কাছে টানছেন— রাজনৈতিক নেতা এবং সামরিক কর্তৃত্ব, উভয় পক্ষকেই। চিনের সঙ্গে সম্পর্কও নতুন ছাঁচে ঢালছেন, যাতে সহযোগিতা বাড়ে। এর ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে পুতিন আসছেন ভারতে। যৌথ উদ্যোগে নানা প্রকল্পের ঘোষণার পাশাপাশি, কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার চেষ্টা হবে। তবে সব দেশই এখন দরদস্তুরের ক্ষমতা বাড়াতে নতুন সম্পর্ক তৈরি করছে। তাই ভবিষ্যতে রাশিয়া-পাকিস্তান জোটকেও শক্তিশালী হয়ে উঠতে দেখা যেতে পারে, আশ্চর্য নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Diplomacy Trade Deal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy