মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া ‘ব্লটিং’ দিয়ে শুষে/ ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে!” এ রাজ্যের বিদ্যুৎ কোম্পানির ‘রেগুলেটরি অ্যাসেট’-এর কথা ভাবতে গিয়ে সুকুমার রায়ের ‘ছায়াবাজি’ মনে পড়ে যায়। ‘রেগুলেটরি অ্যাসেট’ অর্থাৎ কিনা নিয়ামক সংস্থার কাছে গচ্ছিত সম্পদ। কী ভাবে সৃষ্টি হয় এই সম্পদ, আর কেনই বা তা নিয়ে মাথা ঘামানো দরকার সাধারণ উপভোক্তার?
ভারতীয় বিদ্যুৎ আইন (২০০৩) অনুযায়ী একটি বিদ্যুৎ সংস্থা (উৎপাদনকারী, সংবহনকারী, বণ্টনকারী) কী দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করবে, তা স্থির করে বিদ্যুৎ নিয়ামক সংস্থা (ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশন)। সাধারণত এই সংস্থাকে বলা হয় ‘রেগুলেটর’। নিয়ম হল, বিদ্যুৎ সংস্থাটি আর্থিক বছর শুরু হওয়ার আগে রেগুলেটরকে কয়েকটি তথ্য দেবে। যেমন, বছরভর খরচ, ক্রেতার কাছ থেকে আদায়যোগ্য বছরভর খরচ ও লাভের (রিটার্ন অন একুইটি) ভিত্তিতে লাভের পরিমাণ কী থাকা প্রয়োজন, তার একটা হিসাব। সেই অনুসারে বিদ্যুতের দাম ধার্য করে, তা মঞ্জুর করার আবেদন করে বিদ্যুৎ সংস্থা। রেগুলেটর সেই হিসাবের মূল্যায়ন করে সেই বছরের জন্য এক ইউনিট বিদ্যুতের দাম স্থির করে দেয়।
বছর-শেষে প্রায়ই দেখা যায়, যে সব সংখ্যার ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম স্থির হয়েছিল, বাস্তবে তা বদলে গিয়েছে। তখন আবার রেগুলেটরের কাছে ফিরে পরিবর্তিত সংখ্যার ভিত্তিতে মূল্যায়নের আবেদন করতে হয়। রেগুলেটর তার ভিত্তিতে বিদ্যুতের দামের পুনর্মূল্যায়ন করে। একে বলে ‘ট্রুয়িং আপ’— বাস্তবের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত দামের সামঞ্জস্য করা। ধরা যাক, একটি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা আবেদন করল যে, লাভ-সহ খরচ ধরলে ইউনিট-প্রতি দাম হতে হবে ১০ টাকা। রেগুলেটর জানাল যে ৭ টাকা ১২ পয়সাই যথেষ্ট হবে। বছর-শেষে সংস্থাটি রেগুলেটরকে দেখাল, প্রকৃত খরচ দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা। রেগুলেটর পুনর্মূল্যায়ন করে দেখল যে ন্যায্য খরচ দাঁড়াচ্ছে ৯ টাকা। তা হলে ক্রেতার কাছ থেকে সংস্থাটির প্রাপ্য দাঁড়াল ইউনিট-প্রতি অতিরিক্ত ১ টাকা ৮৮ পয়সা।
কিন্তু এই অতিরিক্ত অর্থ তখনই আদায় করার অনুমতি সাধারণত রেগুলেটর দেয় না, কারণ এক ইউনিটের দাম এক লাফে প্রায় ২ টাকা বাড়লে ক্রেতার মস্ত ধাক্কা লাগবে। রেগুলেটর নির্দেশ দেয় যে এই টাকা পরবর্তী বছরগুলিতে দাম স্থির করার সময় ধাপে ধাপে আদায় করতে দেওয়া হবে। যত দিন তা না হয়, ওই টাকা রেগুলেটরের কাছে গচ্ছিত থাকবে। বিক্রেতা তা পাবে না,ক্রেতার কাছে আদায়ও করতে পারবে না। এই গচ্ছিত টাকাই হল ‘রেগুলেটরি অ্যাসেট’— টাকার ‘মিষ্টি ছায়া’। তার নাগাল পায় না বিদ্যুৎ কোম্পানি।
এই ছায়া-সম্পদের পরিমাণ ক্রমশ বেড়ে চলেছে, কারণ পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা এলাকায় ২০১৬-১৭ থেকে বিদ্যুতের গড় দাম বৃদ্ধি পায়নি। যদিও বিদ্যুতের দাম স্থির করার দায়িত্ব রেগুলেটরের, কিন্তু সরকারের ছায়া রেগুলেটরের উপরে সদা প্রকট। উপরন্তু, বিদ্যুৎ আইনের ১০৮ ধারা অনুযায়ী সরকার জনস্বার্থ রক্ষায় কোনও নির্দেশ দিলে রেগুলেটর তা মানতে বাধ্য। অথচ, বিদ্যুৎ সরবরাহের খরচ বেড়েই চলেছে। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার কেবল ২০২২-২৩ বছরের রেগুলেটরি অ্যাসেটের পরিমাণ প্রায় ৩,৫০০ কোটি টাকা। সরবরাহের খরচ বা ‘ক্যারিং কস্ট’ ধরলে আরও ১,৫০০ কোটি টাকা।
আগামী বছর বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের সময়ে আর ‘যথা পূর্বং’ ভাবটি চলবে না। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে যে, এখন থেকে কোনও ‘রেগুলেটরি অ্যাসেট’ সৃষ্টি হলে তিন বছরের মধ্যে আদায় করার অনুমতি দিতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে জমে থাকা সমস্ত অ্যাসেট ২০২৮-এর ৩১ মার্চের মধ্যে আদায় করতে দিতে হবে। খরচ ও লাভ বাবদ অনুমোদিত অর্থের ৩ শতাংশের বেশি রেগুলেটরি অ্যাসেট সৃষ্টি করা যাবে না। দিল্লির তিনটি বিদ্যুৎ সংস্থার আবেদনের প্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতের এই মামলায় বিভিন্ন রাজ্যের বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে যে, দিল্লি বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাগুলির গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ২৭,০০০ কোটি টাকা। সুপ্রিম কোর্ট একে বলেছে ‘রেগুলেটরি ফেলিয়র’— নিয়ামকের ব্যর্থতা। আইন করে বিদ্যুতের দাম ধার্য করার দায়িত্ব সরকারের হাত থেকে নিয়ে রেগুলেটরের হাতে দিলেও বাস্তবে তা কোনও ফল দেয়নি।
শুধু দাম বাড়িয়ে এই বিপুল বকেয়া আদায় করা অসম্ভব, অতএব সরকারি ভর্তুকিই ভরসা হতে চলেছে। এত দিনের অভিজ্ঞতা বলে, যত দিন না বিদ্যুৎ আইনে ‘রেগুলেটরি অ্যাসেট’ আদায়ের প্রণালী নির্দিষ্ট করে একটি ধারা যুক্ত হচ্ছে, আর তার রূপায়ণের ক্ষেত্রে ১০৮ ধারাকে নিষ্ক্রিয় করা হচ্ছে, তত দিন সমাধান অধরাই থাকবে। ২০২৬-এ বিধানসভা নির্বাচনের আগে রেগুলেটর বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চাইবে না। কিন্তু নির্বাচনের পরে কী হবে? এত দিন যে টাকা বকেয়া থেকে গিয়েছে, তা শোধ করতে চাইলে বিদ্যুৎ গ্রাহকের প্রদেয় টাকার পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? যদি গ্রাহক মনে করেন, ‘কেন বাড়তি টাকা দেব?’ তা হলে এক দিন দিল্লি বা তামিলনাড়ুর বিপুল বকেয়ার কাছাকাছি পৌঁছে যাব আমরা। বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার অস্তিত্ব সঙ্কট আরও বাড়বে, যার পরিণাম আখেরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ক্রেতাকেই ভুগতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)