আর্নস্ট হেমিংওয়ের দ্য সান অলসো রাইজ়েস-এ একটি চরিত্রকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সে দেউলিয়া হল কী ভাবে। উত্তরে ব্যক্তিটি জানায় ‘প্রথম দিকে ধীরে ধীরে, তার পর একদম আচমকা।’ আন্তর্জাতিক পরিসরে নয়া সাম্রাজ্যবাদের পদসঞ্চার বিষয়েও সম্ভবত এ কথাটাই প্রযোজ্য।
আমেরিকায় ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় আগমনের পর কয়েকটা সপ্তাহ সব কিছু ঢিমে তালে চলছিল। বিভিন্ন দেশের পারম্পরিক সম্পর্ক আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে মোটামুটি গতানুগতিক ভাবেই বজায় ছিল। তার পরই ঘটল বড় পরিবর্তন।
তিন বছর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র রাশিয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে প্রদত্ত নীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে আর এক সদস্য রাষ্ট্র ইউক্রেনের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। তখনই যে তিনটি মূল নীতির উপর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিতটা দাঁড়িয়ে আছে বলে আমরা জানতাম, সেটা কতটা নড়বড়ে, বোঝা যায়। নীতিগুলি হল: ১) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাসমূহের মাধ্যমে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক সংহতি; ২) প্রতিটি রাষ্ট্রই সার্বভৌম, এই নীতির আশ্রয়ে গড়ে ওঠা যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা; এবং ৩) জাতিগত আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার। যে মুহূর্তে ট্রাম্পের আমেরিকা ইউক্রেনকে সমর্থনের পরিবর্তে রাশিয়ার সুরে কথা বলল, বোঝা গেল, আন্তর্জাতিক বিন্যাস বহালের এই পরিচিত নীতি বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আবহে একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমেরিকা, ব্রিটেন আর সোভিয়েট ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক শান্তি বজায় রাখার জন্য এবং সকল দেশের সম সার্বভৌমত্বের নীতি মেনে বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন নির্মাণের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছয়। লম্বা-চওড়া আদর্শের বুলির আড়ালে তখন লুকিয়ে ছিল দেশগুলির নিজ নিজ স্বার্থ। প্রস্তাবিত নীতি মেনে চললে নিজেদের স্বার্থে আঘাত আসবে না, এই ছিল হিসেব। ১৯৪৩-এ হল তেহরান সম্মেলন, যোগ দিলেন চার্চিল, রুজ়ভেল্ট ও স্তালিন। ঠিক হল, বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্য চারটি পাহারাদার ‘পুলিশ’ মোতায়েন করবে। এই পুলিশ চতুষ্টয় হল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও চিন। ব্রিটেন তখনও বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিভূরূপে স্বীকৃত। আর চিন ও সোভিয়েট ইউনিয়নকে সে-দিন দরকার ছিল আন্তর্জাতিক পরিসরে জাপানকে ঠেকানোর জন্য। ১৯৪৫-এর ইয়ল্টা সম্মেলনে উল্লিখিত শীর্ষ চতুষ্টয়ের সঙ্গে যোগ হল আরও একটি দেশ, ফ্রান্স। নাৎসি জার্মানি কর্তৃক অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে খবরদারি বজায় রাখার জন্য তাকে নেওয়া হয়।
বাস্তবে ইয়ল্টা সম্মেলনের পর পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েট ইউনিয়নের দাপট প্রতিষ্ঠিত হল আর ইউরোপের বাদবাকি অংশে যুক্তরাজ্য ও আমেরিকা নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করল। স্তালিন জাপানের বিরুদ্ধে লড়াইতে মিত্র শক্তিকে সহায়তা করেছিলেন। তারই পুরস্কার হিসেবে এই বন্দোবস্ত।
তার মানে, শুরু থেকেই এই বন্দোবস্ত ত্রুটিশূন্য ছিল না। তবে অনেকাংশে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা নিয়ন্ত্রিতও হত। আরও বড় কথা, বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলিকে বেপরোয়া হয়ে ওঠা থেকে আটকাতে অনেকাংশে সফল হয়েছিল ওই বন্দোবস্ত। এই বন্দোবস্তের মূলে ক্রিয়াশীল ছিল সার্বভৌমত্বের ধারণা। ক্রমে এই পরিসরে ঢুকে পড়ে জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।
কিছু দিন আগে পর্যন্ত ছবিটা এই রকম ছিল। কিন্তু ট্রাম্প দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে সেই ছবির উপর বুলডোজ়ার চালিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক চুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে আমেরিকাকে প্যারিস চুক্তি থেকে বার করে এনেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সরে এসেছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমেরিকার সদস্য পদ বহাল রাখা কতটা যৌক্তিক, তার পুনর্মূল্যায়ন চলছে। একতরফা ভাবে আমেরিকার শুল্ক চাপানোর অনিবার্য ফলস্বরূপ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিসরেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রাতারাতি রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য-রাষ্ট্রের আচরণই বদলে গিয়েছে। আমেরিকা নিজেদের প্রভাব ও সীমান্ত বাড়ানোর জন্য জাতীয়তাবাদী বিদেশনীতি গ্রহণ করেছে। উদ্দেশ্য, আপন গোলার্ধে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দাপট বৃদ্ধি।
সবচেয়ে নাটকীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল ট্রাম্প-পুতিন বন্ধুত্বের পুনর্নবীকরণ। তারই ফল, কিভ-কে আলোচনার টেবিল থেকে দূরে সরিয়ে ইউক্রেনে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা। কিংবা জ়েলেনস্কিকে সরাসরি একনায়কতন্ত্রী হিসেবে দেগে দেওয়া। রাশিয়ার দাবি একতরফা ভাবে মেনে নিয়ে ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ‘নেটো’র সামরিক বাহিনীকে ইউক্রেনে না-পাঠানোর সিদ্ধান্ত। গোটা ইউরোপ স্তম্ভিত। এমনিতেই কয়েক দশক ধরে ‘নেটো’র ভিতরে আমেরিকার দাপটে অতিষ্ঠ ইউরোপ। এখন তারা সন্ত্রস্ত নিজেদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে।
আমেরিকা বিশ্বমঞ্চ থেকে সরে গিয়ে আধিপত্য ছড়ানোর বার্তা দিচ্ছে। ট্রাম্প পারলে গ্রিনল্যান্ড, কানাডা, পানামা খাল, এমনকি গাজ়ার দখলও কালকেই নিয়ে নেবেন, এমন ভাব দেখাচ্ছেন। বার্তাটা দেওয়া হচ্ছে এমন ভাবে যাতে তার মধ্যে বাজে নয়া সাম্রাজ্যবাদের দামামা।
সমগ্র বিশ্ব এখন প্রভাবশালীদের অধীন বলয়ে বিভাজিত। আমেরিকা আপন গোলার্ধে তো বটেই, পশ্চিম এশিয়াতেও ক্ষমতা বিস্তারে আগ্রহী। ট্রাম্প বুঝিয়ে দিয়েছেন ইউরোপকে তিনি রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। ইউক্রেন ও গোটা ইউরোপে পুতিন নিজ পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ করতে পারেন, আমেরিকা নাক গলাবে না, সেটা বোঝা যাচ্ছে।
পড়ে থাকল চিন। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানে সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে বেজিংও তাইওয়ান নিয়ে উৎসাহী। এত দিন আমেরিকাই বাধা ছিল। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার সামরিক নিরাপত্তা অচিরেই অপসৃত হবে, এই প্রত্যাশায় চিনের বাঁধভাঙা উৎসাহ। তাইওয়ানের উপর নিজেদের দাবি জোরালো ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই তো সময়।
এই প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা ভারতকেও মনে রাখতে হবে। চিন কিন্তু কোনও দিনই ম্যাকমোহন লাইনকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলত, ভারত আরও নিরাপত্তাহীনতার গর্তে ঢুকে পড়ছে। আলো ক্রমে কমে আসিতেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সিকিম মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয়
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)