E-Paper

সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে বলে

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ দ্রুত হওয়ার বদলে শ্লথ হচ্ছে। ভারতের মতো দেশ এক বছরের মধ্যে ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন’-এ দশম থেকে ২৩তম স্থানে নেমেছে, যদিও সরকারি বিবৃতিতে সাফল্যের ছড়াছড়ি।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০২৫ ০৬:৩৯

বেলেম শহরে অ্যামাজ়ন অরণ্যের গা ছোঁয়া ঠিকানায় চোদ্দো-পনেরো বছরের ভিটোরিয়া বা জোসের মনে কোনও দ্বিধাই নেই যে, ক্রমাগত বৃষ্টিঅরণ্য ধ্বংস করাই এ অঞ্চলের একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ। ঠিক যে ভাবে গোসাবা বা মৌসুনি দ্বীপের প্রমিত বা সুনীতারা নিঃসন্দেহ যে, প্রতিনিয়ত বাদাবন বিপন্ন না হলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব এত দ্রুত প্রশ্নের মুখে পড়ত না। সমস্যা হল, অ্যামাজ়ন থেকে সুন্দরবন অবধি স্কুলপড়ুয়ারা যা জানে, দেশ-বিদেশের রাজনীতিকরা তা জেনেও না-জানার ভান করেন ব্যবসায়িক স্বার্থের দিকে তাকিয়ে।

ব্রাজ়িলের উত্তর-পূর্বে, অতলান্তিকের পাড়ে অবস্থিত বেলেম শহরে চলা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এখনও অবধি এই প্রবণতার বিশেষ অন্যথা দেখা যাচ্ছে না— গত ১৫টি বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের পুনরাবৃত্তিই চলছে। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলি উন্নত দেশগুলোর কাছে বার বার যথাযথ আর্থিক সহায়তা চাইছে বিশ্বকে জলবায়ু অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্বকে মনে করিয়ে, আর উন্নত দেশগুলি ক্রমেই সে দাবিসনদের সামনে অজুহাতের দেওয়াল তুলে দিচ্ছে, জলবায়ু কর্মীরা নানান রকম প্রতিবাদ করছেন; আর, রাষ্ট্রপুঞ্জ সবাইকে নিয়ে চলার একটা দুর্বল ও নিষ্ফল চেষ্টা চালাচ্ছে। আর তারই মধ্যে বিভিন্ন দেশের নেতারা নিজেদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করে নিচ্ছেন, পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করে।

কিন্তু এই ফর্মুলা গত কয়েক বছর ধরে কিছুটা হলেও ভাঙতে চলেছে, কেননা বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতারা, সম্মেলনের মধ্যে এবং বাইরে, প্রবল চাপের মধ্যে পড়েছেন। ভারতও ব্যতিক্রম নয়। এ বারে আরও বেশি। একের পর এক বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট স্পষ্ট দেখাচ্ছে যে, দুনিয়া যে ভাবে চলছে, সে ভাবেই চলতে থাকলে আর বছর চারেকের মধ্যে পৃথিবীর ছাদের উপরে গ্রিনহাউস গ্যাস জমা রাখার আলমারিটা ভর্তি হয়ে যাবে, এবং স্থায়ী ভাবে প্রাক্‌-শিল্পোন্নয়ন যুগের তুলনায় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রথমে দেড় ডিগ্রি, তার পর দুই ডিগ্রি পেরিয়ে তিন ডিগ্রির দিকে এগোবে। সম্মেলনের আলোচনা মঞ্চেও স্পষ্ট বলা হচ্ছে যে, দেড় ডিগ্রির কাছাকাছি যাওয়ার কারণেই যেখানে পৃথিবী নিয়ম করে দুর্যোগের সামনে পড়ছে, সেখানে দু’ডিগ্রি পেরোলে প্রলয় আসন্ন। এক দিকে যখন জলবায়ু বাজার নিয়ে আলোচনা বাড়ছে; অন্য দিকে তখন পৃথিবীর আবহাওয়ায় উষ্ণতা সৃষ্টিকারী কার্বন ডাইঅক্সাইড বা মিথেনের পরিমাণও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, বাড়ছে সাধারণ মানুষের দুর্দশা।

দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ দ্রুত হওয়ার বদলে শ্লথ হচ্ছে। ভারতের মতো দেশ এক বছরের মধ্যে ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন’-এ দশম থেকে ২৩তম স্থানে নেমেছে, যদিও সরকারি বিবৃতিতে সাফল্যের ছড়াছড়ি। এই তালিকায় ৬৭টি দেশের মধ্যে সৌদি আরব একেবারে শেষে, আমেরিকা ৬৫তম স্থানে, তার এক ধাপ আগে রাশিয়া। চিন ৫৪ নম্বরে। স্পষ্টতই ভাবের ঘরে প্রবল চুরি চলছে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে যাঁরা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ছেন, তাঁদের দাবি: বিশ্ব জুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানি কী ভাবে বন্ধ হবে, তার রূপরেখা যত দ্রুত সম্ভব ঠিক করতে হবে; উন্নয়নের নামে জমি দখল করে তেল উত্তোলন করা চলবে না; শুধু মুনাফার জন্য প্রকৃতিকে বরবাদ করে চলবে না, যত্রতত্র গাছ কাটাও চলবে না। এমন প্রতিবাদ জানাতেই হাজারখানেক মানুষ সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন প্রায় দরজা ভেঙে সম্মেলন স্থলে ঢুকে পড়েন, তার পর প্রথম সপ্তাহে প্রায় আরও দু’টি বিশাল প্রতিবাদী জনসমাবেশের সাক্ষী হয়েছে বেলেম। প্রতিবাদ বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে নতুন কিছু নয়, কিন্তু এ বারের প্রতিবাদের ধরন আলাদা— বিশ্ব জুড়ে জেন জ়ি’দের আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে অনেককেই। তাই সম্মেলনের গোড়ায় যেখানে পুলিশের দেখা প্রায় পাওয়াই যায়নি, সেখানে এখন পদে পদে পুলিশ; আকাশে চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার।

পাশাপাশি চাপ বাড়াচ্ছে স্বল্পোন্নত এবং বিপন্ন দেশগুলি। তার ফলাফল গত কয়েক বছর ধরেই কম-বেশি বোঝা যাচ্ছে। শর্ম এল শেখ-এ আনুষ্ঠানিক তালিকায় না থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণের বিষয়টিকে মানতে হয়েছে প্রথম বিশ্বকে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে আমাদের সুন্দরবনের বা উত্তরবঙ্গের ভবিষ্যতের উপরে; প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য হলেও দশ হাজার কোটি ডলারের বাৎসরিক সাহায্যকে ত্রিশ হাজার কোটি করতে হয়েছে গত বছর বাকু-তে।

এ বারের সম্মেলনেও প্রত্যাশা যে, অ্যাডাপ্টেশন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কৌশলের ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য— যার সঙ্গে ভারত-সহ বহু উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশের প্রয়োজন জড়িয়ে আছে— কিছুটা হলেও বাড়বে; জীবাশ্ম জ্বালানিকেন্দ্রিক জীবিকাভিত্তিক জীবন থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে; এবং জীবাশ্ম জ্বালানি কম বা বন্ধ করার রাস্তার সর্বসম্মত দিক-নির্দেশ মিলবে। থাকবে স্বাস্থ্যের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি যোগসূত্রের কথা এবং তাকে সামলানোর উপায়। এই দরাদরিতে ভূ-রাজনীতির ভূমিকা নিশ্চয়ই থাকবে— কিন্তু স্পষ্টতই জলবায়ু রাজনীতির লড়াইটা আর একবগ্গা নয়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্ব ক্রমেই লড়াই জোরদার করছে প্রথম বিশ্বের বিরুদ্ধে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Climate Change Weather Environment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy