E-Paper

রুপোর উপর সোনার জল

সে অলিখিত চুক্তি করেছে জীবনের সঙ্গে: এই ক’টা দিন সব ব্যক্তিগতের মুখে কুলুপ এঁটে, তোরঙ্গ থেকে সমষ্টিসুখের পঞ্চপ্রদীপ বার করে আচ্ছাসে ঘষবে পারিবারিকতার মাজন দিয়ে!

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:২৬
গতানুগতিক: পুজো শেষ, সবাই যে যার জীবনে ফিরে গেছে যখন।

গতানুগতিক: পুজো শেষ, সবাই যে যার জীবনে ফিরে গেছে যখন। উৎসব ছবির দৃশ্য।

সিকি শতাব্দী বয়স হয়ে গেল ছবিটার, বিশ্বাস হয়? ঋতুপর্ণ ঘোষের উৎসব। ২০০০ সালে মুক্তি পেয়েছিল— যদিও পুজোর সময় নয়। তা হোক, পুরো ছবিটাই ছিল দুর্গাপুজোর কয়েকটা দিনে একটা বাড়ি, একটা পরিবারকে নিয়ে। যে বাড়ি ঘিরে একটা অনিশ্চয়তার মেঘ ঘনিয়েছে: কলকাতা থেকে যতই দূরে হোক, সে বাড়ি হয়তো আর রাখা যাবে না। যে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যেরই জীবনেও কোনও না কোনও অনিশ্চয়তা। অপ্রেম। অবিশ্বাস। সেই সব কিছু দূরে ঠেলে, কিংবা বলা ভাল ঠেলতে চেয়ে, তারা জড়ো হয়েছে এই বাড়িতে— দুর্গাপুজোকে ঘিরে, পুজোর সময়। এই ক’টা দিনের উৎসবমুখরতা আর পারিবারিকতার মোড়কে ভুলতে চাইছে বাকি বছরভর জীবন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অপ্রাপ্তি আর প্রত্যাখ্যানকে।

বাংলা ভাষা আর বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে যুগপৎ বোলচাল ও দোলাচলের এই সময়ে, এবং অর্থ শিল্পকলা বিনোদন প্রভৃতির নিক্তিতে বাঙালির সবচেয়ে বড় ‘উৎসব’টি শেষ হওয়ার বিষাদলগ্নে, বাঙালি পরিবারতন্ত্রের দর্পণে এক বার উৎসবের মুখটি দেখে নেওয়া যেতে পারে। ঋতুপর্ণ তাঁর ছবিতে যে পারিবারিকতা দেখিয়েছিলেন তার অবশ্য একটি বিশেষ শ্রেণিপরিচয় আছে; তা একান্ত ভাবেই শহুরে হিন্দু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পারিবারিকতা। এবং তা একটা বিশেষ সময়েরও: নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায়। তখনও চলভাষ আসেনি, বাড়িতে একটা সাবেক ডায়াল-ঘোরানো ফোন আছে কিন্তু লাইন প্রায়শই নষ্ট থাকে, নব্বই দশকের বিনোদন-পরাকাষ্ঠা ভিসিআর তখনও ডাইনোসর হয়ে যায়নি। কিন্তু গোলকায়নের নানাবিধ ঢেউ ধাক্কা দিতে শুরু করেছে মধ্যবিত্ত বাঙালিয়ানায়: বাড়ির বড় মেয়ে পারুলের ছেলে জয় আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছে অচিরেই, বড় ছেলে অসিতের মেয়ে শম্পা এফএম-এ গান গাইছে— এ সব যেমন আছে, তারই পাশাপাশি মাথাচাড়া দিচ্ছে গ্রামীণ পৈতৃক বাড়ি আগলে রাখতে না পারার শহুরে অসহায়তা, বা বলা ভাল আগলে রাখতে না চাওয়ার লুকোনো দ্বিচারিতা।

বাড়ি মানে স্মৃতি। বাঙালির পরিবারতন্ত্রে দুইয়েরই অমোঘ টান। তদুপরি এ বাড়িতে থাকেন বাঙালির সবচেয়ে বড় টান— মা (যাঁর নামটি আবার ভগবতী, লক্ষণীয়)। তাঁর ছেলেমেয়েরা (তারাও সংখ্যায় চার জন, দুই ছেলে দুই মেয়ে, আমাদের নজর এড়ায় না) নগরবাসী হলেও বচ্ছরকার দুর্গাপুজো ঘিরে বাড়ি আসা, মায়ের কাছে আসা হয় তাদের। পুজো এবং মা, প্রয়োজন ও প্রিয়জন এখানে একদেহ: ‘ঘরে ফেরা’টা তাই এখানে তাগিদ। আবার দায়ও নয় কি? সন্ততিদের শহরমুখী জীবনে এই গৃহ রক্ষা হয়ে পড়েছে হাতি পোষার মতো, তাই দুর্গাপুজোর নেপথ্যেই হয়ে চলে বাড়ি বিক্রির কথা, তার টাকাটা মা আর চার সন্তানের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারার হিসাব। মা কি ছেলেমেয়েদের কাছে পালা করে থাকবেন, নাকি একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া যায় কলকাতায়, এই সব ভাবনা। বাড়ি বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে যায় ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত স্বার্থও: বড় মেয়ের অতীতের প্রেমসম্পর্ক মুছে ফেলার প্রাণপণ প্রয়াস, মেজ ছেলের চাকরি বাঁচানোর বিকল্প সন্ধান, অসুখী দাম্পত্যের শিকার ছোট মেয়ের অসহায় ভাঙন— ডিভোর্স হলে তাকে তো এখানেই ফিরতে হবে, এই ঠিকানাতেই!

আর এই সবই হয় দুর্গাপুজোর আবহে, ঠিক পুজোর দিনগুলোতেই। এ একটা বিরাট অস্বস্তি: অতীতের কলঙ্কভয়, বর্তমানের অভিমান, ঝগড়া আর সন্দেহ, ভবিষ্যতের অনিশ্চিতির মুখোমুখি কে হতে চায় পুজোর সময়, তাও আবার নিজের বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে? পুজো মানে গোটা পরিবারের পুনর্মিলনে আনন্দ-উৎসব, কে তার মধ্যে বাড়ি বিক্রি, বিবাহবিচ্ছেদ, সাংসারিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির তোরঙ্গ খুলে বসে? ও সব তো বাকি বছর জুড়ে চলছে চলবে, এই ক’টা দিন কি তাদের ঢাকের বাদ্যিতে ঢাকাচাপা দেওয়া যায় না? অতিথি আসার আগে চটজলদি খাটের নীচে ঢুকিয়ে দিতে পারি বিকল বেমেরামত যা-কিছু, পুজোর এই ক’টা দিন কি ‘সুখী পরিবার’-এর মুখোশ সেঁটে রাখতে পারি না?

খুব ভুল হবে কি, যদি বলা যায়— বাঙালি মধ্যবিত্তের পরিবারতন্ত্র এই কাজটিই করে আসছে উৎসবের নেপথ্যে, নিয়মিত? সে এক রকমের অলিখিত চুক্তি করেছে জীবনের সঙ্গে: বচ্ছরকার এই ক’টা দিন সব ব্যক্তিগতের মুখে কুলুপ এঁটে, তোরঙ্গ থেকে সমষ্টিসুখের পঞ্চপ্রদীপ বার করে আচ্ছাসে ঘষবে পারিবারিকতার মাজন দিয়ে! এই কারণেই কি হরেদরে বাংলা ছবিতে দুর্গাপুজো মানে শুধু হাসিখেলা, প্রমোদের মেলা? একচালার দুর্গাপ্রতিমা যে ঘনীভূত পারিবারিকতার রূপক-এ তার সামনে হাজির হয়, তার যথাসাধ্য রোম্যান্টিক প্রতিরূপটি ঘরে ও বাইরে ফুটিয়ে তোলার মরিয়া চেষ্টাই কি বাঙালির প্রাণপণ সাধনা?

দুর্গাপুজো ও উৎসবের সঙ্গে ঘরের মেয়ের (তথা সন্তানসন্ততির) ঘরে ফেরা, মায়ের কাছে ফেরা-র মতো যে নিয্যস পারিবারিক ধারণাগুলি জড়িয়ে, সে তো বাঙালির একান্ত নিজস্ব। ভারত যেখানে নবরাত্রির ব্রত-উপবাস করে নিতান্ত ধর্মীয় পুণ্যের লোভে, বাংলা সেখানে দুর্গাপুজোর সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছে সমাজবাস্তবতাকে: উমা-গৌরী-দুর্গার আয়নায় দূরদেশে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ের মলিন মুখ, মহেশ্বরের ব্যাজস্তুতিতে নিষ্কর্মা নেশাখোর জামাইয়ের জন্য আক্ষেপকে। শ্বশুরঘরে রোজ অত্যাচারিত, অসুখী দাম্পত্যে জর্জর মেয়ের সংখ্যা একুশ শতকের আড়াই দশক পেরিয়ে বেড়েছে বই কমেনি, কিন্তু দুর্গাপুজো ঘিরে বাঙালির পরিবারতান্ত্রিক রোম্যান্টিকতা কমল কই! ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর ছবিতে এই রোম্যান্টিকতা ভাঙার এক রকম চেষ্টা করেছিলেন; দেখিয়েছিলেন, উৎসবের দেখনদারির আড়ালে কত রকম অবাধ্য ও নিষিদ্ধ গোপনেরা জেগে থাকে: চাকরি হারানোর ভয়, বিবাহবিচ্ছেদের শঙ্কা, একদা যাকে পদাঘাতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল আজ সপরিবার তারই পদানত হওয়ার অসম্মান। থাকে মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোনের অজাচারের গন্ধমাখা প্রেমও।

কিন্তু এ সব তো কদাচ মুখে আনার নয়— বিশেষত পুজোর দিনগুলোয়। পুজোর দিন কাঁদতে নেই, পুজোয় শুধু হাসিমুখ। ওই ক’টা দিন শুধু ঢেকে রাখা, চেপে থাকা— অন্তত সুখী পরিবারের বহিরঙ্গটুকু যাতে বজায় থাকে। উৎসব ছবিতে এই চেষ্টাটা যে খুব প্রকট তা নয়, কারণ সেখানে ভগবতী ও তাঁর ছেলেমেয়েরা ছাড়া ‘বাইরের লোক’দের বড় একটা দেখা মেলে না। এই মানুষগুলো নিজেদের কাছেই নিজেদের লুকোতে চায়— সে আরও মারাত্মক। বাড়ির ছেলে তার স্ত্রীর কাছেও মুখ ফুটে বলতে পারে না যে গত দু’মাস তার মাইনে হচ্ছে না। বাড়ির বৌ গাদাগুচ্ছের গয়নার বাক্স সুটকেস থেকে নামিয়ে সাজতে বসার আগে স্বামীকে শুনিয়ে রাখে এই সবই আসলে রুপোর উপরে সোনার জল করা, কিন্তু ‘তুমি আবার বলে বেড়িয়ো না সবাইকে!’ হ্যান্ডিক্যাম হাতে যে ছেলেটি গোটা পরিবারকে ধরে রাখতে চায় এক সঙ্গে, এক ফ্রেমে, পুজোবাড়ির নিভৃতিতে তুতো বোনের কাছে সে-ই কবুল করে নিজের বাবা-মায়ের দাম্পত্যসম্পর্কের কথা— পদে পদে সন্দেহ, ঘৃণা, হিংসায় জড়ানো যা।

পঁচিশ বছর মানে তো একটা প্রজন্ম। আজ প্রজন্মান্তরের এক দুর্গাপুজোর সদ্য-অবসানে এ ছবি ফিরে দেখলে, বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারতন্ত্রের খুব কিছু আলাদা ছবি ফুটে উঠবে কি? শহর আরও গ্রাস করেছে গ্রামকে, ‘স্মার্ট’ প্রযুক্তির যুগে পুরনো ভিসিআর হ্যান্ডিক্যাম ল্যান্ডফোনেরা জবাব দিয়েছে, পড়াশোনা করতে আর কেরিয়ার গড়তে নতুন প্রজন্ম হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে অনেক বেশি চৌকস এবং বিদেশমুখী— পুজোর সময় আর ‘ঘরে ফেরা’ হয়ে উঠছে না অগণিতের। গ্রামে-মফস্‌সলে তো পরের কথা, মহানগরেই বহু পরিবারে সাবেক বিরাট বাড়ি পড়ছে অস্তিত্ব সঙ্কটে, কান পাতলে শোনা যাবে অবাঙালি প্রভাব ও অর্থক্ষমতার সামনে বাঙালি অসহায়তার আত্মসমর্পণের পাঁচালি। বাড়ির দুর্গাপুজো তো সেখানে বোঝার উপর শাকের আঁটি!

বেশির ভাগ সিনেমাই শেষ পর্যন্ত ঘা-খাওয়া মানুষকে জিতিয়ে দেয়। এ ছবিতেও আমরা দেখি পরিচালকের কিছু কিছু ইচ্ছাপূরণ: কারও বিয়েটা টিকে যায়— আপাতত। কারও অফিসের ঝামেলা মিটে যায়— আপাতত। বাড়িটাও এখনই বিক্রি হয়ে যায় না, পরের বছর পুজোটা হওয়ার একটা সম্ভাবনা জিইয়ে থাকে। কেউ কেউ বিদেশে চলে যায়, ছিটকিনি-তোলা বেডরুমে উদ্যত হিংস্র হাত আর চাপা কান্না অব্যাহত থাকে কারও। আর পুজো শেষে শহরের সবাই শহরে ফিরে গেলে, ভগবতী বসে থাকেন বিরাট বারান্দায় ইজ়িচেয়ারে, একা। মৃন্ময়ীর চিন্ময়ীরূপে ফিরে যাওয়ার তবু অবকাশ আছে, তিনি এই শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে যাবেন কোথায়! কিংবা অচিরেই যাবেনও হয়তো, কলকাতার ফ্ল্যাটে পালা করে থাকবেন তাঁর ছেলেমেয়েদের কাছে— যেমন পুজোর সময় পালা পড়ে পরিবারগুলোর!

মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারতন্ত্র, মেজো বৌয়ের ওই গয়নার মতোই। বাক্স-ভরা সোনা, আসলে বেশির ভাগটাই রুপোর উপর সোনার জল। পাছে কেউ তা বুঝে ফেলে, কী যে ভয় এই পুজোর সময়!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengali film festival

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy