Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বাহুবল?
BJP

সদ্যসমাপ্ত সংসদ অধিবেশন দেখল দায়বোধ-বিরহিত সরকারকে

প্রথমে একটি ইতিবাচক দিকের কথায় আসি। অনেক দিন পর দেখা গেল প্ৰকৃত বিরোধী দলগুলি কী ভাবে একজোটে কাজ করছে।

জহর সরকার
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২১ ০৬:১৫
Share: Save:

বিগত সংসদের অধিবেশন পূর্বঘোষিত সমাপ্তির আগেই মুলতুবি করে সরকার যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। এই চার সপ্তাহে বোঝা গেল, এই সরকার অসহিষ্ণুতা ছাড়া আর কোনও আচরণই বোঝে না। নরেন্দ্র মোদী যতই জনসমর্থন হারাচ্ছেন, ততই তাঁর অসহিষ্ণু স্বরূপ দেখাচ্ছেন। সদ্য প্রকাশিত একটি সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, তাঁর জনপ্রিয়তা গত এক বছরে ৬৬ শতাংশ থেকে এক ধাপে পড়ে গিয়েছে ২৪ শতাংশে। এ ছাড়াও অনেক ইঙ্গিত বলছে, মোদী ম্যাজিক কাজ করছে না। হয়তো সেই কারণেই, এই অধিবেশনে মোদী সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে, সংসদ বা গণতন্ত্র তাদের কাছে অর্থহীন। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও বাহুবল দেখিয়েই তারা রাজত্ব চালাবে।

প্রথমে একটি ইতিবাচক দিকের কথায় আসি। অনেক দিন পর দেখা গেল প্ৰকৃত বিরোধী দলগুলি কী ভাবে একজোটে কাজ করছে। বিরোধীদের এত ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছিল এই সরকার যে, প্রায় কেউই প্রধানমন্ত্রীর দাপটের সামনে মুখ খুলতে পারতেন না। তা ছাড়াও উনি অনেক কাল ধরে বিরোধী দলগুলির মধ্যে ফাটল ধরিয়ে এক বড় অংশকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন। এনডিএ বা জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটে তো ওড়িশার বিজু জনতা দল, তেলঙ্গানার টিআরএস, অন্ধ্রের ওয়াইএসআর কংগ্রেস, তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে আর বিহারের জেডিইউ-এর মতো দল শামিল হওয়াতে ৯৪ সদস্যের বিজেপি রাজ্যসভাতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিরোধীদের উপর বলপ্রয়োগ করে ছত্রভঙ্গ করা সত্ত্বেও এই অধিবেশনে কিন্তু এক নজরকাড়া দৃশ্য ফুটে উঠল। জাতীয় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বাম দল, অল ইন্ডিয়া ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, অকালি দল, শরদ পওয়ারের এনসিপি, শিবসেনা আর আম আদমি পার্টি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রদর্শন করতে শুরু করেছে, এই বারের অধিবেশন প্রমাণ।

অনেকেই মনে করছেন যে, বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে মানুষের রায় সাহস আর উৎসাহ জুগিয়েছে বিরোধী শক্তিকে। বিজেপিকে হারিয়ে তামিলনাড়ু ও কেরলের নির্বাচকেরা যতখানি নির্ভীকতা দেখিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ়তার পরিচয় প্রদর্শন করেছেন বাংলার জনগণ। পশ্চিমবঙ্গ জয় করার জন্যে মোদী একেবারে মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আর অমিত শাহ অতিমারি আর দেশ শাসনের দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে প্রায় ৪০ বার বাংলার মাটিতে পা ফেলেছিলেন। সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের জয় একদম সুনিশ্চিত। কিন্তু বাংলা প্রমাণ করেছে যে, এই বিশাল শক্তিমান, ধনী ও অপরাজেয় রাজনীতিকেও হারানো সম্ভব। তাই সংসদে এখন এ রাজ্যের স্থান অনেক উঁচুতে। অতএব ১৯ জুলাই রাজ্যসভার শুরুতেই যখন তৃণমূলের মুখ্য সচেতক সুখেন্দু শেখর রায় স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, পেগাসাস কেলেঙ্কারি এবং তার সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির আর কৃষকদের বিক্ষোভ নিয়ে আলোচনা না করলে তাঁরা অন্য কোনও বিষয় উত্থাপন করতে দেবেন না, সরকার পক্ষ ও বিপক্ষ উভয়ই খুব গুরুত্ব দিয়েছিল। আসনের দিক থেকে বিজেপি আর কংগ্রেসের ঠিক পরেই তৃণমূল কংগ্রেস, যদিও তাদের সংখ্যায় প্রচুর ফারাক। এই তিনটি দলের পর রাজ্যসভায় আর কোনও দল নেই, যাদের আসন দশের ধারেকাছে।

যে বিরোধী দলগুলি খানিক দ্বিধাগ্রস্ত ছিল তারাও এই আলটিমেটামের পর মোদীর আতঙ্ক কাটিয়ে উঠে একই সুরে প্রতিবাদ করা শুরু করল। সকলেই দাবি করলেন প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সভায় এসে বিবৃতি দিতে হবে। তাঁদের স্পষ্ট বলতে হবে দেশের নাগরিকদের মোবাইলে আড়ি পেতে শোনার জন্যে পেগাসাস-এর মতো ভয়ঙ্কর ও ব্যয়বহুল বিদেশি হ্যাকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন কি না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী এক বারও সংসদের কক্ষে প্রবেশ না করে দেখালেন তাঁর নজিরবিহীন ঔদ্ধত্য। তিনি মানতে চাইলেন না যে, একটি কুখ্যাত বিদেশি গুপ্তচর সংস্থার তৈরি পেগাসাস সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভারতের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিপন্ন করা হয়েছে। স্বাধীন ভারতে কোনও সরকার আজ অবধি এই মাপের কেলেঙ্কারি করেনি, কিন্তু মোদী সরকার তবু জবাবদিহিতে নারাজ। অন্য দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মূল্যবৃদ্ধি ও কৃষকদের ‘কালা কানুন’ নিয়েও আলোচনায় তৈরি নন মোদী ও তাঁর দল।

২০১৪-র জয়ের পর নরেন্দ্র মোদী টিভি আর অন্য ক্যামেরার দিকে চেয়ে অতিনাটকীয় ভঙ্গিতে যে সংসদের দ্বারে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিলেন, এখন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে, সেই সংসদকে তিনি কত কম তোয়াক্কা করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদে মোদীর উপস্থিতি এত কম যে, তা খুবই দৃষ্টিকটু। হিসেব করে দেখা যায় এক বছরে তিনি হাজির থেকেছেন কেবল ৩.৬ বার আর ছয় বছরে উপস্থিত হয়েছেন মাত্র ২২ বার। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ৬ বছরে বাজপেয়ী সংসদে উপস্থিত থেকে ভাষণ দিয়েছেন ৭৭ বার।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে বার বার ‘নির্বাক’ বলে বিদ্রুপ করলেও দেখা যায় যে, তিনি সংসদে কিন্তু মোদীর থেকে বেশি বাক্য ব্যয় করেছেন। মোদী কথা বলতে ভালবাসেন ও সাধারণ মানুষকে বাক্চাতুর্যে মন্ত্রমুগ্ধ করা তাঁর কাছে এক খেলা। অথচ, তিনি জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বাক্যালাপ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভাবে উদাসীন এবং কিছুটা যেন স্নায়ুচাপে পীড়িত থাকেন। এই অধিবেশনেও নরেন্দ্র মোদী সংসদ ভবনে এসেছিলেন, কিন্তু লোকসভা বা রাজ্যসভায় পা রাখেননি। কারণ, সম্ভবত কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর তাঁর কাছে ছিল না। আর তাঁর এই অবজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই সভার মার্শালদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হল সাংসদদের। প্রচুর সংখ্যায় স্বাস্থ্যবান মার্শাল ঢুকিয়ে দেওয়ার ফলে বয়োজ্যেষ্ঠ সাংসদদের প্রভূত ধাক্কাধাক্কি ও হেনস্থার সম্মুখীন হতে হল। তবুও কিন্তু বিরোধী সাংসদরা দমেননি, বিরোধিতা চালিয়ে গিয়েছেন।

অনেকে প্রশ্ন করছেন, বিরোধীদের এত প্রতিবাদের কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? এই ভাবে সভায় উচ্ছৃঙ্খলতা না করলেই নয়? আসলে, ভারতের মানুষ যখন তাঁদের প্রতিনিধিদের বা সাংসদদের নির্বাচিত করেন, তাঁরা আশা করেন যে, আইন অনুমোদন হওয়ার আগে সামান্যতম নিরীক্ষণ আর সুবিচারের চেষ্টা হবে। এই বাদল অধিবেশনে লোকসভায় এক-একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন গড়ে মাত্র ৩৪ মিনিটে অনুমোদন করা হয়েছে, আর রাজ্যসভা নিয়েছে ৪৬ মিনিট। সাধারণত বিরোধীদের এর এক-তৃতীয়াংশ সময় বরাদ্দ করা হয়। এর অর্থ হল রাজ্যসভায় ৩-৪ জন বিরোধী সাংসদ তাঁদের মতামত রাখবেন ৩ বা ৪ মিনিটের মধ্যে। এ বার কিন্তু মোদী সরকার উত্তাল সংসদের সুযোগ নিয়ে পার্টনারশিপ, ইনসলভেন্সি, ট্রাইবুনাল, অস্ত্র-কারখানায় আন্দোলন নিষিদ্ধ ও রাজস্ব সংক্রান্ত অতি তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থনৈতিক আইন মাত্র ৬ মিনিট থেকে নিয়ে ১২ মিনিটের মধ্যে পাশ করিয়ে নিয়েছে। ৯ মিনিট আলোচনা করে সরকার ২৪ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দও করিয়ে নিয়েছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আইনের খসড়া তৈরি করেন উকিল আর আমলারা। এই জন্যে সভায় নতুন আইন পেশ করলেই সেগুলিকে মানুষের ও দেশের স্বার্থে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো অত্যন্ত জরুরি। মনমোহন সিংহের আমলে, কেন্দ্রীয় সরকার ৭১ শতাংশ নতুন আইন ভাল করে খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখার জন্যে ওই সব কমিটিতে পাঠিয়ে দিত। এখন নরেন্দ্র মোদী অতি-অনিচ্ছা দেখিয়ে মাত্র ১২ শতাংশ আইন কমিটিতে পাঠান। দেখলাম, এয়ারপোর্টের মালিকদের সুবিধার্থে একটি আইন ২-৪ মিনিটের মধ্যে গৃহীত হল। সংসদের পুরনো প্রথা— সাংঘাতিক তাড়া না থাকলে নতুন আইন সাধারণত পরের অধিবেশনে গ্রহণ করা হয়। এ বার একের পর এক নতুন আইন শুধু উপস্থাপিতই হল না, সব ক’টিই বিনা তর্কে বা স্বল্প আলোচনায় গৃহীত হল। বিস্মিত হতেই পারি আমরা, এত তাড়া কিসের?

যাঁরা সভায় হট্টগোল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দিতে হবে যে, সবচেয়ে বেশি উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা গিয়েছে বিজেপির তরফেই— দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে। ক্যাগের রিপোর্টে ২জি কেলেঙ্কারির উল্লেখ নিয়ে ২০১০-এর শীতকালীন অধিবেশন তো চলতেই দেওয়া হয়নি। ২০১৩-র বাজেট অধিবেশন নষ্ট করার পর বিজেপির তৎকালীন নেতা অরুণ জেটলি ও নেত্রী সুষমা স্বরাজ খুবই গর্ব করে বলেছিলেন এটাই গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য। তাঁরা দাবি করেছিলেন যে, সরকার যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্পষ্ট আলোচনা করে না, বিরোধী দলের তখন নৈতিক কর্তব্য— সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে বাঁচানো। তবে মোদী আর তাঁর সমর্থকরা আজ কটূক্তি করছেন কেন?

লক্ষণীয়, সংসদে বিরোধী দলগুলির সাংস্কৃতিক ঐক্য। প্রতিটি অঞ্চলের দল তাদের প্রদেশের ভাষায় স্লোগান দিলেও অন্য দলেরা সঙ্গে সঙ্গে তাল ও স্বর অবলম্বন করে দিব্যি বাংলা, তামিল, মালয়ালম বা পঞ্জাবি ভাষায় যোগ দিচ্ছেন।

যেন এক সর্বভারতীয়তার ছবি, সর্বভারতীয় বিরোধিতার লড়াই।

সাংসদ, তৃণমূল কংগ্রেস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE