E-Paper

আসল লক্ষ্য বাংলা

রাজ্যগুলিতে প্রভাব বিস্তারে বিজেপির এখনও যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গিয়েছে। এখনও অবধি যা দেখা যাচ্ছে, উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতেই বিজেপির প্রাধান্য।

যোগেন্দ্র যাদব

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:৫২

পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের কথা চিন্তা করলে একটু উদ্বিগ্ন লাগছে। যদিও আগামী বছর চারটে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, তবু পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে আলাদা চিন্তা আছে। ভারতের রাজনীতিতে এখন পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে— পশ্চিমবঙ্গই হল শেষ দুর্গ, যা বিজেপি জয় করতে পারেনি। কেউ বলতে পারেন, তামিলনাড়ু, মিজ়োরাম, নাগাল্যান্ড, কিংবা কাশ্মীর উপত্যকাই বা ‘শেষ দুর্গ’ বলে পরিগণিত হবে না কেন? কারণ বিজেপি মনে করে, পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে সেই রাজ্য যা তাদের অনেক আগেই পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পায়নি। তামিলনাড়ু বা কেরলে জয় বিজেপি-র কাছে ‘বোনাস’। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রতি তার বিশেষ দাবি রয়েছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের রয়েছে সাম্প্রদায়িক হানাহানির অতীত। এ হল বিজেপির একেবারে ‘হোম গ্রাউন্ড’, যাকে বলে নিজস্ব জমি। তা সত্ত্বেও তারা এ রাজ্যকে কব্জা করতে পারেনি। আগামী নির্বাচন হবে বিজেপির শেষ সীমানা জয়ের লড়াই।

তা ছাড়া, রাজ্যগুলিতে প্রভাব বিস্তারে বিজেপির এখনও যথেষ্ট ঘাটতি রয়ে গিয়েছে। এখনও অবধি যা দেখা যাচ্ছে, উত্তর ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতেই বিজেপির প্রাধান্য। তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ তাদের প্রভাবের বাইরে থেকে গিয়েছে। ছোট পুকুর থেকে অনেক মাছ ধরতে হচ্ছে বিজেপিকে। ২০২৪ সালে, সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের ধাক্কায় তার ঝুঁকি বুঝেছে বিজেপি। এই দুর্বলতা কাটাতে বিজেপি এখন মরিয়া। আজ বিজেপির হাতে কেবল রাষ্ট্রক্ষমতাই নেই, রয়েছে বিপুল অর্থ, সংবাদমাধ্যম এবং রাস্তায় লোক নামানোর ক্ষমতা। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ক্ষমতার এই বিপুলতা অভূতপূর্ব। ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না বিজেপি। বিবেক-দংশন, দলের মর্যাদা, সংযমের গুরুত্ব— কোনও বিবেচনাই বাধা হবে না। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন প্রসঙ্গে এই তিনটি বিষয়— মরিয়া ভাব, অপ্রতিহত ক্ষমতা এবং বিবেকশূন্যতা— গভীর দুশ্চিন্তা তৈরি করছে।

দুশ্চিন্তার প্রথম কারণ, বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন (এসআইআর)। এর প্রধান লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গই, বিহার ছিল কেবল একটা মহড়া। এসআইআর দুটো জিনিস করছে। এক, নাগরিকত্ব প্রমাণ করার দায়টা চাপিয়ে দিচ্ছে নাগরিকের উপর। দুই, ভারতে বসবাসকারী মানুষ ভারতের নাগরিক, এই ধারণাটাকেই উল্টে দিয়ে গোড়াতেই রাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে যে সকলেই অ-নাগরিক। কেবল ভোটার তালিকাকে পরিষ্কার করতে চাইলে এ দুটোর কোনওটাই করার দরকার পড়ত না। ভোটার তালিকাকে কলুষমুক্ত করতে চাইলে একাধিক তালিকায় এক ব্যক্তির নাম (ডুপ্লিকেশন) মোছা একটি প্রধান কাজ হয়ে উঠত। সফটওয়্যার দিয়ে যা সহজেই করা যায়। কিন্তু তাতে নির্বাচন কমিশনের তেমন আগ্রহ নেই। বোঝা যাচ্ছে, এ হল পিছনের দরজা দিয়ে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের উদ্যোগ। শাসক দলের চোখে যে সব নাম অসুবিধাজনক, অপছন্দের, সেগুলোকে যথাসম্ভব খারিজ করে দেওয়াই হল আসল উদ্দেশ্য।

অসমের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। অসম হল এমন এক রাজ্য যেখানে নাগরিকত্ব বস্তুত একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। সেখানে প্রচুর অবৈধ অভিবাসী ঢুকে রয়েছে। অতএব তাদের নাম বাদ দেওয়া নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু অসমে একটি বিশেষ নির্দেশ জারি করা হয়েছে, যার ফলে কোনও নথিপত্র দেখাতে হচ্ছে না, ফর্ম-ও ভরতে হচ্ছে না। আমরা জানি, অসমে এনআরসি-র ফলাফলকে গুরুত্ব দিতে হলে ১৯ লক্ষ নাম বাদ দিতে হবে। এর ১২ লক্ষই কিন্তু হিন্দুদের নাম। এ থেকেই বোঝা যায় যে, এই পুরো উদ্যোগের আসল উদ্দেশ্য ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করা নয়। এসআইআর আসলে একটা রাজনৈতিক তাগিদ থেকে করা হচ্ছে। আমার আশঙ্কা, বাংলাতে নির্বাচন কমিশন এসআইআর-কে ব্যবহার করবে অপছন্দের নাম বাদ দিতে। প্রধানত যে সব নাম তৃণমূলের ‘নিশ্চিত ভোটার’ বলে মনে হবে। অধিকাংশই সম্ভবত হবে মুসলিম নাম।

বিহারের পর থেকে নির্বাচন কমিশন একটা নতুন কৌশল নিয়েছে। প্রথমে ব্যক্তির নামের সঙ্গে ২০০২ সালের কোনও এক আত্মীয়ের নাম মিলিয়ে দেখছে। এই মিলিয়ে দেখা বা ‘ম্যাচিং’ সব রাজ্যেই হচ্ছে। কিন্তু সূত্রের খবর, অন্যান্য রাজ্যে যেখানে ৭৫-৮০ শতাংশ মিলে যাচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে কেবল ৫৫ শতাংশ মিলছে। ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দুটো পর্যায় দেখা যায়। প্রথম পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে, কত জন ফর্ম পূরণ করেননি। এঁরা তৎক্ষণাৎ ভোটার তালিকার বাইরে চলে যাবেন। কোনও আপিল বা শুনানির অধিকার তাঁদের থাকবে না। নাগরিকত্ব প্রমাণ করার আইনি উপায় তাঁদের হাতের বাইরে চলে যাবে। বিহারে আমরা দেখেছি, এই তালিকায় মহিলাদের নামই রয়েছে বেশি।

এই বাদ-পড়া ভোটারদের অপেক্ষা করতে হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য, যখন বিজ্ঞপ্তি জারি করে নথিপত্র দাবি করা হবে। আমার আশঙ্কা, এই পর্যায়েই বেছে বেছে নাম বাদ দেওয়া হবে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত মুসলিমদের নাম বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। বিহারে শেষ অবধি ৪৪ লক্ষ নাম বাদ গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে শোনা যাচ্ছে, সংখ্যাটা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে। যদি তা হয়, তা হলে বিশ্বের ইতিহাসে তা হবে ভোটাধিকার খারিজ হওয়ার বৃহত্তম নিদর্শন।

দুশ্চিন্তার দ্বিতীয় কারণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরি করার চেষ্টা হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু বামফ্রন্ট সেটাকে অনেকটাই চাপা দিয়ে রাখতে পেরেছিল। পরবর্তী কালেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত খুব বড় আকার ধারণ করেনি। বিজেপি তাকে ওস্কানোর চেষ্টা করবে। মুশকিল হল, এই ধরনের সংঘাত শুরু করা সহজ, শেষ করা কঠিন। পশ্চিমবঙ্গের পাশেই রয়েছে আর একটি দেশ, যেখানে এখন তোলপাড় চলছে। জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে ভোটে জেতার এই কৌশল উন্মত্ততা ছাড়া কিছু নয়।

দুশ্চিন্তার তৃতীয় কারণ, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে হিংসার সম্ভাবনা নিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী রাজনীতিতে হিংস্রতার প্রাধান্য রয়েছে। বামেরা হিংসাকে নিয়ন্ত্রণ না করে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। সেই ধারা বাম শাসন সমাপ্তির পরেও অব্যাহত। হিংসায় বিহারের বদনাম বেশি, কিন্তু নির্বাচনী হিংসার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গই সব চাইতে হিংসাপ্রবণ রাজ্য। আশঙ্কা, রক্তাক্ত ঘোলা জলে কেন্দ্র মাছ ধরার চেষ্টা করবে। কেন্দ্রীয় বাহিনী ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পক্ষপাতদুষ্ট ভাবে কাজ করেছিল। আমার আশঙ্কা, এ বারও তাই করবে। গত বছর উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনে আমরা দেখলাম, রামপুর, মোরাদাবাদে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল, যাতে মুসলিমরা ঘর থেকে বেরোতেই না পারে। এটা ছিল সমাজবাদী পার্টির খাস এলাকা। ফলে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী হেরে যান। বাংলায় এমন জোর করে বাধা দিলে তার প্রতিরোধ হবেই, কারণ স্থানীয় ভাবে বিজেপি দুর্বল। তাই আরও বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হবে, তার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, বিহারের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও ভোট গণনা ছিল নির্বাচন কমিশনের সততা, স্বচ্ছতার পরীক্ষা। আমি মনে করি, তার যথার্থ পরীক্ষা হবে পশ্চিমবঙ্গে। টি এন শেষন, জে এম লিংডো মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তার পর সততা, স্বচ্ছতা ঢুকে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের কাঠামোয়। এখন যেন নির্বাচন কমিশন সরকার এবং শাসক দলের একটা শাখা হয়ে উঠেছে। বিহারের ভোট নির্বাচন কমিশনের প্রকৃত পরীক্ষা ছিল না, সেখানে লক্ষ্য ছিল জেতার মার্জিন বাড়ানো। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফল উল্টে দেওয়াই হল লক্ষ্য। তাই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কী থাকবে, তা নিয়ে রইল চূড়ান্ত দুশ্চিন্তা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Assembly Election BJP

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy