E-Paper

যুক্তসাধনা রূপকথা নয়

উদ্বোধন রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের পত্রিকা। রামকৃষ্ণদেব নানা সাধনপদ্ধতি অনুশীলন করেছিলেন। রানি রাসমণির মন্দিরে মুসলমান ফকিরেরা আসতেন। পরমহংস ইসলামি মতে সাধনা করেছিলেন, আল্লার নাম গ্রহণ করেছিলেন।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:২৬
শ্রদ্ধা: রাজপুত রাজা ও অভিজাতদের অভ্যর্থনায় আকবর।

শ্রদ্ধা: রাজপুত রাজা ও অভিজাতদের অভ্যর্থনায় আকবর। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।

পুজো আসছে, দুর্গাপুজো। মাতৃমূর্তি, দেবী কল্পনা দেবীকে ঘিরে পৌরাণিক আখ্যান এ সবের স্বাদ গন্ধ মনের ভিতরে পাক খায়। কিন্তু এ কি বাঙালিহিন্দুর একক সাধনা? পুজোসংখ্যারভিড়ে চোখ আটকে গেল একটি লেখায়। এ-বছরের উদ্বোধন পত্রিকায় খুব যত্ন করে প্রকাশ পেয়েছে সচিত্র একটি প্রবন্ধ ‘মুঘল চিত্রশিল্পে পঞ্চতন্ত্র’। লিখেছেন শিল্প-ইতিহাসবিদ অশোক কুমার দাস। মোগল চিত্রশিল্প নিয়ে অশোকবাবুর কাজ দেশে-বিদেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। আকবর বাদশা পড়াশোনায় সুমনোযোগী ছিলেন না। কিন্তু গল্প শোনায় তাঁর আগ্রহের অভাব ছিল না। সেই গল্প শোনার আগ্রহ বাদশা হয়ে নানা ভাবে তিনি পূর্ণ করতেন। তাঁর ছিল কিতাবখানা আর তসবিরখানা। সেখানে রামায়ণ, মহাভারত, হরিবংশ, কথাসরিৎসাগর, হিতোপদেশ-এর মতো নানা সময়ের নানা সংস্কৃতে লেখা গ্রন্থগুলি ফারসিতে অনূদিত হত আর সেই অনূদিত রচনার পুঁথিগুলি ছবিতে সাজিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। সেই সুদৃশ্য চিত্রিত পুঁথিতে চোখ রেখে ছবিতে গল্প অনুসরণ করতেন আকবর বাদশা। সম্ভবত ডিসলেক্সিয়া ছিল তাঁর। এ কালের আমির খানি সিনেমা তারে জমিন পর-এর গল্প আকবর বাদশার জীবনে সত্য হয়নি। কোনও ছবি আঁকিয়ে মাস্টারমশাইয়ের সাহচর্য তিনি ছেলেবেলায় পাননি, তবে বাদশাবেলায় পেয়েছিলেন সচিত্রিত গল্পের সাহচর্য। ‘আনোয়ার-ই-সুয়াহিলি’ ফারসি ভাষার পঞ্চতন্ত্র। দুই রাজহাঁস কচ্ছপকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর মাটির পৃথিবী থেকে মানুষেরা দেখছেন সেই আশ্চর্য সহযোগের দৃশ্য। হিন্দু-মুসলমানের এক আশ্চর্য যুক্তসাধনার ফল এই কিতাব। অশোকবাবুর লেখাটি পড়ে উনিশ শতকের ইতিহাসে মন চলে গেল।

উদ্বোধন রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের পত্রিকা। রামকৃষ্ণদেব নানা সাধনপদ্ধতি অনুশীলন করেছিলেন। রানি রাসমণির মন্দিরে মুসলমান ফকিরেরা আসতেন। পরমহংস ইসলামি মতে সাধনা করেছিলেন, আল্লার নাম গ্রহণ করেছিলেন। এই আধ্যাত্মিক যুক্ত-সাধনার উদারতা তাঁর শিষ্যদের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দের জীবৎকালে এ পত্রিকা পাক্ষিক সাময়িকী হিসেবে প্রকাশিত হত, ধর্মনীতি-রাজনীতি-সমাজনীতি-দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে হিন্দু-মুসলমান যুক্তসাধনার ধারাকে কখনও অস্বীকার করেনি। এই সাধনা কেবল বৃহত্তর ক্ষেত্রেই নয়, ছোট ছোট পরিসরেও ক্রিয়াশীল। স্বামী অখণ্ডানন্দের উদ্যোগে মুর্শিদাবাদে যে অনাথাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরুপায় বালকেরা আশ্রয় পেত। সেই অনাথাশ্রম চালানো সম্ভব হত সামাজিক সাধারণের দানে। কারা দান করছেন এবং কী দান করছেন তার খুঁটিনাটি হিসাব প্রকাশিত হত উদ্বোধন-এর পাতায়। হিন্দু সন্ন্যাসীদের দ্বারা পরিচালিত অনাথাশ্রমে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সদাশয় মানুষেরা অর্থ সাহায্য করতে দ্বিধা করতেন না। শেখ মহম্মদ মনিরুদ্দিন সাহেব ও হাজি শেখ নকিবুদ্দিন সাহেব যথাক্রমে ৫০ টাকা ও ২৫ টাকা দান করেছিলেন। সে কালের বাজারদরের নিরিখে খুব সামান্য দান নয়। পত্রিকায় মাঝে মাঝেই শেখ ফসিউল্লার ‘গোলাপের নির্য্যাস’ এর বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। লেখা হত, “খাঁটি গোলাপের প্রকৃতই অভাব, যাঁহারা গোলাপ ব্যবহার করেন তাঁহারাই জানেন প্রকৃত গোলাপ কেহই পান না কেবল বাজে জল সামান্য খাঁটি গোলাপে মিশাইয়া বাজারে তাহাই সস্তা দরে বোতল বিক্রয় হয়।” এর থেকে ফসিউল্লার নির্যাস গুণগত মানে আলাদা। ‘গোলাপের নির্য্যাস চুঁয়াইয়া’ বিক্রি করা হচ্ছে। মুসলমান উদ্যোগপতির এজেন্ট কিন্তু হিন্দুরা— শ্রীবটকৃষ্ট পাল, কলিকাতা। শ্রীলালমোহন সাহা, ঢাকা বাগবাজার। শ্রীপ্রাণনাথ বণিক, বরিশাল।

উদ্বোধন পত্র আত্মপ্রকাশ করেছিল উনিশ শতকের একেবারে শেষের দিকে। ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ এই চার বছর বিবেকানন্দের বাংলা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এই পত্রিকার প্রধান লেখক। ‘ভাববার কথা’ নামে শ্লেষাত্মক গল্পগুলিও এতে প্রকাশ পায়। এই গল্পে স্বামীজি হিন্দু ও মুসলমান উভয়পক্ষের অন্ধ লোকাচারকে কৌতুকবিদ্ধ করতে দ্বিধা করেননি। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের প্রয়াণ হল। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম তখন সবে কয়েক বছর হল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। হিন্দু তপোবনের আদর্শ ও ব্রহ্মচর্য পালনের গুরুত্ব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তখন সুদৃঢ়। বন্ধু জগদীশচন্দ্রকে লেখা চিঠিতে তাঁর সেই আদর্শবোধের কথা প্রকাশ পেয়েছিল। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের আদর্শ হিন্দু অতীতের মুগ্ধ স্মৃতিতে আটকে থাকেনি। তা সম্প্রসারিত হয়েছিল। ক্ষিতিমোহন সেন ও বিধুশেখর শাস্ত্রী এই দু’জন শান্তিনিকেতনে যোগ দেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ এঁদের সঙ্গে তাঁর ভাবনা বিনিময় করতে পারতেন। দু’জনেই ছিলেন পণ্ডিত মানুষ, সংস্কৃতজ্ঞ। ক্ষিতিমোহন হিন্দি ভাষায় প্রাজ্ঞ। প্রাগাধুনিক ভারত যে কেবল হিন্দু ভারত নয়, তা যে হিন্দু-মুসলমানের ভারত, এই ভাবনা প্রতিষ্ঠায় ক্ষিতিমোহন ও বিধুশেখরের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া ছিলেন মৌলবি জিয়াসউদ্দিন। ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখে শান্তিনিকেতন পত্রে প্রকাশ পেয়েছে জিয়াসউদ্দিনের সাদির কবিতা অনুবাদের খবর।

তখন আশ্রমে সৈয়দ মুজতবা আলী চলে এসেছেন। তিনি ওমর খৈয়াম সম্বন্ধে সুলিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। ফিটজেরাল্ডের ওমর খৈয়াম অনুবাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে মত প্রকাশ করেছিলেন মুজতবা। সাহেবদের প্রাচ্য-কল্পনা যে অনেক সময়েই বস্তুনিষ্ঠ নয় তাদের মনের মাধুরীতে ইতিবাচক বা নেতিবাচক রূপ পরিগ্রহ করে সে-কথা এক রকম ভাবে উঠেছিল। ফিটজেরাল্ডের অনুবাদে ওমর খৈয়াম নাস্তিক বলে ধরা দিচ্ছেন, অথচ তিনি তো নাস্তিক নন, এ কথা সে দিন উঠেছিল। ‘মুসলমান ছাত্রের বাংলা শিক্ষা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। লিখেছিলেন, ‘মুসলমান শাস্ত্র ও ইতিহাসের বিকৃত বিবরণ বাংলা বই কেথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছে? অস্ত্র হস্তে ধর্মপ্রচার মুসলমানশাস্ত্রের অনুশাসন, এ কথা যদি সত্য না হয় তবে সে অসত্য আমরা শিশুকাল হইতে শিখিলাম কাহার কাছে? হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মনীতি ও ইতিবৃত্ত সম্বন্ধে ইংরাজ লেখক যাহাই লিখিতেছে হিন্দু-মুসলমান ছাত্রগণ কি তাহাই নির্বিচারে কণ্ঠস্থ করিতেছে না? এবং বাংলা পাঠ্যপুস্তক কি তাহারই প্রতিধ্বনি মাত্র নহে?’ ইংরেজ লেখকদের হাত-ফেরতা কথায় না ভুলে যদি পরস্পরকে চিনতে চাইলে হিন্দু-মুসলমান উভয়কেই পরস্পরমুখী হতে হবে। সে চেষ্টাই সে দিন শান্তিনিকেতনে হচ্ছিল।

প্রত্যক্ষ ভাবে ভারতের যৌথ অতীত অভিমুখে যাত্রার প্রচেষ্টায় ক্ষিতিমোহনের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হিন্দি জানতেন বলে প্রাগাধুনিক ভারতের ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর প্রবেশাধিকার সম্ভব হয়েছিল। ভক্তি আন্দোলনের কুশীলবরা হিন্দু-মুসলমান এই প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের সীমাকে অতিক্রম করেছিলেন। গায়ে-গতরে খেটে খাওয়া মানুষ বলেই শ্রমের জগতে পারস্পরিকতার ধর্ম তাঁরা অনুভব করতে পেরেছিলেন। বিশ্বভারতী পত্রিকার অষ্টম বর্ষ প্রথম সংখ্যায় (বঙ্গাব্দ ১৩৫৬-৫৭) প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধ ‘ভারতীয় সংগীতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনা’।

রবীন্দ্রনাথ তখন প্রয়াত। দেশ স্বাধীন হয়েছে, ভাঙা দেশ। ক্ষিতিমোহন লেখেন, ‘ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সাধনাগত যোগ বহুকালের’। সেই যোগ ‘ভগবৎপ্রেমে, ভক্তিতে, চিত্রশিল্পে, স্থাপত্যশিল্পে, জ্যোতিষ-চিকিৎসাশাস্ত্রে, কাব্য-সাহিত্যে, সামাজিক উৎসবাদিতে’। এ কথা যে সত্য তা চার পাশে চোখ মেললে বোঝা যায়। তবু কেউ কেউ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। চিকিৎসকরা বলেন ডিসলেক্সিয়া শেখার অক্ষমতা, এই রোগ ভাষার দক্ষতাকে প্রভাবিত করে। সাম্প্রদায়িকতাও এক রকমের ডিসলেক্সিয়া, তা হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনার ভাষাকে পড়তে চায় না।

দুর্গাপুজো আসছে। আকবরের দরবারের খবর সাম্প্রদায়িক ডিসলেক্সিয়াকে প্রতিহত করতে সাহায্য করে। আকাশ পথে উড়ে যাচ্ছে দু’টি রাজহাঁস, তাদের সঙ্গী এক কচ্ছপ। নীচের পৃথিবীর মানুষেরা সেই দৃশ্যের পানে চেয়ে আছেন। এ এক অভাবনীয় সহযোগ। রূপকথার যুক্তসাধনা, তবে রূপকথা নয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Harmony Art Literature Culture

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy