E-Paper

ধোঁকা‘বাজি’র উৎসব

হাতেগোনা বাজি কারখানা চলার অনুমতি থাকলেও চলছে পাঁচ হাজারের উপর কারখানা ও ব্যবসা, তথ্য সরকারেরই। বাজি তৈরির ক্লাস্টার নিয়ে কথাই সার।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৫ ০৫:৪৮

নব্বইয়ের দশকের প্রায় মাঝামাঝি কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক রায়ের সূত্র ধরে দেশের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবঙ্গে বাজি ও মাইক্রোফোনের শব্দদূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করার শুরু। পরবর্তী কালে দেশের পরিবেশ আইনের মধ্যেও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এল ওই রায়কে কেন্দ্র করেই। কিন্তু অভিযোগ, শক্তিশালী বাজি লবির চাপে কেন্দ্রীয় স্তরে বাজি ফাটানোর অনুমোদিত শব্দমাত্রা খানিকটা উঁচুতে রাখা হল। যে-হেতু কোনও একটি রাজ্য পরিবেশের কোনও মাপকাঠিকে প্রয়োজনে দেশের মাত্রার তুলনায় শক্তিশালী করতে পারে, তাই পশ্চিমবঙ্গে বাজির মাত্রা দেশের তুলনায় বেশ খানিকটা শক্ত রইল এবং বার বার বাজি ব্যবসায়ীরা এই ‘অসাম্য’-এর বিরুদ্ধে আদালতে গেলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারলেন না।

শব্দদূষণের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে ব্যবস্থাগ্রহণ ক্রমেই দুর্বল হলেও; বাম জমানা তো বটেই, সরকারের এই আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত বজায় রইল তৃণমূল শাসনের প্রথম কিছু বছরেও। আদালতেও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ তেমনটা জানাল। কিন্তু তার পরেই রাজ্যে বাজির ব্যবসায়ী, এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী, রাজনীতিবিদ এবং আধিকারিকদের একাংশের যুগলবন্দিতে শুরু হল বাজির শব্দদূষণের বিরুদ্ধে থাকা আইনটিকেই দুর্বল করার চেষ্টা। প্রথমত, ৯০ ডেসিবেলের শব্দের যে মাপকাঠি প্রায় পঁচিশ বছর ধরে বলবৎ ছিল, তাকে সহজ করা হল। পরবর্তী কালে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে দিয়েই বলানো হল যে, বাজি একটি অত্যন্ত নিরীহ শিল্প। তাকে লাল ক্যাটেগরি, অর্থাৎ মারাত্মক দূষিত থেকে সাদা ক্যাটেগরি, অর্থাৎ প্রায় দূষিত নয় করে দেওয়া হল রাতারাতি। ফলে অনুমতির জন্য ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতরকে দায়িত্ব দেওয়া হল। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ রাতারাতি রেফারি থেকে দর্শক হয়ে গেল।

এই ক্রনোলজি-র পরের পর্ব একটি মোক্ষম চাল। কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে রায় দিল, পরিচিত বাজির পরিবর্তে এ বার থেকে ব্যবহার হবে সবুজ বাজি, যাতে নাকি প্রায় ৩০ শতাংশ বায়ুদূষণ কম হয়। আদালতের রায় শিরোধার্য মেনে নিলেও প্রশ্ন থেকে যায়, বাকিটা? এর উত্তর মিলল না। কী হবে শব্দমাত্রার, উত্তর নেই। এ রাজ্যে দেখা গেল, প্রথম দিকে সবুজ বাজির নামে খানিকটা অস্বস্তি থাকলেও, পরে অধিকাংশ বাজি ব্যবসায়ী সবুজ বাজিকে মেনে নিলেন। রাজনীতিকরাও সবুজ বাজিই সমাধান বলতে শুরু করলেন। কারণ সন্ধান করতে গিয়ে রহস্যটা স্পষ্ট হল। দেখা গেল, এক দিকে সবুজ বাজির নাম করে এ রাজ্যে তৈরি যাবতীয় বেআইনি বাজি বাজারে আসছে, অন্য দিকে সরকারি ভাবে সবুজ বাজির তকমা থাকায় তার উপর নজরদারি আগের তুলনায় বহুলাংশে কমেছে, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘উইন উইন’ পরিস্থিতি।

এমনকি সরকারি বাজি বাজারেও গত কয়েক বছরে অবাধে বিক্রি হতে দেখা গেল ‘সবুজ বাজি’ লেখা বাক্সের মধ্যে বেআইনি বাজি। দেখা গেল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যে কিউআর কোড ছাড়া সবুজ বাজি হওয়ার কথাই নয়, সেই কোড অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই। যেখানে আছে তা হয় খুলছে না, খুললেও সেখানে বাজির বিশদ বর্ণনার বদলে আসছে বিদেশি ব্যান্ডের বাজনা, কোথাও বেড়াতে যাওয়ার বিজ্ঞাপন! যে হাতেগোনা কিউআর কোড আছে, সেগুলিরও কোথাও কোথাও অতি উৎসাহে বাজি তৈরির অনুমতি পাওয়া আর শেষ হওয়ার দিন এক হয়ে গিয়েছে! কোথাও বাজি তৈরির উপকরণে সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ হওয়া বেরিয়ামের উপস্থিতি।

কিন্তু এ সব যাদের দেখার কথা, অর্থাৎ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বা কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা নিরি বা পেসো, তারা কোথাও নেই! এক বছর আদালতের চাপে কোনও ক্রমে কিছু যৌথ নজরদারি করলেও তার পর আর তাদের দেখা নেই। প্রশ্ন তুললে সব পক্ষই অন্যের কোর্টে বল ঠেলে দেয়, আর ফাঁকা মাঠে পরিবেশ আইনকে দশ গোল দেন অধিকাংশ বাজি ব্যবসায়ী। এবং সেই সব ‘সবুজ বাজি’ চতুর্দিক কম্পিত করে যাবতীয় নিয়ম ভেঙে মাঝরাত অবধি ফাটে। বায়ুদূষণ মাত্রা মধ্যরাতে শিখরে ওঠে। হাতেগোনা বাজি কারখানা চলার অনুমতি থাকলেও চলছে পাঁচ হাজারের উপর কারখানা ও ব্যবসা, তথ্য সরকারেরই। বাজি তৈরির ক্লাস্টার নিয়ে কথাই সার। বর্তমানে যে ভাবে বাজি ব্যবস্থাকে চালানো হচ্ছে সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও, তাতে গভীর সমস্যায় পড়ছেন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত গরিব মানুষ। কোনও নিয়ম-নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্যবসা চলার দরুন বিস্ফোরণ এখন জলভাত।

পাশাপাশি অধিকাংশ মানুষ যত্র তত্র, যখন-তখন বাজি ফাটানোর বিরোধী হলেও মানতে বাধ্য হচ্ছেন, আইন ভাঙাই আইন হয়ে গিয়েছে। লাগামছাড়া বাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আজ অবধি এ রাজ্যে শব্দশহিদ হয়েছেন চোদ্দো জন। এটাই চলবে যদি না নব্বইয়ের দশকের মতো আদালতের চাপে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা খানিকটা ফেরে। নয়তো বাজি নিয়ে এই ধোঁকাবাজি চলতেই থাকবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Crackers Pollution

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy