E-Paper

হারিয়ে ফেলা অনেক মুখ

প্রথম দিন থেকেই কমিউনিস্টদের কাজকর্ম সম্পর্ক ব্রিটিশরা সতর্ক ছিল। ষড়যন্ত্র সূত্রপাতের খোঁজ পেলেই, সঙ্গে সঙ্গে তাকে অঙ্কুরে খতম করার আয়োজন করেছে ব্রিটিশ, আপত্তিকর রচনা, বক্তৃতা বন্ধ করার জন্য প্রয়োগ করেছে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা, যার পরিণাম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:২০
বিস্মৃত: বেগম সাকিনা।

বিস্মৃত: বেগম সাকিনা।

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই তার সঙ্গী— বিতর্ক। ১৯২৫-এর ডিসেম্বরের শেষ দিকে কানপুরে বিভিন্ন প্রদেশের কমিউনিস্ট নেতাদের এক সম্মেলন হয়, আর সেখানেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়ে দলের গোড়াপত্তন। কে আহ্বান করেছিলেন এই সম্মেলন? মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীর সবরমতী আশ্রমের এক ব্যক্তি, যার ছদ্মনাম সত্যভক্ত। মজার ব্যাপার, এই সত্যভক্ত নাকি সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন, আর মস্কোফেরত কমিউনিস্ট-সহ দেশি কমিউনিস্ট সবাই ছুটে গেলেন পার্টি গঠনের জন্য কানপুর সম্মেলনে। আরও মজার ব্যাপার, যে ব্রিটিশ শাসক মাত্র এক বছর আগে কানপুরে কমিউনিস্ট কর্মীদের চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল, যে ব্রিটিশ এর চার বছর পরে, ১৯২৯ সালে, ভারতের সব কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে বিশ্বের বৃহত্তম ষড়যন্ত্র মামলা (মীরাট ষড়যন্ত্র) শুরু করবে, সেই তারাই, ওই কানপুরে বিনা বাধায় প্রকাশ্য সম্মেলনের মাধ্যমে পার্টি গঠন করার সুযোগ করে দিল!

তবে সত্যভক্ত যাঁরই লোক হয়ে আসুন না কেন, প্রথম দিন থেকেই কমিউনিস্টদের কাজকর্ম সম্পর্ক ব্রিটিশরা সতর্ক ছিল। ষড়যন্ত্র সূত্রপাতের খোঁজ পেলেই, সঙ্গে সঙ্গে তাকে অঙ্কুরে খতম করার আয়োজন করেছে ব্রিটিশ, আপত্তিকর রচনা, বক্তৃতা বন্ধ করার জন্য প্রয়োগ করেছে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারা, যার পরিণাম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণির প্রজাদের মধ্যে, ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর শত্রুতার মনোভাব জাগিয়ে তোলা আর লালন করার জন্য নেতাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছে ওই দণ্ডবিধির ১৫৩এ ধারা, যার পরিণামে দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড। এ ছাড়া ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট, সি কাস্টমস অ্যাক্ট এবং পোস্ট অফিস অ্যাক্ট তো ছিলই। এই সব আইনের প্রধান উদ্দেশ্য, গন্ডগোলের রচনা দেখলেই, তা নিষিদ্ধ, আর সাম্যবাদের সমর্থক পুস্তিকার সন্ধান পেলেই তাকে বাজেয়াপ্ত করা। কোনও ক্রমেই যেন তা এ দেশে ছড়িয়ে না পড়ে!

সে যুগের কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রচারকদের এমন কত যে বিধিনিষেধ ডিঙিয়ে কাজ করতে হয়েছে! প্রশ্ন স্বাভাবিক— সে দিন কারা ছিলেন কমিউনিস্ট ভাবাদর্শের প্রচারক? ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গোড়াপত্তন করেছিলেন যাঁরা, সেই মুজফ্‌ফর আহমেদ, এম এন রায় প্রমুখের নাম তো জানা। বরং অনামা বা স্বল্পখ্যাত কয়েক জনের দিকে তাকানো যাক, যাঁদের অবদান নামীদের থেকে কোনও অংশে কম নয়। এঁদের প্রচারপুস্তিকার বিরোধিতা করতে ব্রিটিশকেও বঙ্গদেশে প্রচার করতে হয়েছিল সাম্যবাদের বিপদ পুস্তিকা, যাতে আমজনতার মন কাড়তে অন্ত্যমিল দিয়ে লিখতে হয়েছিল: বল দেখি সাম্যবাদী কারে বলা যায়?/ অসম অর্জনে যে বা সমভাগ চায়।/ কুঁড়ে বা কদর্য কর্মী, কিছুই না জানে,/ পাই-পয়সার দিয়ে ভাগ, টাকা ধরে টানে।

সাম্যবাদের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে বরাহনগরের শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা, যিনি এ দেশে প্রথম শ্রমিক পত্রিকা ভারত শ্রমজীবী প্রকাশ করেছিলেন। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল শিবনাথ শাস্ত্রীর সেই বিখ্যাত ‘শ্রমজীবী’ কবিতা। এ অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া’র জন্মের অনেক আগের কথা।

১৯২৫ সালে দেশে ফেরার পর থেকেই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মার্ক্সবাদের আদর্শ প্রচারে নেমে, যুব সম্মেলনে উপস্থিত জনতাকে বোঝাচ্ছেন মার্ক্সবাদ ছাড়া নিজেদের অবস্থা উন্নতির আর কোনও পথ নেই। একের পর এক বই বেরোচ্ছে তাঁর। ট্রাম-শ্রমিক’সহ নানান ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি সহসভাপতির ভূমিকায় ভূপেন্দ্রনাথ। সাম্যবাদী দর্শন নিয়ে তিনি ধারাবাহিক লিখে চলেছেন বঙ্গবাণী পত্রিকায়। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ‘মাস্টারমশাই’ জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ।

এই নতুন চেতনার বশে কালিদাস রায় লিখলেন, ‘শরৎচন্দ্রের মহেশের প্রতি’--‘...কে তোমা দেয়নি খেতে বিধাতার দেওয়া ঘাস জল?/ কাদের দংশন বিষ গোফুরেরে করিল পাগল?/ কাদের নিকটে বড় তোমা হ’তে গোময় তোমার?/বল আমীনার বন্ধু, মূক পশু নহ তুমি আর।/ গোজন্মে খালাস পেয়ে ফিরিয়া কি এলে গুণ্ডা সাজি?/ শিঙ দুটী ছোরা হ’য়ে তব হস্তে ঝলসে কি আজি?’

অরবিন্দ ঘোষ প্রোলেতারিয়েত-কে ‘রিয়্যাল কী টু দ্য সিচুয়েশন’ বললেও, অর্ধস্বচ্ছ পর্দার আড়ালে বলশেভিক দর্শন প্রচারের কাজে যুক্ত ছিলেন তাঁর সুহৃদ-সহযোদ্ধা ‘গোবিন’, ‘মাইকেল’ অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। রাশিয়ার বিপ্লবের প্রেরণায়, এ দেশের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি জন্ম নেওয়ার আগেই, বলশেভিক তথা কমিউনিস্ট দর্শনের কথা ছড়িয়ে দিতে অমরেন্দ্রনাথ আর উপেন্দ্রনাথের আত্মশক্তি লাইব্রেরি প্রকাশ করেছিল একটি বই বলশেভিকী; যার প্রকাশক, লেখক-সম্পাদক, অমরেন্দ্রনাথের অনুজ বরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। প্রুফ দেখা-সহ সুষ্ঠু ভাবে এই বই প্রকাশের নানান কাজে জড়িয়ে ছিলেন অমরেন্দ্রনাথ।

সন্তোষকুমারী দেবী, প্রভাবতী দাশগুপ্ত, বেগম সাকিনা, সুধা রায়, বিমলপ্রতিভা দেবী— নামগুলি আজ অপরিচিত লাগলেও, তাঁরা যে ভাবে শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সাম্যবাদী দর্শনের আদর্শে, তা তুলনারহিত। সন্তোষকুমারী প্রায় প্রতিটি সভায় শ্রমিকদের বলতেন একতাবদ্ধ হয়ে লড়ার কথা; শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তোলায় তিনি একাগ্র। তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে গৌরীপুর জুট মিল ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন আর বেঙ্গল জুট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন। যে যুগে ধাঙড়দের মনে করা হত অস্পৃশ্য, প্রভাবতী দাশগুপ্ত হয়ে ওঠেন শহরের সেই সাফাইকর্মীদের নেত্রী, ধাঙড়ের মা। এর কিছুকাল পরে, কলকাতায় আরও এক জন ধাঙড়ের মা হয়ে ওঠেন, তিনি বেগম সাকিনা ফারুক সুলতানা মোয়াজেদা; তাঁর নেতৃত্বে ২৬ মার্চ ১৯৪০ থেকে শহরের প্রায় ১৮০০০ সাফাইকর্মী ৭ দিনের হরতাল করে। দক্ষিণ কলকাতার স্কুল-শিক্ষিকা সুধা রায় প্রতি অপরাহ্ণে চলে যেতেন খিদিরপুর, ডক-শ্রমিকদের সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজে। সাম্যের কথা শেখাতে শেখাতে অচিরেই তিনি হয়ে ওঠেন ডক-শ্রমিকদের প্রিয় ‘বহিনজি’। খিদিরপুর এলাকার গলি, উপগলি সম্বন্ধে যাঁদের সামান্য ধারণা আছে, এবং ওই এলাকার চরিত্র যাঁরা জানেন, তাঁরাই বুঝবেন ওই সব জায়গায় কাজ চালানো কতটা বিপজ্জনক। কিন্তু বহিনজি সুধা রায় অদম্য, নির্ভয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার কাজ চালিয়ে গেছেন দীর্ঘদিন। আর সুভাষচন্দ্রের সহকর্মী, পরে ট্রটস্কিপন্থী-সাম্যবাদী বিমলপ্রতিভা দেবী তো নিজের দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত বাড়ি, সংসার সব ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আসানসোল অঞ্চলের কয়লা খাদানে শ্রমিকদের জোট তৈরি করতে। তিনি হয়ে ওঠেন কয়লাখনির দাপুটে নেত্রী।

বিস্মৃত: সন্তোষকুমারী দেবী।

বিস্মৃত: সন্তোষকুমারী দেবী।

মস্কো বনাম পণ্ডিচেরি-র লেখক শিবরাম চক্রবর্তীও সে দিন বোলশেভিকবাদের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলে উঠেছিলেন,‘বঞ্চিত মানুষ অনন্তকেও জানে না, জীবনকেও জানে না।... ক্ষুধার ধার দূর হলে তারপরে তো সুধার স্বাদ!’

ঠাকুরবাড়ির ‘কার্ল মার্ক্স’ সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন রচনায় তুলে ধরেছেন কমিউনিস্ট আদর্শের কথা। তাঁর দলের পান্নালাল দাশগুপ্ত যে ভাবে নৌবিদ্রোহের বিশ্লেষণ করেছিলেন, তা এক জন প্রকৃত কমিউনিস্টের পক্ষেই সম্ভব।

কথায় কথায় এমন কত নাম যে চলে আসে। এঁরা কেউই মুজফ্‌ফর আহমেদ-মানবেন্দ্রনাথের কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সদস্যপদ গ্রহণ করেননি, বা নেওয়ার চেষ্টাও করেননি। এমনকি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরও, যাঁর সঙ্গে মুজফ্‌ফর আহমেদের খুবই সখ্য সে সময়, যিনি কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে, তিনিও পরবর্তী কালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেননি।

অথবা, এমনও হতে পারে কমিউনিস্ট পার্টিই এঁদের সভ্যপদে নিতে চায়নি। কিন্তু, অস্বীকার করার উপায় নেই, এ দেশে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ তথা সাম্যবাদের প্রচারে এঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা অপরিসীম। যেমন আজ অস্বীকার করবার উপায় নেই অন্ধতা-অযুক্তির বিরুদ্ধে রামমোহন রায়, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রাজশেখর বসু, সুকুমার রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু’র ধারাবাহিক লড়াইকে; যুক্তির পথ পরিষ্কার থাকলে, অন্ধতায় আলো ফেলা হয়েছিল বলে মার্ক্সবাদের পথও মসৃণ হয়েছিল। এঁরা প্রত্যেকেই তো সেই আলোর পথেই হেঁটেছেন।

এই সহজ সত্য মনে রেখে, তার একশো বছর পূর্ণ করার সময়ে, এই সব অনামা ‘অ-কমিউনিস্ট’দের কথা কী অন্তত এক বার স্মরণ করবে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া— লাল পতাকার পার্টি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Communist british

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy