পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাদিদি তো ব্রাহ্মণ। তাঁকে নিশ্চয়ই রাজ্যের ব্রাহ্মণরা ঢেলে ভোট দেন?” প্রশ্নটা করেছিলেন সোনীপতের এক পঞ্চায়েত প্রধান। গত সেপ্টেম্বরে হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনের সময়ের ঘটনা। বাঙালি সাংবাদিককে সামনে পেয়ে বাংলার রাজনীতি নিয়ে মনের কৌতূহল খানিকটা মিটিয়ে নিচ্ছিলেন।
প্রবীণ জাঠ নেতাকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল যে, পশ্চিমবঙ্গে এখনও এ ভাবে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, নমঃশূদ্র ভোটের ভাগাভাগি হয় না। বরাবরই মুসলমান ভোট একটা ভূমিকা নেয়। হালে মতুয়া ভোট নিয়েও দড়ি টানাটানি চলছে। কিন্তু কোনও বিধানসভা কেন্দ্রে ব্রাহ্মণ প্রার্থী খাড়া করলে ব্রাহ্মণদের ভোট মিলবে, এই জাতপাতের রাজনীতি এখনও পশ্চিমবঙ্গে অনুপস্থিত।
“জাতপাতের অঙ্কে ভোট হয় না? তা হলে কিসের ভিত্তিতে ভোট হয়?”
জাঠ পঞ্চায়েত নেতার প্রশ্ন শুনে বলিউডের গীতিকার ও কৌতুকশিল্পী বরুণ গ্রোভারের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। বরুণ এক বার কটাক্ষ করে বলেছিলেন, বিহার-উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যের মানুষকে জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট করা যাবে না বললে তাঁরা ভারী মুশকিলে পড়বেন। জাতপাত না দেখে ভোট দিতে হবে? তা হলে কী দেখে ভোট দেব? সরকার কেমন কাজ করেছে? চাকরিবাকরি হয়েছে কি না? রাস্তাঘাট ঠিক আছে কি না? বিরোধীরা কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে? এত সব দেখে ভোট দিতে হবে!
কয়েক দিন পরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। ৬ ও ১১ নভেম্বর ভোটগ্রহণ। ১৪ নভেম্বর ফলপ্রকাশ। বিহারে এই জাতপাতের অঙ্ক সবচেয়ে কঠিন। জাতের ভিত্তিতে ভোট টানার কঠিন প্রতিযোগিতা চলে বিহারের মাটিতে। বিহারের ভোটকে ‘দ্য মাদার অব অল ইলেকশনস’ বলার হয়তো এটি অন্যতম কারণ। অন্য বারের তুলনায় বিহারে এনডিএ-র সামনে চ্যালেঞ্জ বেশ শক্ত। এনডিএ-র প্রধান শরিক জেডিইউ-এর মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার ঠিক নিজের ‘ফর্ম’-এ নেই। বিরোধীদের মহাগঠবন্ধনের অন্যতম শরিক সিপিআই (এমএল) লিবারেশন অনেক দিন ধরেই খেটে খাওয়া প্রান্তিক সমাজের মানুষের ভোট টানতে চাইছে। প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টিও একই ভাবে স্থিতাবস্থা বদলাতে মরিয়া। খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে তাদের লক্ষ্য তরুণ ভোটার— যাঁরা ভোট দিতে যাওয়ার সময় জাতপাতকে তুলনায় কম গুরুত্ব দেন বলে মনে করা হয়। অনেকটা মহিলা ভোটারদের মতো।
খালি চোখে দেখলে মনে হবে, বিহারে চাকরির অভাব, রুটি-রুজির খোঁজে রাজ্যের মানুষের পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদিই যে কোনও নির্বাচনের প্রধান বিষয় হওয়া উচিত। বিহারে বেকারত্বের হার জাতীয় গড়ের থেকে অনেক বেশি। দেশে এমন কোনও রাজ্য নেই, যেখানে বিহারের পরিযায়ী শ্রমিক মেলে না। কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়াকে বিহারে ‘পলায়ন’ বলা হয়। চলতি বছরের গোড়ায় রাজ্যে নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়মের বিরুদ্ধে বিহারের পড়ুয়ারা দু’মাস ধরে অনশন-আন্দোলন করেছিলেন। এই বেকারত্বের সমস্যার সমাধান কী ভাবে হবে, কী ভাবে ‘পলায়ন’ রোখা হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বাগ্বিতণ্ডার বদলে সব দলই ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বা জাতপাতের ভিত্তিতে কী ভাবে ভোট টানা যায়, তার হিসাব কষতে ব্যস্ত।
বিহারে মুসলিম ভোটের হার প্রায় ১৭.৭ শতাংশ। হিন্দু ভোটের মূলত পাঁচটি ভাগ। জেনারেল বা উচ্চবর্ণ, যাদব ও অন্যান্য ওবিসি বা পিছড়া, অতি পিছড়া বা ইবিসি, দলিত ও জনজাতি। হিন্দু ভোটের মধ্যে ইবিসি বা অতীব অনগ্রসরদের ভাগ সর্বাধিক— প্রায় ৩৬%। তার পরেই ওবিসি: হিন্দু ভোটের প্রায় ২৭.১২%। হিন্দুদের মধ্যে উচ্চবর্ণের ভাগ ১৫.৫২%, দলিত ১৯% ও জনজাতি ১.৬৮%।
বিহারের তিন প্রধান শক্তি জেডিইউ, আরজেডি ও বিজেপি-র যে কোনও নেতা বলবেন, বিহারের ভোটে শেষ পর্যন্ত জাতপাতের অঙ্কই আসল। বিজেপি জাতপাতের মণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলায় সব হিন্দুকে এক ছাতার তলায় আনতে কমণ্ডলের রাজনীতি শুরু করেছিল। কিন্তু বিজেপি বিহারে নীতীশ কুমারকেই এনডিএ-র মুখ করেছে। তার কারণ নীতীশ জাতপাতের অঙ্কে তাঁর নিজের জাত কুর্মি বা কোয়েরী ভোটব্যাঙ্কের ইবিসি, মহাদলিত, কিছুটা সংখ্যালঘু ভোটের সঙ্গে মহিলা ভোটব্যাঙ্ককে যোগ করেছেন। বিহারে মদের উপরে বিধিনিষেধ, স্কুলছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে সাইকেল বিলির মতো প্রকল্পের জন্য জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে মহিলারা নীতীশকে ভোট দিয়ে আসছেন। এ বারও বিহারে ভোটের আগে নীতীশ মহিলাদের জন্য একের পর এক প্রকল্প চালু করেছেন।
নীতীশের জন্য চিন্তার কথা হল, গত কুড়ি বছর ধরে কার্যত টানা মুখ্যমন্ত্রীর আসনে থাকার ফলে একের পর এক বিধানসভা নির্বাচনে জেডিইউ-এর ভোটের হার কমছে। তা সত্ত্বেও বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছে যে, ব্রাহ্মণ, ভূমিহার, কায়স্থ, রাজপুত, বানিয়াদের সঙ্গে যদি কুর্মি, কোয়েরী বা কুশওয়াহা, পাসোয়ান, মুশহর, নিষাদ, তেলি, কুমহার, ধানুক, বঢ়ই, প্রজাপতি, চন্দ্রবংশী, ধোবির মতো অনগ্রসর, অতি অনগ্রসর শ্রেণির ভোটকে এককাট্টা করা যায়, তবে এনডিএ-র ভোটের হার ৪৮ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। বিভিন্ন ছোট ছোট ইবিসি সম্প্রদায়ের ভোট যোগ হলে এনডিএ-র ঝুলিতে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোট আসা সম্ভব।
উল্টো দিকে লালুপ্রসাদ-তেজস্বী যাদবের আরজেডি বরাবরই মুসলিম-যাদব বা এম-ওয়াই ভোটের উপরে নির্ভরশীল। ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনে আরজেডি একক ভাবে অন্য সব দলের তুলনায় বেশি ভোট ও আসন জিতেছিল। কিন্তু এও সত্য, গত দু’দশক ধরে লালুপ্রসাদের পরিবার মুখ্যমন্ত্রীর গদির ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। কংগ্রেস ও বাম দলের সঙ্গে জোট বেঁধেও তা সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে আরজেডি-কে এখন মুসলিম-যাদব ভোটব্যাঙ্কের বাইরে ভোটের সন্ধান করতে হচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব বেশ কিছু দিন ধরে ‘পিডিএ’ সূত্রের কথা বলছেন— অর্থাৎ, ‘পিছড়া, দলিত, অল্পসংখ্যক’ বা ওবিসি, দলিত ও মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে এককাট্টা করা। বিহারে আরজেডি সেই সূত্র মেনে মাই-বাপ বা এমওয়াই-বিএএপি সূত্রের কথা বলছে। যার মধ্যে আরজেডি-র এম-ওয়াই বা মুসলিম-যাদব ভোট থাকবেই; সঙ্গে থাকবে বহুজন, আঘাড়া বা উচ্চবর্ণ, আধি আবাদি বা মহিলা ও গরিব ভোটব্যাঙ্ক। তাই চিরাচরিত যাদব-মুসলিমদের বাইরে অন্য সম্প্রদায়ের থেকেও তেজস্বী প্রার্থী বাছছেন। যাদব সম্প্রদায়ের বাইরে গিয়ে ইবিসি-ভুক্ত ধানুক সম্প্রদায়ের মঙ্গানিলাল মণ্ডলকে বিহারের রাজ্য সভাপতি করেছে আরজেডি। মুকেশ সাহনির বিকাশশীল ইনসান পার্টিকে বিরোধী জোটে টেনে নিয়ে এসে তেজস্বী যাদব আশা করছেন, গঙ্গার ধারে বসবাসকারী মাল্লা বা কৈবর্ত সম্প্রদায়ের ভোট মিলবে। বিজেপি চিরাগ পাসোয়ানকে সঙ্গে রেখে দলিত পাসোয়ান সম্প্রদায়ের ভোট ঝুলিতে পুরতে চাইছে। আরজেডি তেমনই সিপিআই-এমএল লিবারেশন সঙ্গে থাকায় বিরোধী জোটে পাসোয়ান ও মাঝি বাদে অন্যান্য দলিত সম্প্রদায়ের ভোট পাওয়ার হিসাব কষছে।
কংগ্রেসও জাতপাতের অঙ্কে পিছিয়ে নেই। বিহারের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি করা হয়েছে রাজেশ রামকে, যিনি দলিতদের মধ্যে রবিদাস বা জাটভ সম্প্রদায়ের নেতা। এত দিন এই সম্প্রদায়ের তেমন কোনও নেতা বিহারের রাজনীতিতে ছিলেন না। কংগ্রেস সেই ফায়দা তুলতে চাইছে।
এর পরেও অবশ্য জেডিইউ-বিজেপি ও অন্যান্য দলের এনডিএ জোট জাতপাতের অঙ্কে এগিয়ে থাকবে। কারণ, এনডিএ-তে সব সম্প্রদায়ের নেতা রয়েছেন। যেমন নীতীশ নিজে কুর্মি সম্প্রদায়ের নেতা। তার সঙ্গে তিনি ইবিসি ভোট টানবেন। বিজেপির নেতা সম্রাট চৌধরি ও রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চা-র উপেন্দ্র কুশওয়াহা এনডিএ-র ঝুলিতে কুশওয়াহা ও কোয়েরী ভোট যোগ করবেন। চিরাগ পাসোয়ান দুসাধ পাসোয়ান সম্প্রদায়ের ভোট টানবেন। আর হিন্দুস্তান আওয়ামি মোর্চা-র জিতনরাম মাঝি মুশাহর বা মহাদলিত ভোট নিয়ে আসবেন।
বিহার কি এ বারও বেকারত্ব, পেট চালাতে ভিটেমাটি ছাড়া, উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার মতো প্রশ্ন ভুলে এই জাতপাতের অঙ্ক মেনেই ভোট দেবে? না কি শিক্ষা, শিল্প, কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দেবে? শুধু জেডিইউ, আরজেডি, বিজেপি, কংগ্রেস নয়— বিহারের ভোটে রাজ্যের মানুষকেও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)