E-Paper

‘পিছন দিকে এগিয়ে যান’

২০১১-১২ সালে মাথাপিছু আয়ে রাজস্থান পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এগিয়ে ছিল ১১ শতাংশ। গত দেড় দশকে সেই ব্যবধান বেড়ে ২০২৪-২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে।

অশোক কুমার লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৪৩

ভারতের পূর্বাঞ্চলে পাঁচটি বড় রাজ্য— অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ। এই পাঁচটির মধ্যে, তুলনামূলক এবং প্রথাগত ভাবে, আমাদের বিশ্বাস যে, পশ্চিমবঙ্গই সবচেয়ে উন্নত। পাঁচ বছর আগে পর্যন্ত এই ধারণা যথাযথ ছিল। ২০২০-২১ সালেও, আমাদের প্রতিবেশী ওড়িশা রাজ্যের বাৎসরিক মাথাপিছু আয় (পার ক্যাপিটা এনএসডিপি) ছিল ১,০৩,২১১ টাকা— পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় ১,০৫,১০৮ টাকার চেয়ে সামান্য হলেও কম। কিন্তু ২০২১-২২ সালে, মাথাপিছু আয়ে ওড়িশা (১,৩৩,৭৬৮ টাকা) পশ্চিমবঙ্গকে (১,২২,৮৮৩ টাকা) ছাড়িয়ে যায়, এবং পরবর্তী তিন বছরেও এগিয়ে থাকে। আমাদের রাজ্য পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে উন্নত রাজ্য আর নেই। প্রথাগত চিন্তার পরিবর্তনের সময় এসেছে।

বাঙালির আরও একটি ভুল ধারণার উদাহরণ রাজস্থান। রাজস্থান বললেই ভ্রমণবিলাসী বাঙালির মানসচক্ষে ভাসে মরুসঙ্কীর্ণ, প্রাচীন দুর্গ দিয়ে ঘেরা, ছুটির সময় পর্যটনের একটি রাজ্যের খাসা ছবি— কানে বেজে ওঠে সোনার কেল্লা-র আবহসঙ্গীতের সুর। যেখান থেকে বহু শতক ধরে মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা বাংলায় এসেছেন দলে-দলে, লক্ষ্মীর খোঁজে। আমরা যেটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করিনি, সেটা হচ্ছে, ২০১১-১২ সালে মাথাপিছু আয়ে রাজস্থান পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এগিয়ে ছিল ১১ শতাংশ। গত দেড় দশকে সেই ব্যবধান বেড়ে ২০২৪-২৫ সালে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে। আবারওমনে করিয়ে দিই, আমাদের প্রথাগত চিন্তার পরিবর্তন জরুরি।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে প্রথাগত চিন্তার এই পরিবর্তনের স্বপ্ন তো মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পনেরো বছর আগে দেখাননি। যেটা দেখিয়েছিলেন, সেটা ‘এগিয়ে বাংলা’র স্বপ্ন। কোথায় সেই ‘এগিয়ে বাংলা’? ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে, সময় এসেছে হিসাব-নিকাশ করার। ১৫ বছরে পশ্চিমবঙ্গ কী পেয়েছে, আর কী পায়নি, তার। পরিসংখ্যানে গেলে, কারেন্ট মার্কেট প্রাইসেস বা চালু বাজারদরের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় ২০১১-১২ সালের ৫১,৫৪৩ টাকা থেকে ৩.১৭ গুণ বেড়ে ২০২৪-২৫ সালে ১,৬৩,৪৬৭ টাকা হয়েছে। মনে হতেই পারে, বাহ্, বেশ তো, কত বৃদ্ধি! তবে সবই আপেক্ষিক ব্যাপার। যতটা এগোনো উচিত ছিল, পশ্চিমবঙ্গ ততটা এগিয়েছে কি? এগিয়েছে কি দেশের অন্যান্য ‘সফল’ রাজ্যের তুলনায়— যেমন, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র বা গুজরাত? পশ্চিমবঙ্গের আসল পরিস্থিতি ধরা পড়ে এই তুলনামূলক বিশ্লেষণে।

২০১১-১২ থেকে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ভারতের মাথাপিছু আয় ৬৩,৪৬২ টাকা থেকে ৩.২৪ গুণ বেড়ে ২০২৪-২৫ সালে ২,০৫,৩২৪ টাকা হয়েছে। ২০১১-১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের মাথাপিছু আয় দেশের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ কম ছিল; ২০২৪-২৫’এ সেই ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশে। দেশের মাথাপিছু আয়ের হিসাবের মধ্যে তো সব রাজ্যই রয়েছে— তামিলনাড়ু এবং মহারাষ্ট্র যেমন আছে, তেমনই বিহার ও উত্তরপ্রদেশও রয়েছে। আমরা কি আমাদের রাজ্যের তুলনা বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে করব, না কি করব অগ্রণী রাজ্যগুলির সঙ্গে?

পশ্চিমবঙ্গের তুলনামূলক অবনমনের সূচনা অবশ্য তৃণমূলের শাসনের আগেই হয়েছে। অনেকগুলি রাজ্যের মাথাপিছু আয় ২০১১-১২ সালেই ছিল আমাদের দ্বিগুণেরও বেশি। সেগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি ২০২৪-২৫ সালে আরও এগিয়ে গিয়েছে। যেমন, ২০১১-১২ সালে হরিয়ানায় মাথাপিছু আয় ছিল পশ্চিমবঙ্গের ২.০৬ গুণ; ২০২৪-২৫ সালে সেটি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ২.১৬ গুণ। কর্নাটক এবং তামিলনাড়ু ২০১১-১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের থেকে মাথাপিছু আয়ে এগিয়ে ছিল যথাক্রমে ৭৫ শতাংশ এবং ৮১ শতাংশ; ২০২৪-২৫ সালে সেই অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২.৩৩ গুণ এবং ২.১৯ গুণ। অন্ধ্রপ্রদেশ ২০১১-১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের থেকে মাথাপিছু আয়ে এগিয়ে ছিল ৩৪ শতাংশ— ২০২৪-২৫ সালে এগিয়ে আছে ৬৩ শতাংশ। আর ওড়িশার কথা তো আগেই বলেছি— ২০১১-১২ সালে সে রাজ্য মাথাপিছু আয়ে পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে ৬ শতাংশ পিছনে ছিল— ২০২৪-২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১২ শতাংশ এগিয়ে আছে। কলকাতার বাস কন্ডাকটরদের ভাষায় পশ্চিমবঙ্গ শুধুই পিছন দিকে এগিয়ে চলেছে।

শুধু মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যানে নয়, অবক্ষয়ের নমুনা অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কাতারে-কাতারে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে, এমনকি দিনমজুর হিসাবে কাজ করতে। ভিন প্রদেশ থেকেও কিছু মানুষ আসছেন পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে— কিন্তু, তাঁদের সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁরা যাচ্ছেন তাঁদের তুলনায় কম। কোভিড অতিমারির সময় ফেরত আসা বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকের যে অবিরাম মিছিল আমরা দেখেছি, সে রকম বাংলা থেকে অন্যান্য প্রদেশে প্রত্যাবর্তী শ্রমিকের মিছিল দৃষ্টিগোচর হয়নি।

শুধু রুজি-রোজগারের জন্য নয়, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্যও পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র এবং রোগীরা যাচ্ছেন দূর দূরান্তে— বেঙ্গালুরু, ভেলোর, চেন্নাই, মুম্বই, এমনকি ভুবনেশ্বরে। দুরূহ পারমাণবিক পদার্থবিদ্যা চর্চা করতে নয়, এমনকি ডাক্তারি এবং এঞ্জিনিয়ারিং পড়তেও নয়— নিতান্ত বিএ, এমএ, এমনকি নার্সিং পড়তেও এখন এ রাজ্যের ছেলেমেয়েদের অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও তো তাই— অসুস্থতা সামান্য জটিল হয়ে উঠলেই আমরা আর এই রাজ্যের পরিকাঠামোর উপরে ভরসা করতে পারি না, সটান চেন্নাই বা মুম্বইয়ের ট্রেনে চেপে বসি।

উন্নয়নের পরিবর্তে কেন এই অবক্ষয়? এর মূল কারণ কি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরবর্তী নির্বাচনে জয়ের উপরে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ? নির্বাচনী কৌশল সম্বন্ধে তাঁর পরম বিচক্ষণতার প্রয়োগ? নির্বাচনের ময়দানে তিনি প্রবল পরাক্রম দেখিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। কখনও কন্যাশ্রী, কখনও লক্ষ্মীর ভান্ডার, কখনও দুর্গাপূজার কমিটিগুলিকে লক্ষাধিক টাকা দিয়ে, ফি বছর ‘বেঙ্গল গ্লোবাল বিজ়নেস সামিট’ অনুষ্ঠান করে মানুষকে আপ্লুত করেছেন। কোথাও কোনও সমস্যা তৈরি হলে তিনি তৎক্ষণাৎ ‘অপরাধী’কেও চিহ্নিত করে ফেলেছেন— যেমন, কলকাতার রাস্তায় জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু হলে বেসরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাকে, উত্তরবঙ্গে বন্যা হলে কেন্দ্রীয় সরকারকে বা বিদেশি রাষ্ট্র ভুটানকে দায়ী করেছেন। এই সমস্ত চোখধাঁধানো কাণ্ডে বাঙালি কুপোকাত হয়ে গেছে। দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য কী প্রয়োজন, সে প্রশ্ন তোলার অবকাশই পায়নি। আজ, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই প্রশ্ন উত্থাপনের প্রশস্ত সময়।

অবক্ষয়ের মৌলিক কারণ দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য যে খাতে যত অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন, তার অবহেলা— মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিকাঠামো খাতে এ রাজ্যে সরকারি ব্যয় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আর, যতটুকু অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও অপচয় এবং দুর্নীতি এড়িয়ে দক্ষ ভাবে ব্যয় করার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক উদাসীনতার কথাও একই সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই দ্বিমুখী উপেক্ষার ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আমাদের রাজ্যের ‘সাপ্লাই সাইড’ বা জোগানের দিকটা শক্তিশালী হবে না; এবং ‘ডিমান্ড সাইড’ বা চাহিদার দিকটা সরকার লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো জনমুখী প্রকল্পের মাধ্যমে যতই মজবুত করুক না কেন, সেই অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে জোগান আসবে ভিন রাজ্য থেকে। দীর্ঘস্থায়ী দ্রুত উন্নয়ন হয়নি এবং হবে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে যথেষ্ট রাজস্ব আসবে না, জনমুখী প্রকল্পের উপরে অর্থ ব্যয় করার মতো আর্থিক সঙ্গতি সরকারের থাকবে না।

আর, তার পরও ব্যয় করতে থাকলে, রাজকোষ ঘাটতি এবং ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। রাজকোষ সঙ্কট অবধারিত হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যেই সেই সঙ্কটের কিছু পূর্বাভাস আমরা পেয়েছি বকেয়া মহার্ঘ ভাতা ও ঠিকাদারদের পাওনায়, সরকারি শূন্য পদের সংখ্যায়, এবং পুলিশের বদলে অপ্রশিক্ষিত সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগে। এ বার এই নীতি পরিবর্তন করে বাংলার দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির দিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে।

বিধায়ক, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

bengal Economy Development Employment

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy