E-Paper

কূটনীতি অতি বিষম বস্তু

চিনের কূটনীতিতে ‘তিয়ানশিয়া’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিনা ভাষার এই শব্দের অর্থ, স্বর্গের নীচে সব কিছু। চিনের প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী, স্বর্গের নীচে একটাই জগৎ, একটিই মানবজাতি।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৬:৪৫
কূট-মুহূর্ত: প্রধানমন্ত্রী মোদী ও চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, তিয়ানজিন, ৩১ অগস্ট।

কূট-মুহূর্ত: প্রধানমন্ত্রী মোদী ও চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, তিয়ানজিন, ৩১ অগস্ট। ছবি: পিটিআই।

চিনের ফুজিয়ান শি জিনপিংয়ের কর্মভূমি বলে পরিচিত। বছর পঁচিশেক আগে তিনি ফুজিয়ানের গভর্নর হিসেবে গোটা প্রদেশের ভোল বদলে দিয়েছিলেন। এখান থেকেই তাঁর চিনের প্রেসিডেন্টের পদে উত্তরণের শুরু। এই ফুজিয়ানের উলং চা ও চা-চক্রের সুখ্যাতি দুনিয়া জোড়া। এমনই একটি চা-চক্রে চিনের এক কূটনীতিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ‘তিয়ানশিয়া’ শব্দ নিয়ে।

চিনের কূটনীতিতে ‘তিয়ানশিয়া’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিনা ভাষার এই শব্দের অর্থ, স্বর্গের নীচে সব কিছু। চিনের প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী, স্বর্গের নীচে একটাই জগৎ, একটিই মানবজাতি। আমেরিকা, ইউরোপ মনে করে, চিন আসলে এই মন্ত্র নিয়ে গোটা দুনিয়ার নিয়ন্ত্রক হতে চায়। কথাটা শুনে চিনের কূটনীতিক আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন, ভারতের এই আমেরিকার মতো তৃতীয় পক্ষের দেওয়া তথ্য পড়ে চিনকে চেনার অভ্যাসটা ছাড়তে হবে। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, এই ভুল ব্যাখ্যা এড়াতেই আজকের দিনে চিনের কূটনীতিতে ‘তিয়ানশিয়া’-র বদলে ‘রেনলেই মিনগিউন গংটংটি’ শব্দবন্ধ ব্যবহার হয়। যার অর্থ, গোটা মানবজাতির অভিন্ন ভবিষ্যৎ। শি জিনপিংয়ের কূটনীতির প্রধান মন্ত্র।স্বাভাবিক নিয়মেই প্রশ্ন ছিল, শি জিনপিং কি গোটা মানবজাতির ভবিষ্যতের রক্ষাকর্তাবিধাতা হয়ে উঠতে চান? চিন কি গোটা বিশ্বের অধীশ্বর হতে চায়? জবাবে চিনা কূটনীতিক বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তো ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর কথা বলেন। গোটা বিশ্ব একটিই পরিবার। এ কথা বলার অর্থ কি ভারত গোটা বিশ্ব দখল করতে চায়?

এ সব গত এপ্রিল মাসের কথা। চিনে তখন বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা শীত। ভারত-চিন সম্পর্কে তখনও শৈত্য। ভারত থেকে চিনে যাওয়ার সরাসরি বিমান বন্ধ। ব্যাঙ্কক থেকে বিমান বদলাতে হয়। যদিও তার মাসখানেক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারত-চিনের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতে পারে, কিন্তু সংঘাত হওয়া উচিত নয়। মতান্তর হতে পারে, কিন্তু মতবিনিময়ে ভরসা রাখতে হবে। চিনের সংবাদপত্র তাতে স্বাগত জানিয়েছে। ইঙ্গিত মিলছে, অদূর ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বরফ গলতে চলেছে।

পূর্বাভাস সঠিক ছিল। সাত বছর পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী চিন সফর করে ফিরলেন। তিয়ানজিনে তাঁর সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বৈঠক হল। বৈঠকের পরে দু’দেশই বিবৃতিতে জানাল, চিন ও ভারত ‘সহযোগী, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়’।

গলওয়ানে ২০২০-তে চিনের আগ্রাসন এবং চিনের সেনার সঙ্গে সংঘর্ষে ভারতের অন্তত কুড়ি জন জওয়ানের মৃত্যু কি ধামাচাপা পড়ে গেল! ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সময় চিন পাকিস্তানকে ভারতের প্রতিটি সামরিক পদক্ষেপের খবর দিয়ে মদত করছিল বলে উপ-সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল সিংহ অভিযোগ তুলেছিলেন। তার পরে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে নরেন্দ্র মোদী এ সব প্রসঙ্গ তুলেছেন কি না, তা জানা যায়নি। তার বদলে মোদী-জিনপিংয়ের করমর্দনকে এখন ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কড়া বার্তা’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল কেনার ‘অপরাধ’-এ জরিমানা হিসাবে ট্রাম্প ভারতের উপরে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়েছেন। তাই এখন চিনের সঙ্গে ‘চায়ে পে চর্চা’ জরুরি বলে যুক্তি সাজানো হচ্ছে।

বাস্তব হল, ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন করে ক্ষমতায় আসার আগেই গত বছর অক্টোবরে রাশিয়ার কাজ়ানে ব্রিকস সম্মেলনের সময় মোদী ও শি-র বৈঠক হয়েছিল। সেখানেই ভারত চিনের সঙ্গে ‘স্থিতিশীল, নিশ্চিত ও বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্কে রাজি হয়েছিল। তখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্টও হননি। শুল্কের ঘোষণাও করেননি।

প্রশ্ন হল, ভারত ও চিনের মধ্যে সম্পর্ক কতখানি বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া সম্ভব? না কি দু’দেশের সম্পর্ক একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই আটকে থাকবে? নরেন্দ্র মোদীর চিন সফরের সলতে পাকাতে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালরা আগেই চিন সফর করে এসেছেন। একই সময়ে চিনের এক দিকে ভারতের ক্ষেত্রে আর্থিক চাপের নীতি, অন্য দিকে পাকিস্তানকে সামরিক মদত থেকে স্পষ্ট, দু’দেশের সম্পর্কে বরফ গললেও তার ভিত যথেষ্ট দুর্বল।

ট্রাম্প ভারতের উপরে শুল্ক চাপিয়েছেন। কিন্তু তার আগে চিন ভারতে আইফোন তৈরির কারখানা থেকে ৩০০ জন ইঞ্জিনিয়ারকে সরিয়ে নিয়েছিল। যাতে ভারতের কর্মীদের প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির হাতবদলে বাধা আসে। চিন কখনও চায় না, উন্নত প্রযুক্তির কারখানা ভারত বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশে সরে যাক। তাই একটা সীমার বাইরে চিন ভারতের হাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও তুলে দেবে না। এই প্রযুক্তি নির্ভর উৎপাদনে ভর করেই চিন আমেরিকার পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে উঠে এসেছে। ভবিষ্যতে আমেরিকাকে টপকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বেজিং কোনও ভাবেই চাইবে না, ভারতও একই ভাবে চিনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলুক। একই ভাবে চিন ভারতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সার রফতানিতে লাগাম টেনেছে। ভারত যখন ইলেকট্রিক গাড়ি উৎপাদনে জোর দিতে চাইছে, তখন তার জন্য প্রয়োজনীয় বিরল খনিজ রফতানিতে চিন বিধিনিষেধ জারি করেছে। অপারেশন সিঁদুর-এর সময় পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষ মদত করে চিন বুঝিয়ে দিয়েছে, ভারতকে চাপে রাখতে বেজিং ইসলামাবাদকে কৌশলগত ভাবে কাজে লাগাবে। সামরিক দিক থেকে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশের বেশি যুদ্ধাস্ত্র চিন থেকে আসে। উল্টো দিক থেকে দেখলে, চিনের যুদ্ধাস্ত্র রফতানির ৬০ শতাংশের বেশি পাকিস্তানে যায়। ফলে ভারতের শুধু উত্তরে নয়, পশ্চিম সীমান্তেও ড্রাগন মুখোশ পরে হাজির। কূটনৈতিক ভাবে চিন ভারতের আশেপাশে সমস্ত প্রতিবেশী দেশে বহু বছর ধরেই প্রভাব বিস্তার করেছে। চিন-অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে চিন-পাকিস্তান আর্থিক করিডরকে বেজিং এখন আফগানিস্তান পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইছে। তার জন্য ইসলামাবাদ ও কাবুলের তালিবান প্রশাসনের মধ্যে মধ্যস্থতাও করতে চাইছে বেজিং। যার একটাই অর্থ। চিন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাকি দেশের সঙ্গে ভারতকেও নিজের তাঁবেদার করে রাখতে চায়।

আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সংঘাতের প্রেক্ষিতে চিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির প্রয়োজন বলে এখন যুক্তি সাজানো হচ্ছে। এ কথা ঠিক, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার কৃষি ও ডেয়ারি পণ্যের জন্য ভারতের বাজার খুলে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তার কারণ হল, ভারত আমেরিকা থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তার থেকে অনেক বেশি ভারতীয় পণ্য আমেরিকায় রফতানি হয়। এই ফারাক প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলারের। উল্টো দিকে, ভারত থেকে চিন যত পণ্য আমদানি করে, তার থেকে ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি পণ্য চিন ভারতের বাজারে রফতানি করে। শুধু সস্তার খেলনা নয়। তার মধ্যে একটা বড় অংশ হল শিল্পের কাঁচামাল ও চাষের সার। চিন যার জোগান বন্ধ করে দিলে এ দেশের কৃষি ও শিল্প একই সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়বে। ‘স্বদেশি পণ্য’-র আবেগ দিয়ে সেই পতন ঠেকানো যাবে না।

এত দিন ভারতের অবস্থান ছিল, চিনের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে হলে আগে গলওয়ানে চিনের সেনাকে ২০২০-র আগের অবস্থানে পিছু হটতে হবে। কিন্তু এখন ভারত নতুন কূটনৈতিক পরিভাষায় শুধু সীমান্তে ‘শান্তি ও স্থিতাবস্থা’ চাইছে। লাদাখে চিনের সেনার ভারতের জমি দখলের ফলে যে সব ‘বাফার জ়োন’ তৈরি হয়েছে, সেখানে ভারতের সেনা কবে আগের মতো টহলদারির অধিকার পাবে, সেই প্রশ্নের এখনও মীমাংসা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন ঠিকই যে, ভারত পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে সম্পর্কের উন্নতিতে দায়বদ্ধ। বাস্তব হল, এক দিকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় চিনের সেনার আগ্রাসন ও অন্য দিকে পাকিস্তানের সেনাকে মদত চিন সম্পর্কে অবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

হতে পারে, ভারত, চিনের মধ্যে আবার সরাসরি বিমান পরিষেবা শুরু হতে চলেছে। আগের পর্যটকদের জন্য ফের ভিসা চালু হবে। ইতিমধ্যেই কৈলাস মানস সরোবর যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু এর আগেও নরেন্দ্র মোদী শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সবরমতীতে এক সঙ্গে দোলনায় দুলে, উহানে এক সঙ্গে নৌকায় চড়ে বা মামাল্লাপুরমের সমুদ্র সৈকতে এক সঙ্গে ডাবের জলে চুমুক দিয়ে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়াতে চেয়েছেন। বদলে মিলেছে সীমান্তে চিনের সেনার আগ্রাসন। ২০০৫-এ দু’দেশের চুক্তিতে বলা হয়েছিল, সীমান্ত বিবাদ সার্বিক ভাবে সমাধানের চেষ্টা হবে। তিয়ানজিনে মোদী-শি বৈঠকের প্রাক্‌পর্বে ভারত এখন যে সব জায়গায় আগে বিবাদের নিষ্পত্তি সম্ভব, সেখানে বোঝাপড়ায় যেতে রাজি হয়েছে। অথচ চিন তিব্বতে ব্রহ্মপুত্র বা ইয়ারলুং সাংপোতে বিশাল বাঁধ নির্মাণ নিয়ে ভারতের উদ্বেগ দূর করতে কোনও আশ্বাস দিতে রাজি হয়নি।

মোদী-জিনপিংয়ের হাসিমুখে ছবি দেখে অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্পকে বেশ বিপদে ফেলা গেল। তাঁদের মনে রাখা উচিত, চিন ভারতকে বরাবর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাপকাঠিতেই দেখবে। কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় তৈরির চেষ্টা শুরু হলেও ড্রাগন-হাতির ‘ট্যাঙ্গো’ এখনও দিবাস্বপ্ন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Diplomacy Narendra Modi Xi Jinping

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy