Advertisement
০৩ মে ২০২৪
মেলা থেকে আসছি...

আগুনে জ্বলেনি, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে কি মুছে যাবে বইয়ের গন্ধ?

পাঠককেও প্রস্তুত হতে হবে, যোগ্য হয়ে উঠতে হবে লেখকের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখাটি বার করে আনার জন্য।

অপরাজিতা দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২২ ০৬:২১
Share: Save:

গত দু’বছর ধরে অতিমারি দখল নিয়েছিল আমাদের নিশ্চিন্দিপুরের নৈমিত্তিক জীবনযাপনের, তাই এখন আর কিছুই তেমন নিশ্চিত নয়। তবু কান পাতলে মাস কয়েক আগে থেকেই জোর ফিসফাস শোনা যাচ্ছিল, এ বার হচ্ছে তা হলে, না কি পিছিয়ে যাবে আবারও? অবশেষে দু’বছরেরও বেশি প্রতীক্ষার পরে মুখ্যমন্ত্রী যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রদীপটি জ্বাললেন, তা যেন সত্যিই আশার প্রদীপ।

স্টলে যাঁরা বসেন, প্রতিনিয়তই তাঁদের দুরুদুরু বক্ষ, আজ ভাল বিক্রিবাটা হবে তো? মেলা শেষের মুখে, দৈনিক দশ ঘণ্টা করে কঠোর পরিশ্রম করা কর্মীদের মুখে ক্রমে আশার আলো। কম্পিউটার দেখে যে তরুণ কর্মীটি দৈনন্দিন বিক্রির হিসাব জানায়, সে যুদ্ধজয়ের হাসি হেসে বলে যায়, “আজ গত বারের সেল ক্রস করে গেল।”

সত্যিই এ বারের মেলায় বই বিক্রির রেকর্ড। গিল্ডের হিসাব অনুযায়ী বেশির ভাগ প্রকাশকেরই বিক্রি বেড়েছে গড়ে পনেরো শতাংশ। সত্যিই এ কয় দিন চিংড়িঘাটার মোড় থেকে গাড়ি এগিয়েছে পিঁপড়ের মতো, করুণাময়ীর মোড়ে চলেছে ব্যাপক যানজট। মেলার মাঠে, যত দূর দেখা যায়, কাতারে কাতারে মাথা। প্রিয় স্টলগুলিতে ঢোকার বিসর্পিল লাইন, খ্যাতিমান লেখক ও অন্যান্য জগতের খ্যাতনামাদের কিছু স্টলের বাইরে বসিয়ে অবিরাম সইবণ্টন আর নিজস্বী তোলার আবদার পূরণ, মাঠে সেলেবদের পদার্পণ ঘটলেই তক্কে তক্কে থাকা টিভি ক্যামেরার হইহই করে তাঁদের অভিমুখে তেড়ে যাওয়া, চা চপ রোল ফুচকার দেদার বিকোনো, এমনকি ভল্লুকের পোশাক পরে কোনও স্টলের বই কিনতে ‘উদ্বুদ্ধ’ করা— এ সব কোনও উপকরণেরই অভাব ঘটেনি। কোভিড পরিস্থিতিতে বিস্তর কাটছাঁট করতে হয়েছে, অনেক স্টলেরই আয়তন হয়ে গেছে অর্ধেক বা তারও কম, অবস্থাগতিকে এবং স্থানাভাবে অনেক প্রকাশককেই বেছে নিতে হয়েছে আত্মপ্রকাশের ছোট ছোট কোণ। তবু গানে গল্পে ঘোষণায় আড্ডায় তর্কে এ বারের বইমেলা জমে গিয়েছে দিব্য।

এ বারের বইমেলার ‘থিম কান্ট্রি’ বাংলাদেশের বহু বিশিষ্ট মানুষ, আমলা, মন্ত্রী, সাংসদরা উপস্থিত ছিলেন মেলায়, ছিলেন সে দেশের শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, কলকাতা বইমেলায় যাঁর এই প্রথম আসা। তাঁর অভিজাত বৈদগ্ধ ভারী মনোরম এক আলো ছড়াচ্ছিল। তাঁর ব্যস্ততারও শেষ নেই মেলায়। ভিড় ঠেলে পায়ে হেঁটে অডিটোরিয়াম থেকে বইয়ের স্টলে আসতেই নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিলেন উনি। ভিড়-ক্লান্ত, ভিড়-অভিভূত গলায় শুধিয়েছিলেন, “এই যে বললেন দু’মিনিটের পথ?”

বইমেলা অবশ্য স্মৃতির সরণি বেয়ে পিছনে তাকানোরও সময়, মনের কোণে উঁকি দেয় আমাদের ছোটবেলার ময়দানের মেলার স্মৃতি। মনে পড়ে সেখানে সবুজ ঘাসের উপর জমে-ওঠা সাহিত্যের আড্ডা, সুনীল শক্তি তারাপদ বুদ্ধদেবদের ঘিরে উৎসাহী কবি-লেখকের ভিড়, পাঠকের কৌতূহল, মাঝেমধ্যে ধুতি বা পাজামা-পাঞ্জাবিতে সুসজ্জিত হয়ে দীর্ঘদেহী সমরেশ বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ঝোলা কাঁধে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে যাওয়া। মা’র কলেজের বামপন্থী ছাত্রনেত্রী শিখাদি দৌড়ে গিয়ে মজলিশ-জমানো সুনীলের হাতেগরম সই-সহ তাঁর জাগরণ হেমবর্ণ বইটি উপহার দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন, মনে পড়ে।

তার পর তো “বইমেলা ধুলো… চেনা মুখগুলো পরিচিত হাসি”— সেই গানের থেকে অনেক পথ হেঁটে এলাম আমরা। ময়দান থেকে মিলনমেলা হয়ে সেন্ট্রাল পার্ক পর্যন্ত যাত্রায় একাধিক বার নবকলেবর প্রাপ্তি। গত দু’বছরে পুরনো চেনা মুখেরা অনেকে অদৃশ্য, নতুন প্রজন্মের নতুন চেনা মুখের হাসিতেই ক্রমশ অভ্যস্ত হয়েছি আমরা। তবু পুরনো বইমেলার রেশ ফিরে আসতে থাকে বহু অনুষঙ্গে।

যাঁর জনপ্রিয়তা বাংলা-পাঠকবিশ্বে এখনও অব্যাহত, অষ্টআশির তরুণ সেই মণিশংকর মুখোপাধ্যায় সে দিন অথর্স কর্নারে বসে হাসিমুখে অনুচ্চ কণ্ঠে বলে চলেছিলেন তাঁর লেখকজীবনের ছোট ছোট অ্যানেকডোট। মনে হচ্ছিল পিছু হেঁটে আবার পৌঁছে গিয়েছি সত্তরের দশকে। পাশাপাশি মনস্বী লেখক ও চিন্তাবিদ আশি অতিক্রান্ত চিরনবীন যুবা শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় এ বারের বইমেলাতেও যথারীতি সদাব্যস্ত, বিভিন্ন সভা ও বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে এসে তাঁর সুচিন্তিত মন্তব্য কত দশক ধরেই না শুনছি। আর তাঁরই সহপাঠী ও বাল্যবন্ধু বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত ও বাগ্মী অধ্যাপক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সশরীরে উপস্থিতি অবশ্যই এ বারের বইমেলার বহু অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির মধ্যে একটি। অবাক লাগে এত দীর্ঘ সময় ধরে আশি বছরের এই ‘তরুণী’ একই রকম প্রাণশক্তিতে ভরপুর, যার উদ্দীপনাতেই পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে তাঁর উড়ান, সাহিত্য উৎসবের মূল বক্তৃতা দেওয়া, এবং প্রশ্নোত্তরে শামিল হওয়া। এক অগ্রণী প্রকাশক বলছিলেন, “ওঁকে দেখে সত্যি উৎসাহ ফিরে পাই। ভাবি জীবনের শেষ দিন অবধি কাজ করে যাব।”

কলকাতা সাহিত্য উৎসবে ‘বাংলা সাহিত্য কি এগোচ্ছে না পিছোচ্ছে?’ বিষয়ে শেষ সেশনটিতে সঞ্চালক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় প্রশ্নের মাধ্যমে কিছু ভাবনাকে উস্কে দিতে চাইছিলেন। ধ্রুপদী বা চিরন্তন বলে শনাক্ত করা হয় যে সব সাহিত্যকর্মকে, আজকের বাজারে তাদের আবেদন কতখানি? বাজারে কারা টিকে থাকবেন, জনপ্রিয়তা পাবেন, তার একমাত্র নির্ণায়ক কি পাঠকের চাহিদা এবং সাম্প্রতিক পাঠ-প্রবণতা? পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য কি লেখককে খুঁজে নিতে হবে নতুনতর মাধ্যম, প্রকরণ, বাচনভঙ্গি, নতুন চাহিদা বুঝে সাজাতে হবে কনটেন্ট? চার জন পুরুষ লেখকের সঙ্গে মঞ্চে উপবিষ্ট এক মহিলা লেখক। অনুরাগীর ভিড় ও ধস্তাধস্তি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য তাঁকে ‘বাউন্সার’ নিয়ে চলাফেরা করতে দেখা গেল। দু’দিন আগে এই বইমেলারই একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর এই সময়ের আর এক জনপ্রিয় লেখক-কবিকে কমান্ডো পরিবৃত হয়ে যেতে হচ্ছিল অডিটোরিয়াম থেকে প্রকাশনা সংস্থা, এবং সেখান থেকে গিল্ডের প্রতীক্ষালয়ের সুরক্ষায়। ঈষৎ উদ্‌ভ্রান্ত অবস্থায় কবিকে হেঁটে আসতে দেখে একটু মায়াবোধ ছুঁয়ে যায়। কেন জানি না বহু দূরে চলা যুদ্ধক্ষেত্রের কথা মনে পড়ে যায়। কবিকে তবে যেতেই হবে মিছিলে? সে কবি যতই মৃদু স্বরে বলুন না কেন, “আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।” এই বাজারের ভিড়ে, সামূহিক মানসিকতায়, সেলফি তোলার সস্তা উদ্‌যাপনে, নেপথ্যচারী, নিভৃত লেখকের জায়গা কই? কবির মৃত্যু নেই, কবির মৃত্যু অনিবার্য। জনতার ভিড়ে আক্রান্ত কবির সামূহিক ধ্বংসের অভ্রান্ত চিহ্ন দেখতে পায় নষ্ট চোখ।

১৯৬৬-র ফারেনহাইট ৪৫১ থেকে ২০১৩ সালের দ্য বুক থিফ, এই দুই ছবিই দেখায় নিপীড়ক রাষ্ট্র কী ভাবে বই জিনিসটি বাজেয়াপ্ত করতে চায়, লুকিয়ে রাখা বই খুঁজে বার করে বহ্ন্যুৎসব করে। পাঠক শেষ পর্যন্ত বইকে খুঁজে পায়, এই প্রচ্ছন্ন দর্শন ছড়িয়ে আছে দু’টি সিনেমা জুড়েই। সেই নিপীড়ক রাষ্ট্রের খড়্গ এখন আমাদের কাছেও সমুদ্যত। পঁচিশ বছর আগে বইমেলার সেই আগুনের স্মৃতি মনে পড়ে। বইমেলা সেখান থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল ফিনিক্সের মতো।

আর এখন বৈদ্যুতিন এসে ক্রমশ দখল করছে মুদ্রিত বইয়ের বাজার। বইয়ের ভবিষ্যৎ কি ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, নতুন বইয়ের গন্ধ নেওয়ার স্মৃতি কি মুছে যাবে এক দিন? একশো বছর পরের পৃথিবীতে কী হবে বইয়ের, বিশেষত বাংলা বইয়ের, ভবিষ্যৎ— এই প্রশ্নের উত্তরে গায়ত্রী বলেছিলেন— সম্ভবত বই থেকে যাবে কোনও আদিম ফর্মে। শুনে একটু আশা জাগে। আবার মনে হয়, লেখক যখন লিখতে বসেন, তখন কী ভাবে গড়ে ওঠে তাঁর সঙ্গে তাঁর আরব্ধ লেখাটির সম্পর্ক?

সাহিত্য উৎসবের সূচনায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আরও এক বার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন উপস্থিত শ্রোতাদের, যে সাহিত্যচর্চা শেষ বিচারে এক একাকী পথ। বড় নিঃসঙ্গ পথচারীর আত্মমন্থন। শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল আর এক নিভৃতচারী কবি শঙ্খ ঘোষের কথা। সারা জীবন ধরে চার পাশে জমে-ওঠা সন্তর্পণে দূরে সরিয়েছেন। তুমুল হট্টগোলের মাঝেও নিরুচ্চার টেনে দিয়েছেন নিভৃতির লক্ষ্মণরেখা, যে গণ্ডি পার হওয়ার সাধ্য ছিল না জনতার।

বার্নার্ড শ’র বহুখ্যাত মন্তব্য অনুযায়ী, বুঝদার মানুষ দুনিয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেবেন, কিন্তু অবুঝ, গোঁয়ার মানুষ নিজের আদলে গড়েপিটে নিতে চাইবেন দুনিয়াকে, আর তাই সেই ধরনের মানুষের হাতেই সব সময় এগিয়ে চলার রথের রশি। সাহিত্যস্রষ্টা কি তা হলে মানিয়ে গুছিয়ে নেবেন জগতের চাহিদা অনুযায়ী? না কি পারিপার্শ্বিকই রূপ পাবে, নির্মিত হবে তাঁর হাতে?

আর সে ক্ষেত্রে পাঠককেও প্রস্তুত হতে হবে, যোগ্য হয়ে উঠতে হবে লেখকের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখাটি বার করে আনার জন্য। আপাতত ওই ক্ষীণ আশার আলোকরেখাটুকুই হাতে রয়ে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE