অস্ট্রেলীয় লেখক-গণিতবিদ গ্রেগ ইগানের পারমিউটেশন সিটি উপন্যাসে, পিয়ার নামক চরিত্রটি ভার্চুয়াল জগতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সে তাতে খুব বিরক্ত হয়ে পড়ে। তার পর সে নিজেকে এমন ভাবে পরিবর্তন করে যে, তার নতুন নতুন আগ্রহ তৈরি হয়: এই সে উচ্চতর গণিতের সীমা অতিক্রমে ব্যস্ত, পরমুহূর্তেই অপেরা লিখছে। এক সময় ‘এলিসিয়ানস’ তথা পরকাল নিয়ে তার গভীর আগ্রহ ছিল, পরে তা-ও ফিকে হয়ে যায়। শেষে তার চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় টেবিলের পায়া। এই অস্থিরতা তাকে এক গভীর প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়: প্রযুক্তি যখন মানবজাতির সব মৌলিক সমস্যার সমাধান করে ফেলবে, মানুষের তখন করার মতো আর কী থাকবে?
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক নিক বস্ট্রোম তাঁর বই ডিপ ইউটোপিয়া-তে এ নিয়ে ভেবেছেন। আগের বইয়ে তাঁর দাবি ছিল, আগামী একশো বছরে বিপজ্জনক এআই-এর কারণে মানবজাতির ১৬.৭% সম্ভাবনা আছে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার। এই বইয়ে তিনি এক ভিন্ন ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছেন। এআই যদি সব কাজই ভাল ভাবে করে, তবে কী হবে? যেমন একটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি— এআই এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে, অর্থনৈতিক ভাবে মূল্যবান প্রায় সব কাজ প্রায় শূন্য খরচে সম্পন্ন করা সম্ভব হল। আরও চরম সম্ভাবনা: অভিভাবকত্ব বা শিশু লালন-পালনের মতো মানবিক কাজও যদি এআই আরও দক্ষ ভাবে করতে শুরু করে। বস্ট্রোম একে এক ধরনের ইউটোপিয়ান সম্ভাবনা হিসেবে দেখিয়েছেন।
তিনি এক ‘পোস্ট-স্কেয়ারসিটি ইউটোপিয়া’র কথা বলেন, যেখানে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনেক কমে যাবে। প্রায় এক শতাব্দী আগে জন মেনার্ড কেনস্ লিখেছিলেন, তাঁর ধনী বংশধরদের সপ্তাহে মাত্র ১৫ ঘণ্টা কাজ করলেই চলবে। ধনী দেশগুলোতে কাজের সময় সত্যি অনেক কমে গেছে: উনিশ শতকের শেষ দিকে যেখানে সাপ্তাহিক গড় কাজের সময় ছিল ৬০ ঘণ্টার বেশি, আজ তা ৪০ ঘণ্টারও কম। সাধারণ আমেরিকান নাগরিক জাগ্রত সময়ের এক-তৃতীয়াংশ বিনোদন ও খেলাধুলায় ব্যয় করেন। ভবিষ্যতে মানুষ হয়তো এমন কাজে সময় ব্যয় করবে যা কল্পনারও অতীত।
তবে সুপারইন্টেলিজেন্স অর্থনীতিকে যতই ত্বরান্বিত করুক, সীমিত সম্পদের কারণে শেষে সেই অগ্রগতি একটা প্রাকৃতিক সীমারেখায় গিয়ে ঠেকবে। সুপারইন্টেলিজেন্স উৎপাদন আকাশচুম্বী করতে পারে, কিন্তু জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সীমিত থাকায় সেই প্রবৃদ্ধি এক সময় আর বাড়বে না। মহাকাশ অভিযানের ফলে বাসযোগ্য এলাকা বাড়তে পারে, কিন্তু তা কখনও অসীম হবে না। এ ভাবে হয়তো একটা মাঝামাঝি পরিস্থিতিও হতে পারে, যেখানে মানুষ খুব শক্তিশালী নতুন বুদ্ধিমত্তা তৈরি করবে, কিন্তু মহাকাশে বসতি গড়বে না। তখন প্রচুর সম্পদ তৈরির সুযোগ থাকবে, কিন্তু তার অনেকটাই হয়তো বাড়িঘরের খরচে চলে যাবে, যেমন প্রথম বিশ্বে ঘটে।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয় ‘পজ়িশনাল গুডস’-এর কথাও। এই পণ্য সামাজিক মর্যাদা বাড়ায়। এআই যদি মানুষকে শিল্প, জ্ঞান বা খেলায় পিছনে ফেলে দেয়, তবু মানুষ আনন্দ খুঁজে নেবে একে অপরকে হারানোর মধ্যে, যেমন জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের টিকিট জেতা। মানুষ সর্বদাই অন্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখে কে কোথায় এগিয়ে, এই প্রতিযোগিতা থেকেই সে তৃপ্তি খুঁজে নেবে।
প্রযুক্তির উপর আজ যখন মানুষের নির্ভরতা ক্রমেই বাড়ছে, তখন কি এমন কিছু কাজ থাকবে যা শুধু মানুষের জন্যই সংরক্ষিত? সন্তান বা পরিবার পালনের মতো মানবিক দায়িত্ব কি মানুষেরই কাজ থাকবে? বস্ট্রোমের মতে, হয়তো তেমন হবে না। তাঁর মতে, ‘পোস্ট-স্কেয়ারসিটি’ সমাজের পরেও রয়েছে ‘পোস্ট-ইনস্ট্রুমেন্টাল’ সমাজ। এআই সেখানে শুধু অর্থনৈতিক কাজেই নয়, মানবিক ও আবেগঘন ক্ষেত্রেও মানুষকে পিছনে ফেলতে পারে।
কেনস্ বলেছিলেন, মানুষ এত কাল ধরে পরিশ্রম ও সংগ্রামের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত যে প্রকৃত অবসরের মুখোমুখি হয়ে সে হয়তো বিভ্রান্ত, নিরাশ হয়ে পড়বে। এ এক আশ্চর্য ‘অগ্রগতির বিপরীতাবস্থা’। মানুষ এক দিকে উন্নততর জীবন চায়; কিন্তু প্রযুক্তি যদি এতই উন্নত হয় যে মানুষের সব কাজও সে করে ফেলবে, তখন হয়তো মানুষ নিজের অস্তিত্ব ও উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলবে। বস্ট্রোমের মতে, তবুও মানুষ এমন কিছু কাজ বেছে নেবে যেগুলোর নিজস্ব আনন্দ রয়েছে: ভাল খাবার খাওয়া, সৃষ্টিশীল কিছু করা। আর যারা ইউটোপিয়ান চিন্তাধারায় বিশ্বাসী তারা হয়তো ভাববে, জীবন এত সহজ হয়ে গেছে যে তাতে কোনও চ্যালেঞ্জ নেই। তারা কঠিন কোনও কাজে যুক্ত হতে চাইবে, যেমন নতুন গ্রহে উপনিবেশ স্থাপন বা একেবারে নতুন সভ্যতা গড়ে তোলা।
এমন অভিযানও তো এক সময় একঘেয়ে লাগতে পারে। মানুষের আকাঙ্ক্ষা অসীম, সে কখনও তৃপ্ত নয়। এআই যদি কোনও দিন তাকে সব দিয়ে ফেলে, মানুষ কি তখনও সুখী থাকবে?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)