Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Trafficking

মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পরে

২০১৬ থেকে ২০১৮, এই তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গের নিখোঁজ মহিলা ও নাবালিকার সংখ্যা আশি হাজারেরও বেশি, বলছে জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বুরো।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২১ ০৭:১৭
Share: Save:

একে একে ডাক পড়ছে— টগর। শিউলি। চম্পা। জবা। অরণ্য সপ্তাহে চারা বিলি নয়। তবে ওই মেয়েগুলো তো চারাগাছই। কৈশোর পেরিয়ে মাথা তোলার আগেই কারা উপড়ে নিয়ে গিয়েছে। খুঁজে না পেয়ে বাড়ির লোক থানায় এসেছেন ‘মিসিং ডায়েরি’ করতে। মেয়ের নামটাই সম্বল, দরকারি কাগজপত্র অনেকেই তেমন কিছু দিতে পারেন না। এক জন দু’লাইন লিখে এনেছেন, “শ্রীচরণেষু পুলিস স্যর, বিজয়ার প্রণাম নেবেন। তাড়াতাড়ি মেয়েটাকে খুঁজে দ্যান। ইতি ডেমনেসট্রেশন টুডু।” অণুগল্পের লাইন নয়, পৃথিবীর সংক্ষিপ্ততম এক এফআইআর-এর বয়ান। শেষ অক্ষরগুলো আবছা। চার লাইন লিখতেই পেনের কালি ফুরিয়েছে। আন্দাজ হয়, কলমের প্রয়োজন শেষ হয়েছে বহু দিন, বহু খুঁজে এক শুকনো কালির কলমেই হারানো মেয়ে খুঁজে দেওয়ার আবেদন লিখেছেন বাবা। গোল সিল-মারা ‘রিসিভড’ কপি নিয়ে পরম প্রত্যয়ে করিডরে অপেক্ষা করছেন বাবা, যেন মেয়েকে সঙ্গে করেই আজ বাড়ি ফিরবেন।

২০১৬ থেকে ২০১৮, এই তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গের নিখোঁজ মহিলা ও নাবালিকার সংখ্যা আশি হাজারেরও বেশি, বলছে জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বুরো। দেশের নিরিখে মহারাষ্ট্র প্রথম, দ্বিতীয় স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। মহিলা থানার এক পুলিশকর্মী জানালেন, পুজোর মরসুমে বহু মেয়ে নিখোঁজ হয়। “তখন শিশিররেখাকেও ঘাসের আগায় কণ্টক মনে হয়,” বললেন ওই এসআই। ইদ, ছটপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা আসে পর পর। আত্মীয়দের বাড়ি ঘোরাফেরা, বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ বেশি। ভুল বাড়ে, সুযোগ বাড়ে। ‘মিসিং’ সংখ্যা বেড়ে যায়।

মেয়ে-খোয়ানো বাবারা থানার সামনে বেঞ্চে সার দিয়ে বসে আছেন। প্রত্যেকেরই বক্তব্য, মেয়েকে বহু খুঁজে নিরুপায় হয়ে থানায় এসেছেন ডায়েরি করতে। নদী, পুকুর, আমবাগান, বাস স্ট্যান্ড, রেল স্টেশন পেরিয়েও মেয়েকে পাননি। খবরের কাগজে নিখোঁজ বিজ্ঞাপন দেওয়ার পয়সা নেই। পুলিশের সন্দেহ, লোকলজ্জায় এঁরা অনেক দেরি করে, অনেক খরচের পর আসেন, কারণ থানায় আসা মানেই লোক জানাজানি। অনেকে বিনা খরচে মেয়ে বিদায় দিয়েও স্বস্তি পান।

এমন সব অভিভাবকরাই দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। প্রশ্নে প্রশ্নে তাঁরা বিহ্বল— কী জামা পরেছিল? হাইট কত? তিল আছে কোথাও? প্রশ্নগুলো প্রতিধ্বনিত হয় থানার দেওয়ালে। বেলি টুডুর বাবা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, চোখ নোটিস বোর্ডে। হয়তো সেখানে টাঙানো সব মেয়েকেই নিজের মেয়ে ভেবে ভ্রম হচ্ছে তাঁর।

এ দিকে এর বিপরীত দিকের গল্পটাও কম ভয়ানক নয়। সে গল্প— উদ্ধার-হওয়া মেয়েদের নিতে আসতে অস্বীকার-করা পরিবারের। থানার মধ্যে একটা ঘরে দু’টি মেয়ে মুখোমুখি বসে আছে। দশ দিন হল তারা ফিরেছে। খবর পেয়েও দেখতে আসেনি পরিবার। কাল ভোরেই আবার হোমে ফিরে যাবে ওরা।

আইন বলছে, পুলিশ ডায়েরি নিতে বাধ্য। অসহায় মানুষকে বেশি প্রশ্ন করা মানা। তবু একটা চার বাই তিন টেবিল হয়ে ওঠে আস্ফালনের আদালত। মেয়ের কোনও সম্পর্ক ছিল? ‘মিসিং’-এর আগে শেষ ফোনে কার সঙ্গে কথা বলেছিল? ভেগে যায়নি তো? প্রেগন্যান্সি টেস্ট করেছিলেন? করুণা, বিরক্তি, বক্রোক্তি রেলের বগির মতো একের পিছনে এক ছুটতে থাকে। বেলির বাবার মুখ দেখে মনে হয়, পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে। প্রশ্নের ফাঁকে একটা নীরবতা ঘুরপাক খায়, যেন বেলির জন্য অলিখিত শোকসভার আয়োজন করেছেন বড়বাবু। শবনমের ডায়েরিটা পাক্কা তিন দিন পর এলাকার নেতার চাপে নিয়েছিল থানা। শবনমের মায়ের নেতা ধরা ছিল। সবার থাকে না। তাই এখনও বেশির ভাগ ‘মিসিং ডায়েরি’ কথার জাঁতাকলে লিপিবদ্ধই হয় না। আবার ডায়েরি নেওয়ার পর ফাঁস হয়, এ হল ‘সেমসাইড’ কেস। মা-বাপ মেয়েকে বেচে থানায় এসেছে ডায়েরি করতে। জানাজানি হতে পুলিশ চেপে ধরলে স্বীকারোক্তি বেরোয়, “ওরা বলেছিল, ফোনে কথা বলতে দেবে, স্যর।”

আবার বাবা-মায়েদেরই কোনও একটা অংশ হারিয়ে যায় মেয়ের সঙ্গে। মৃৎশিল্পী সনাতন পালের বয়ান, “শর্ট সার্কিটে দশজোড়া দুর্গা পুড়ে খাক, টিভিতে দেখেননি স্যর? পরের দিন ইনশিয়োরেন্সের এক ছেলে এল। দেখে মনে হয়েছিল সভ্য, ভদ্র। কাগজে সই নিল। কারখানা সারাইয়ের জন্য এক লাখ টাকা ক্যাশ দিল। পরে জানা গেল, ওটা ছিল মেয়ের দাম।” বলেই দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিলেন সনাতন পাল। এখন রিহ্যাব সেন্টারের পাকা বাসিন্দা শহরসেরা মৃৎশিল্পী।

মাঝে মাঝে তথ্যের অধিকার আইনে আবেদন হলে, উপর থেকে সুপারিশ এলে কিংবা বিক্ষোভ হলে, থানার গ্রুপ-ডি কর্মীর খাটনি বাড়ে। স্পেশাল কেসের জন্য ঘুম ছোটে ছোটবাবুর। তখন ম্যাজিকের মতো ফাইল নেমে আসে টেবিলে। কতকগুলো করুণার কথামালা ধুলো মেখে সেজে ওঠে। যার ডাক পড়ে, সে আসে সুবিচারের আশায়।

বেলির বাবা ‘রিসিভড’ কপি নিয়েও অপেক্ষা করেই চলেন। মিসিং মেয়েদের বাড়ি বাড়ি ভাত ঠান্ডা হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Trafficking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE