কবি বহু দূর অবধি দেখতে পান। মির্জ়া আসাদুল্লাহ বেগ খান, মির্জ়া গালিব বললে যাঁকে আরও সহজে চেনা যায়, দেখতে পেয়েছিলেন— “বাংলা একশো বছর এগিয়ে বাঁচে, আবার একশো বছর পিছিয়েও বাঁচে!” দেড়শো বছর আগে যা ছিল ব্যাকরণের ভাষায় সাধারণ বর্তমান, এখনও তা-ই আছে। গালিবের গায়ে যদি দেশ-কাল-ভাষার ছাপ মেরে দিয়ে তাঁর কথা না মানতে চান, তা হলে নিজেই জরিপ শুরু করে দিন। অনায়াসে দেখতে পাবেন, বাংলা কাল যা ছিল, আজও তা-ই আছে— চতুর্দিকে থরে থরে তার হরেক নিদর্শন সাজানো। হুতোমের কালের খেউড়-খেমটার যে ‘চিরন্তনতা’ চোখের সামনে অহরহ নিজেকে জানান দিচ্ছে, সেটাই প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট— কিন্তু অন্য আরও অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা থেকেই এটা দেখা যেতে পারে। তবে, আমরা আপাতত একটা বিশেষ সাধারণ বর্তমানকেই দেখব। সেটা হল: আমাদের চারপাশে মেয়েরা কেমন আছে।
মেয়েদের জীবনমানের একটা বড় সূচক হল শিশুজন্মের হার। কিছুতেই আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে না যে, গর্ভধারণক্ষম বয়সের মহিলাদের মধ্যে জন্ম দেওয়া শিশুর সংখ্যা বড় জোর দুই— খুব কম ক্ষেত্রেই তার চেয়ে বেশি। সামগ্রিক ভাবে, সম্প্রতি প্রকাশিত পঞ্চম ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস-৫) এর মতো প্রামাণ্য সমীক্ষা জানাচ্ছে, আমাদের রাজ্যের গড় জন্মহার ১.৬, অর্থাৎ নিরন্তর সন্তানপ্রসবের বিপুল ভারে জীবনের ন্যুব্জ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে বহু মহিলাই মুক্তি পেয়েছেন। আবার, আপনি স্পষ্ট দেখতে পাবেন যে, দলে দলে মেয়েরা লেখাপড়ার চেষ্টা করছে। বস্তুত, এনএফএইচএস-৫ জানাচ্ছে, ১৫-১৭ বছর বয়সি মেয়েদের ৭৭ শতাংশই স্কুলে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, শতকরা ৭৭ জন মহিলার নিজের ব্যাঙ্ক খাতা আছে, ৫০ ভাগের নিজের হাতে মোবাইল আছে।
একদা এই বঙ্গভূমে মেয়েদের পুড়িয়ে মারা হত; বিশেষত সমাজের যাঁরা ছিলেন মাথা, তাঁদের ঘরে মেয়েদের দুর্দশার অন্ত থাকত না— সহমরণ বা বৈধব্য এড়াতে পারলেও, অপুষ্টি ও নিরানন্দ তাঁদের জীবনকে করে তুলত সংক্ষিপ্ত। আয়ুর্বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম, মেয়েদের প্রত্যাশিত গড় আয়ু পুরুষদের থেকে বেশি। কিন্তু বাংলায় এটা ছিল উল্টো। আজ জনবিন্যাসে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সমাজগুলো দেশে-বিদেশে নিন্দিত হয়। নব্বই বছর আগে এ নিয়ে বিশেষ কথা হত না, তাই ১৯৩১-এর জনগণনায়, বাংলায় প্রতি হাজার পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা অস্বাভাবিক রকম কম (৯২৪) থাকলেও, এবং সমাজের মাথা ব্রাহ্মণদের মধ্যে সংখ্যাটা ভয়াবহ রকম কম (৮৪৬) হলেও বাংলার সমাজ সে দিন লজ্জাবোধ করেনি।
সময় বদলেছে। কিন্তু, সম্পূর্ণ মূলোচ্ছেদ না করলে শিকড় মাটির তলে তলে চলতেই থাকে। তাই বহু মেয়েকে বাঁচতে হয় একশো বছর পিছনের এক বাংলায়। এখনও বাংলার মেয়েদের শতকরা ৪২ জনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আঠারো বছরের কম বয়সে (এ ব্যাপারে আমরা সারা দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছি); এক-চতুর্থাংশের বেশি মেয়েকে গার্হস্থ্য হিংসার— সোজা কথায়, মারধরের— শিকার হতে হয়; প্রায় প্রতি দশ জনের মধ্যে এক জনকে যৌন অত্যাচারের শিকার হতে হয়। এই বাস্তবতার চেয়েও বিপজ্জনক হল, বাস্তবতাটাকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়া— প্রতি দশ জনে চার জনেরও বেশি মেয়ে ‘মেনে নিচ্ছেন’ যে, স্বামীদের বউ পেটানোতে দোষের কিছু নেই। পুরুষদের মধ্যে অবশ্য প্রবণতাটা আরও বেশি— অর্ধেক পুরুষই ‘শাসনের মধ্যে দিয়ে সোহাগ’ দেখানোতে বিশ্বাসী!
এই কঠিন বৈপরীত্যের কারণ কী? সমাজশাস্ত্রীরা এ নিয়ে নিয়মানুগ অনুসন্ধান চালাবেন, এই আশা আমরা করতেই পারি। গবেষণায় সময় লাগে; আওয়ামের ধৈর্য একটু বেখাপ্পা— যেখানে অধৈর্য হওয়ার কথা সেখানে আমরা স্থিতধী, আর অন্যত্র আমাদের তর সয় না। তাই তড়িঘড়ি যে কারণটা আমরা খুঁজে পেতে পারি, তা হল— এটা বাস্তব, তাই একে সত্য বলে মেনে নেওয়াই বিধি। অর্থাৎ, কবি-বচন ‘সত্যেরে লও সহজে’র মধ্যেকার দুঃসহনীয় অর্থটাকে এড়িয়ে গিয়ে তার একটা সহনীয় মানে করে নেওয়া। আর তার বড় বিড়ম্বনা হল, শাসনকর্তারা যেটা, যতটুকু করছেন, সেটাকেই বিধিলিপি বলে মেনে নেওয়া। ভূমিসংস্কার নিয়ে সঙ্গত কারণে আমরা আহ্লাদিত হয়েছি, কিন্তু প্রশ্ন করিনি, কেন মানুষকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত রাখা হল? পঞ্চায়েতে মেয়েদের জন্য সংরক্ষণের মতো এগিয়ে থাকা পদক্ষেপ নিয়ে আমরা যথার্থ কারণেই সরকারের প্রশংসা করেছি, কিন্তু সমাজের অন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন স্তরে মেয়েদের প্রাপ্য ও প্রাপ্তি বাড়ানোর দাবি তুলিনি— কুলটিকরির মতো একান্ত ভাবে মহিলা পরিচালিত পঞ্চায়েতের তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্যের পরও। সরকারি পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলার জন্য আমরা সচরাচর সমালোচনার নামে যেটুকু করেছি, তা হল কটাক্ষ ও বিদ্রুপ— যেমন, “চার কাঠা জমি দিয়ে গরিবদের ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করেছে”, বা “পঞ্চায়েতে মেয়েরা নাম কা ওয়াস্তে, ও সব ওদের বরেরা চালায়!”
সাড়ে তিন দশকের শাসন পরিবর্তনের পর নতুন সরকার গঠনেরও এক দশক অতিক্রান্ত, কিন্তু সমালোচনামূলক বিরোধিতা যেন আরও বেশি করে রক্তাল্পতার শিকার। সরকারের পদক্ষেপগুলোর সমর্থনে উদ্বাহু অথবা সেগুলোকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ— এই দ্বিত্বের বাইরে আমরা যেতে শিখিনি। সরকার যখন কন্যাশ্রীর মতো প্রকল্প চালু করল, আমাদের বিরোধী-স্বর এ কথা বলেনি যে, এটা যথেষ্ট নয়, একে অনেক বেশি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। মেয়েদের স্কুলজীবন বাড়ানোর জন্য কন্যাশ্রীর মতো সামাজিক সু-বণ্টনমূলক প্রকল্প নিশ্চয়ই জরুরি, কিন্তু তার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার, বিশেষত স্কুলশিক্ষার মানোন্নয়ন আরও বেশি জরুরি। আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কারণ আছে, অথচ একে দূর করার জন্য সরকারি উদ্যোগ যারপরনাই অপ্রতুল। এবং, আমাদের সামাজিক বিন্যাসের কারণেই এর বড় ভুক্তভোগী হয় মেয়েরা— যতই তাদের স্কুলে যাওয়ার হারে উন্নতি হয়ে থাক না কেন।
সম্প্রতি চালু হওয়া লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়েও একই কথা। ইতিমধ্যেই আমরা হয় ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’ নিয়ে খানিক শোরগোল তুলেছি, অথবা তারস্বরে সরকারের জয়গান গেয়ে যাচ্ছি— “এই হচ্ছে মেয়েদের ক্ষমতায়নের পথ।” অথচ, সামাজিক বুদ্ধি প্রয়োগ করলে আমরা দেখতে পেতাম যে, এই প্রকল্পে হাতে পাওয়া মাসিক ৫০০ টাকা (দলিত ও আদিবাসীদের ক্ষেত্রে ১০০০ টাকা) এ রাজ্যের সাধারণ ভাবেই অভাবী সংসারগুলোতে, এবং অতিমারির কারণে বিশেষ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন মানুষের প্রাপ্য, মোটেই ভিক্ষালব্ধ কিছু নয়। এটাও দেখতে পেতাম, সরকার যদি তার অন্য করণীয়গুলোতে, যেমন স্কুলশিক্ষার মান বাড়ানো, স্বাস্থ্য বিমা বা বড় হাসপাতালের মতো চোখে-ধুলো-দেওয়া প্রকল্পের বাইরে বেরিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর মতো কাজে মন দিত, এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেয়েদের, বিশেষত চিরবঞ্চিত অংশের নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে তুলতে উদ্যোগ করত, তা হলে লক্ষ্মীর ভান্ডার মেয়েদের জীবনে একটি বাস্তবিক পরিবর্তন আনতে পারত— বাস্তবিক অর্থেই মেয়েরা স্ব-ক্ষমতায়, স্ব-সম্মানে বিরাজ করতে পারতেন।
সরকার কোনও জৈবসত্তা নয়, তাকে যে যেমন চালাবে, সে তেমন ভাবেই চলবে। যে পথে ভোট পাওয়া যাচ্ছে, সেই পথ ছেড়ে অন্য কিছু করতে যাওয়ার দরকার সরকার-চালানো দলের নেই। কিন্তু আওয়ামের তো সরকারকে সেই পথে টেনে নিয়ে যাওয়ার দায় আছে, জোর গলায় বলার দরকার আছে যে, ভোটে জিতেই কোনও দল সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হয়ে যায় না, আওয়ামেরও সেই প্রক্রিয়ার উপর হক আছে। এটাই আওয়ামি রাজনীতি— জনগণের রাজনৈতিক বিরোধিতা। মুশকিল হল, রাজনৈতিক বিরোধিতার মুরুব্বিরা কখনও আওয়াম হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন না, আর আওয়াম নিজেকে বিরোধী ভেবে ওঠার কথা কল্পনা করতে পারে না। তাই আমরা এই শতবর্ষ আগের-পরের বাংলায় বেশ আছি, অন্তত, “দিল কে খুশ রখনে কো গালিব ইয়ে খয়াল অচ্ছা হ্যায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy