কয়েক দিন আগে ভারতের ফাস্ট-মুভিং কনজ়িউমার গুডস (এফএমসিজি) বা ভোগ্যপণ্যের বাজারের অন্যতম বড় সংস্থা নেস্লে-র চেয়ারম্যান এই ক্ষেত্রের বাজারে চাহিদার ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। তা নিয়ে মধ্যবিত্তের চায়ের কাপে বড়সড় তুফান না উঠলেও বিভিন্ন মহলে যথেষ্ট চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। শুধু নেস্লে নয়, দেশের আরও অন্তত ছ’সাতটি বড় সংস্থা বিক্রিবাটায় ভাটা পড়া নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় রিলায়েন্স এবং হিন্দুস্তান ইউনিলিভারও রয়েছে।
ভারতে এখন রাজনৈতিক পরিবেশ এমনই যে, ভারত একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে উন্নতি করছে, এ কথা না বললেই বক্তাকে দেশবিরোধী বলে দেগে দেওয়া যায়— বা, ভাগ্য খুব ভাল হলে শুনতে হয় যে, বক্তা যথেষ্ট দেশপ্রেমী নন। এই পরিপ্রেক্ষিতে এটা রীতিমতো আশ্চর্যের যে, যখন শুধু বহুজাতিক নয়, দেশীয় এফএমসিজি সংস্থাগুলিও ভোগব্যয়ের গতিভঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে, তখন গৈরিক জাতীয়তাবাদী শিবির থেকে এদের ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বলে দেগে দেওয়ার খেলাটা এখনও শুরু হয়নি।
গত কয়েক বছর ধরেই ভোগের চাহিদায় যে টান পড়েছে, সেটা জিডিপির পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। অর্থনীতিবিদদের একাংশ এতে বিপদসঙ্কেত দেখেছেন, কারণ ১৯৯১ সালে আর্থিক উদারীকরণ-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় অর্থনীতির সাফল্যের পিছনে মস্ত ভূমিকা ছিল ভোগের চাহিদা ও রফতানির। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, যদি অর্থনীতির বৃদ্ধির মূল ইঞ্জিনগুলোই ঢিলে হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে গত দু’বছর ধরে জিডিপির বৃদ্ধি হচ্ছে কী করে? বর্তমান ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি বেড়েছে ৬.৭%, যা গত আর্থিক বছরের একই সময়ে ৮.২% হারে বৃদ্ধির চেয়ে কম ঠিকই, তবে দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অর্থব্যবস্থাগুলোর বৃদ্ধির তুলনায় বেশ ভাল। বাস্তব হল, ভোগ ও রফতানির ক্ষেত্রে চাহিদার যে অভাব ঘটেছে, সরকার এখনও অবধি তাকে ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার বা মূলধনি খাতে খরচ দিয়ে পূরণ করে চলেছে, ফলে জিডিপির অঙ্কে তার প্রভাব এখনও পড়েনি। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে মূলধনি খাতে ব্যয় ছিল ১১.৩ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে এই খাতে কেন্দ্রীয় সরকার ব্যয় করেছে ১৫.৮ লক্ষ কোটি টাকা। সহজ ভাষায়, দেশের মানুষ জিনিসপত্র কম কেনার ফলে এবং রফতানির বৃদ্ধি কমে যাওয়ায় অর্থব্যবস্থায় যে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, সরকার তা পূরণ করছে রাজকোষ থেকে পুঁজিলগ্নি বাবদ খরচ করে।
এই ভাবেই যদি জিডিপির বৃদ্ধি হয়, তাতে ক্ষতি কী? লাভক্ষতি পরের ব্যাপার, প্রথম কথা হল, এই মূলধনি খাতে ব্যয় অনাদি কাল ধরে চলতে পারে না। বছরের পর বছর এই ভাবে মূলধনি খাতে ব্যয় করে গেলে সরকারের ঋণ এবং রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে যাবে। তার পরেই সমস্ত আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি ভারতীয় অর্থনীতির রেটিং কমিয়ে দেবে, যা কোনও সরকারই চায় না। কাজেই এই দুই পরস্পর-বিরোধী নীতি সরকার অনন্তকাল ধরে চালাতে পারবে না। আন্তর্জাতিক বাজার না-চাইলে রফতানি বাড়ানোর সাধ্য সরকারের নেই— কাজেই নিদেনপক্ষে দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগের চাহিদা একটা সময় পুনরুজ্জীবিত করতেই হবে। এফএমসিজি ক্ষেত্রের বড়কর্তারা মনে করছেন যে, সেই সময়টা এসে গেছে।
নেস্লের বড়কর্তা ভোগের চাহিদার গতিভঙ্গের জন্য দায়ী করেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্কোচনকে। যদিও তিনি পরে বলার চেষ্টা করেছেন যে, এই সঙ্কোচন অস্থায়ী আর পরে মানুষ আবার কেনা শুরু করবেন। তবে, দেশের বড় সংখ্যক মানুষ যে এই মুহূর্তে প্যাকেটজাত চাল, ডাল, তেল, বিস্কুট ইত্যাদি দৈনন্দিন সামগ্রী কম কিনছেন, এই বাস্তব অনস্বীকার্য।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না, এই প্রশ্নের একটি সন্তোষজনক উত্তর গত দু’বছরের বৃদ্ধির হারে মিলেছে। কিন্তু, আর্থিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা গেলেও সেই বৃদ্ধি ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো হবে বলে যে আশঙ্কা ছিল, সেটিকে এত সহজে নাকচ করে দেওয়া যাচ্ছে না। ‘কে-শেপড রিকভারি’ বলতে বোঝায়, অর্থব্যবস্থার আলাদা আলাদা কিছু ক্ষেত্র আবার পুরনো জায়গায় ফেরত গেলেও অন্য কিছু ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হতে থাকবে— তৈরি হবে ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো বৃদ্ধির পথ।
কিছু দিন আগে প্রকাশিত হয়েছিল অ্যানুয়াল সার্ভে অব আনইনকর্পোরেটেড সেক্টর এন্টারপ্রাইজ়েস-এর ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের সরকারি পরিসংখ্যান। তাতে দেখা গেল, ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের মধ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে বড় সঙ্কোচন হয়েছে। রোজগার কমেছে, জাতীয় আয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শতকরা অবদান কমেছে, এই ক্ষেত্রে একটা সর্বব্যাপী চাপেরও সৃষ্টি হয়েছে। দেশের অর্থনীতির জন্যে এটা ভাল খবর নয়, কারণ ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ তাঁদের রুজিরুটির জন্যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপরেই নির্ভরশীল। ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে অসংগঠিত ক্ষেত্রে ১১.১৩ কোটি কর্মসংস্থান হত; ২০২২-২৩ সালে হয়েছিল ১১ কোটি। কৃষি এবং নির্মাণ ক্ষেত্র বাদ দিলে এই কর্মী-সংখ্যা ভারতের কর্মসংস্থানের প্রায় অর্ধেক। সুতরাং এখানে রোজগার কমতে থাকাটা বেশ দুশ্চিন্তার বিষয়।
অর্থাৎ জিডিপি বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণ মানুষের চাকরি বা রোজগার করার উপায় কমতে থাকছে। অর্থব্যবস্থায় সঞ্চয়ের হারও কমেছে স্বাভাবিক ভাবেই। অথচ কিছু অর্থনীতিবিদ বলতে থেকেছেন যে, সঞ্চয়ের ধরন বদলে গেছে, মানুষ এখন ব্যাঙ্কে টাকা না জমিয়ে ঘর-বাড়ি, সোনা ইত্যাদি স্থাবর সম্পত্তি কেনাতে পয়সা খরচ করছেন। সহজ করে বললে, এঁদের মতে সব ঠিকঠাকই আছে।
ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ল্যাব এ বছরেই একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায় যে, ২০২২-২৩ সালে আয়ের নিরিখে দেশের শীর্ষ এক শতাংশের গড় আয় দেশের সার্বিক গড় আয়ের প্রায় ২৩ গুণ বেশি। দেশের সর্বোচ্চ ধনী ৯২২৩ জন বছরে ৪৮ কোটি টাকারও বেশি উপার্জন করেন, যেখানে দেশের বার্ষিক গড় আয় ২.৩ লাখ টাকা। শীর্ষ এক শতাংশের গড় সম্পদের পরিমাণ ৫.৪ কোটি টাকা— সাধারণ গড় ভারতীয়ের সম্পদের প্রায় ৪০ গুণেরও বেশি। এই আর্থিক বৈষম্য আগেও ছিল ঠিকই, কিন্তু অতিমারির পরে তা প্রবল ভাবে বেড়ে গেছে। অতিমারির পর থেকে অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির লাভের গুড় হাতেগোনা মানুষের হাতে পৌঁছেছে আর অসংগঠিত ক্ষেত্রে ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালানো মানুষের আয় কমেছে। শুধু তা-ই নয়, গ্রামেগঞ্জে শহর-বাজারে রোজগারের পথও কমেছে।
এই অবস্থায় এফএমসিজি সংস্থাগুলোর বিক্রিবাটা কমবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন— গত দু’বছর কমেনি কেন, আর এখনই বা কমছে কেন? এর জবাব লুকিয়ে রয়েছে আর্থিক বৈষম্যের মধ্যেই। সর্বোচ্চ ধনী পুঁজিপতিরা সরকারি সাহায্যেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক, অতিমারির পরে পুরনো বৃদ্ধির পথে ফেরত যেতে সক্ষম হয়েছেন। এঁরাই অতিমারির সময়ে খরচ করতে পারেননি এবং তার পরে দামি গাড়ি, বাড়ি বা বিদেশভ্রমণের মতো বিলাসবহুল খরচ আরও বেশি করে করেছেন। জিডিপি বেড়েছে, কিন্তু এই রকম খরচ বছর বছর করা সম্ভব নয় বলে তাতে ভাটাও পড়েছে। সাধারণ মানুষের মাইনে কমেছে, আয় কমেছে, চাকরি গেছে, সঞ্চয় ভাঙিয়ে চলতে চলতে এক সময় রোজকার খাবার ও অন্যান্য জিনিসপত্র কেনায় টান পড়েছে।
যত ক্ষণ অতিধনীরা বিলাসে খরচ করে ভোগব্যয় ও জিডিপি বৃদ্ধির হার ঠিক রেখেছিলেন, তত ক্ষণ এ দিকে নজর পড়েনি। এখন তাঁদের খরচে ভাটার টান, ফলে মূল সমস্যায়— অর্থাৎ দেশের ভোগের চাহিদা কমে যাওয়ার দিকে নজর ঘুরেছে। তাতে সরকারের টনক নড়বে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy