অপারেশন সিঁদুর শুরু হওয়ার পর থেকে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি (ছবিতে ডান দিকে) এবং উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের বিদেশ সচিব বিক্রম মিস্রীর পাশে এই মহিলা সেনা আধিকারিকদের কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এই সম্মান কি ভারতের মহিলা সেনাদের আরও আগেই প্রাপ্য ছিল না? ২২ এপ্রিল কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হানায় যে সমস্ত পর্যটক নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা সকলেই পুরুষ এবং হিন্দু। তাঁদের খুনের প্রতিশোধ নিতেই এই যুদ্ধ। মহিলা সেনা আধিকারিকদের উপস্থিতি যেন বার্তা দিচ্ছে, ভারত লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে নারী-পুরুষ সমতার পথে অগ্রসর হচ্ছে। সেই সঙ্গে, পহেলগামে যে মেয়েরা মাথার সিঁদুর হারিয়েছেন, তাঁদের অবমাননার জবাব দিচ্ছেন ভারতের মহিলা সেনা, এমন একটি ধারণা তৈরি করছে রাষ্ট্র।
আড়ালে চলে গেল এই কথাটি যে, সিঁদুরদান একটি পিতৃতান্ত্রিক ধারণা। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে একটি যুদ্ধ-উদ্যোগের এ ধরনের নামকরণ নানা বিভাজন তৈরি করতে পারে। সর্বোপরি, ভারতীয় সেনায় লিঙ্গসাম্যের যে ধারণা নির্মাণের চেষ্টা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার, তার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক অনেক। ভারতে সেনাবাহিনীতে মহিলাদের অন্তর্ভুক্তির ইতিহাস কণ্টকপূর্ণ। ১৮৮৮ সালে মেয়েরা সেনাবাহিনীতে প্রবেশ করলেও, তাদের ভূমিকা সীমিত ছিল চিকিৎসায়। ১৯৯২ সালে তিনটি বাহিনীর নানা পদে স্বল্পমেয়াদি নিয়োগ (শর্ট সার্ভিস কমিশন) শুরু হয়। প্রথমে মেয়েদের নিয়োগের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। ক্রমশ তা বাড়ানো হয়, ২০০৬ সালে মেয়েদের সেনাবাহিনীতে কাজের মেয়াদ ১৪ বছর করা হয়। কিন্তু ‘পার্মানেন্ট কমিশন’ বা স্থায়ী নিয়োগের যোগ্য বলে মনে করা হয় না মেয়েদের।
মেয়ে-সেনাদের তরফে কিন্তু স্থায়ী নিয়োগের দাবি উঠতেই থাকে। শেষ অবধি ২০০৮ সালে স্থায়ী নিয়োগ অনুমোদন করা হয় শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর আইনজীবীর পদে (অ্যাডভোকেট জেনারেল) এবং সেনা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে (আর্মি এডুকেশন কোর)। সেনার অন্যান্য বিভাগে, কিংবা নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনীতে মেয়েদের জন্য কোনও স্থায়ী পদের ব্যবস্থা হয়নি। ২০১০ সালে দিল্লি হাই কোর্ট যখন বিভিন্ন বাহিনীতে মহিলা আধিকারিকদের স্থায়ী নিয়োগের পক্ষে রায় দিল, তখন সেনাবাহিনী এবং ভারত সরকার তার বিরোধিতা করে গেল সুপ্রিম কোর্টে। ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের কাছে সেনাবাহিনীর তরফে সওয়াল করা হয়েছিল যে, মহিলা আধিকারিকদের নির্দেশ পালন করার মতো মানসিক প্রস্তুতি এখনও অর্জন করেনি পুরুষ সেনা।
শীর্ষ আদালত অবশ্য মেয়েদের স্থায়ী নিয়োগের পক্ষে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল। আদালত জানিয়েছিল যে, মেয়েদের শারীরিক দুর্বলতা সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণা কখনও মহিলা অফিসারদের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চনার সংবিধান-সম্মত ভিত্তি হতে পারে না। ভারতীয় সেনার নেতৃত্বের স্থানের (কমান্ড পজ়িশন) জন্যও মহিলারা আবেদন করতে পারবেন, বলে আদালত। কারণ, এই সব পদ পুরুষদের কুক্ষিগত রাখা সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সাম্যের অধিকারের বিরোধী। সেই সময়ে যে কৃতী মহিলা সেনা অফিসারদের উল্লেখ করেছিল সুপ্রিম কোর্ট, তাঁদের মধ্যে ছিলেন (তৎকালীন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল সোফিয়া কুরেশিও।
মেয়ে সেনাদের সাম্যের দাবিকে অস্বীকার করা আসলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার গভীরে ঢুকে-থাকা ভয়ের একটা প্রকাশ। যুদ্ধ এবং যুদ্ধক্ষেত্রকে পৌরুষ-প্রদর্শনের ক্ষেত্র বলে দেখতেই অভ্যস্ত ভারতীয় সমাজ। সেখানে মেয়েদের স্থান দিতে নারাজ পুরুষরা। অথচ, যে কোনও যুদ্ধে মহিলারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। যাঁরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত নন, তাঁরাও যুদ্ধের আর্থ-সামাজিক নানা অভিঘাতে অসহায় হয়ে পড়েন। মেয়েরা বরাবর যুদ্ধের ক্ষতিই বইবে কেন? যুদ্ধের পরিকল্পনায়, পরিচালনায়, মেয়েদের স্থান দেওয়ার প্রয়োজন কেন দেখতে পাবে না রাষ্ট্র?
সেনাবাহিনীতে শূন্য পদ বোঝাতে বলা হয়, ‘ম্যানপাওয়ার’-এর ঘাটতি রয়েছে। যেন তা নিয়োগযোগ্য পুরুষের অভাবের দিকেই আঙুল তুলছে। ২০১৩ সালে দশ হাজারেরও বেশি সেনা আধিকারিকের পদ শূন্য ছিল। ২০২৩-এ ভারতীয় সংসদে এই ঘাটতির কথা উঠে আসে। সমস্যার সমাধান করতে যে সব প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তাব উঠে আসে, তার মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীর নিজস্ব ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন করা, এবং মহিলা আধিকারিক নিয়োগ। ২০২৩ সালে প্রকাশিত সরকারি তথ্য অনুসারে, বর্তমানে সাত হাজারেরও বেশি মহিলা অফিসার নিযুক্ত রয়েছেন সেনাবাহিনীতে, বিমান বাহিনীতে রয়েছেন ষোলোশোরও বেশি। আগের চাইতে অনেক বেশি মহিলা নিয়োগ পাচ্ছেন, তবু বিভিন্ন বাহিনীতে অফিসারের ঘাটতি রয়েই গিয়েছে।
মহিলা আধিকারিকদের অন্তর্ভুক্ত না করা, দেরি করে অন্তর্ভুক্ত করা, স্থায়ী কমিশন না দেওয়া, এগুলি সেনাবাহিনীতে লিঙ্গবৈষম্যের প্রভাবই দেখিয়ে দেয়। সম্প্রতি স্বল্পমেয়াদি কমিশনে নিযুক্ত মহিলা অফিসারদের জন্য স্থায়ী নিয়োগের সওয়াল করে এক আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে বলেন যে, কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকেও স্থায়ী কমিশনের জন্য সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলাদের নেতৃত্বের দৃশ্য অনেককেই আবেগান্বিত করছে। তবে এই ছবি যেন ভুলিয়ে না দেয় সেনাক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ও মহিলাদের অন্তর্ভুক্তির প্রতি প্রতিরোধের দীর্ঘ ও তিক্ত ইতিহাসটাও।
ইতিহাস বিভাগ, হরিমোহন ঘোষ কলেজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)