বাঙালি হিন্দুর ধর্মসংস্কৃতিতে নাকি একটা উদারবাদ ছিল— ইদানীং যার তিরোভাব নিয়ে বিস্তর হাহুতাশ হয়। এই যেমন, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার সঙ্গে বাঙালির মূল যোগসূত্র ছিল রথ, আর রথ বলতে বাঙালি বুঝত মূলত মেলা আর পাঁপড়ভাজা। সেই বাঙালিই এখন দিঘায় জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে উতরোল, এতে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশ দৃশ্যত আশাহত। তাঁদের আশ্বস্ত করা যাক যে, এ বছরেও ২৭ জুন রথযাত্রার দিনে, কিংবা ৫ জুলাই উল্টোরথে সেই টুকরো ছবি ধরা পড়বে। কিন্তু, একই সঙ্গে এটাও সত্য যে, জগন্নাথ মন্দিরটি বঙ্গ-রাজনীতির গতিপথকে চালিত করল একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে—রাজ্যের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিষয়টিতে সিলমোহর পড়ে গেল। অযোধ্যার রাম মন্দিরে রাজনীতির যে সমীকরণ, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরেও তার চেয়ে খুব আলাদা নয়। কিন্তু, একই সঙ্গে এ কথাটিও মনে রাখা দরকার যে, বঙ্গ রাজনীতিতে এই মন্দির আকাশ থেকে পড়েনি— যে উদারবাদী হিন্দুত্বের অতীত গৌরব মনে করে আমাদের চোখ ছলছল করে, তার মধ্যেই নিহিত ছিল এই মন্দিরের বীজ। রাজনীতি আর ধর্মের গতিপথ যে ভাবে বারে বারেই একে অপরের সন্নিকটে এসেছে, তার মধ্যে।
কিন্তু, সে কথায় যাওয়ার আগে, খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, এই জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতির কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। এক হচ্ছে নকল করা। লেক টাউন ভিআইপি রোডের মোড়ে বিগ বেন যতখানি পরিচিত, তার থেকে দু’আড়াই কিলোমিটার দূরে পাতিপুকুর যশোর রোডের ক্লক টাওয়ার ততখানি চেনা নয়। কিন্তু, আছে— লন্ডনে যেমন বিগ বেনের পাশাপাশি লিটল বেন আছে। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন উদ্বোধন হওয়া দিঘার জগন্নাথ মন্দিরও তেমন একমাত্র নয়— তার দু’সপ্তাহের মধ্যেই, বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন, আরও একটি জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন হল কসবার কাছে আনন্দপুরের রাস্তায়। অর্থাৎ, ঘড়ি হোক বা মন্দির, সব ক্ষেত্রেই নকল জোড়ায়-জোড়ায়।
তৃণমূলের দ্বিতীয় যে ধারার সঙ্গে বিষয়টি মেলে, তা হল মেলা-খেলা-বিনোদনের সংস্কৃতি। বামফ্রন্ট সরকারের সময়েও যে বিনোদনমুখী অনুষ্ঠান দু’-একটা হয়নি, তা নয়— কিন্তু তার সংখ্যা ছিল অনেক কম। এবং, সেগুলো সংস্কৃতি না কি অপসংস্কৃতি, তা নিয়ে বিস্তর দ্বন্দ্ববাদ ছিল দলের মধ্যেই। তৃণমূলে অত বখেড়া নেই। তাদের পছন্দের কার্যক্রম তীব্র জনমোহিনী, এবং বিপুল পরিমাণে বিনোদনমুখী। তার জন্যে নিয়মিত রাজকোষ থেকে অর্থব্যয়ও করা হয়। সাধারণ ভাবে এই বাংলায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে খেলা-মেলা তৃণমূল রাজত্বে অনেক বেড়েছে। সেই মতোই আনুমানিক সাত বছর আগে জগন্নাথ মন্দিরের পরিকল্পনা থেকে গত তিন বছরব্যাপী নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে এপ্রিল শেষে উদ্বোধন পর্যন্ত গোটা বিষয়টির মধ্যে তৃণমূলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নির্দিষ্ট রূপরেখা স্পষ্ট। অর্থাৎ, এই মন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্যে কতটা সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পর্যটন ভাবনা, আর কতটা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তোলা ধর্মীয় হুজুগ, তা নিয়েও আলোচনার পরিসর আছে।
গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস দু’দলই মোটের উপরে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি নিয়ে চলত— এবং, দু’দলের বিরুদ্ধেই ‘সংখ্যালঘু-তোষণ’-এর অভিযোগ উঠেছে। হিন্দু এবং মুসলমান, উভয় ধর্মের অনুষ্ঠানের সামাজিক পরিসরেই বাম নেতাদের তুলনায় কংগ্রেস নেতাদের উপস্থিতি এবং প্রভাব ছিল অনেক বেশি। পরে সেই নেতাদের অনেকেই তৃণমূলে চলে যান— এবং, তাঁদের সঙ্গেই যায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যুক্ত থাকার প্রবণতাটি। আজকের পশ্চিমবঙ্গের সরকারি রাজনীতি এবং প্রশাসনিকতায় ধর্মীয় উপাদানগুলি স্পষ্ট— এক দিকে যেমন ইমাম ভাতা, অন্য দিকে দুর্গাপূজায় বিপুল অনুদান। কাজেই, রাজকোষের টাকায় মন্দির নির্মাণকে রাজ্য রাজনীতির মূলধারার অঙ্গ বলাই চলে।
রাজনৈতিক চাল হিসাবে মন্দির নির্মাণ বেশ কৌশলী। মন্দির, তাই এতে বিজেপির কঠোর আপত্তি প্রকাশ করার অবকাশ কম। এ প্রসঙ্গে দিলীপ ঘোষের পর্যবেক্ষণটি তাৎপর্যপূর্ণ— আগে এ রাজ্যে বহু মানুষ বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, যেখানে বিবেকানন্দের উদারবাদের কথা আসত অনেক বেশি; আজকে সেখানে রামনবমীর মিছিল হয়, যেখানে বিজেপি এবং তৃণমূল দুই রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করে।
বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, রাজ্যে যুযুধান দুই পক্ষ বিজেপি এবং তৃণমূল রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পক্ষে একাধিক উদাহরণ পেশ করছে। আরএসএস দু’দিক থেকেই খুশি হিন্দুত্বের সামাজিক প্রসারে। সরকারের পক্ষে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তো বাম আমল থেকেই ছিল— তৃণমূলের ক্ষেত্রে সে অভিযোগ তীব্রতর হলেও, সেই বৃদ্ধি হিন্দুত্বের ক্ষেত্রেও কিছু কম নয়। ধর্মীয় মৌলবাদ দু’টি ভিন্ন এবং প্রতিযোগী ধর্মের হলে একে অপরের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক অবস্থানে থাকে— সেই দ্বন্দ্ব উভয়েরই বৃদ্ধিতে সহায়ক। আশির দশকের শেষ থেকে বিজেপির যে উত্থান, তার ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদল হয়েছে অনেকটা। অস্বীকার করা যাবে না যে, সঙ্ঘের হিন্দুত্ব-রাজনীতির বয়স একশো বছর হলেও ২০১৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অবধি ধর্ম এমন ভাবে রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেনি। আজকে সেই পরিস্থিতি শুধু তো পশ্চিমবঙ্গে বদল হয়নি, তার প্রভাব আজ সারা দেশে। ফলে, তৃণমূলের রাজনীতিকেও দেখতে হবে সেই পরিপ্রেক্ষিতেই।
প্রশ্ন হল, তৃণমূলের এই মন্দির-রাজনীতি কি বিজেপির ‘হিন্দুত্ব রাজনীতি’র সুবিধা করে দিচ্ছে? উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলতেই হয়। কিন্তু, তার ফলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ফল ভাল হবে কি না, বলা কঠিন। এই বিশ্লেষণের কারণ, রাজ্যের হিন্দুদের একটা অংশ এখনও প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ— তাঁরা যদি বা মন্দির চান, কিন্তু মুসলমানদের প্রতি প্রবল খড়্গহস্ত হওয়ায় তাঁদের ততখানি সায় নেই। অন্য দিকে, রাজ্য বিজেপি এখনও ঘর গুছিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে, ওয়াকফ বিল-বিরোধী আন্দোলনে মালদহ-মুর্শিদাবাদের ঘটনাক্রমকেও বিজেপির পক্ষে জোটবদ্ধ হিন্দু ভোটে পরিণত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
অন্য দিকে, তৃণমূলের পাশে আছে সুসংহত সংখ্যালঘু ভোট। আর, এর সব কিছুকে জুড়ে রেখেছে জনমুখী একাধিক প্রকল্প, যা নিম্নবিত্ত মানুষকে তৃণমূল থেকে খুব সহজে দূরে সরিয়ে দেবে না। সুতরাং, চার পাশে মাথাচাড়া দেওয়া উগ্র হিন্দুত্বকে ভালই সামলাচ্ছেন, এবং নিজের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবহার করছেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। এক দিকে সিপিএম-বিরোধী উদারবাদী হিন্দু অতিবাম, এবং অন্য দিকে সাধারণ নিম্নবিত্ত ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের একটি অংশ— এই দুই ভাগকেই সঙ্গে নিয়ে চলছেন তিনি। হিন্দু ভোটকে বিজেপির দিকে সংহত হতে না দেওয়ার এই রাজনৈতিক কৌশল যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন। এই যে দিঘার মন্দির উদ্বোধন করতে আসার জন্য সেবায়েত রাজেশ দয়িতাপতির এক মাস পুরীর জগন্নাথধামে ঢোকা বন্ধ, এতে কি উদারবাদী হিন্দুদের সহানুভূতির ঝড় তৃণমূলের দিকে বইবে না, যেখানে খলনায়ক হয়ে যাবে ওড়িশার বিজেপি সরকার?
ঈশ্বর কখনও নকল হন না, আর নিমকাঠের মূর্তির বাধ্যবাধকতায় তিনি সীমাবদ্ধ নন। মূর্তি নিয়ে বিতর্ক আপাতত সামলে দেওয়া গেছে, বিজেপির যুদ্ধরথ আর বামপন্থীদের লড়াইয়ের পথ, দুটোই আয়ত্তের মধ্যে। অন্তর্যামী দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের বিষয়গুলি মতদাতাদের মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখলে ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল, সেটুকু বলাই যায়।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)