E-Paper

এক রূপান্তরিত রাষ্ট্র

কর্তৃত্ববাদী নেতারা সাধারণত জাতীয়তাবাদ, ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার ধারণায় জোর দিয়ে জনগণের আবেগকে উস্কে দেন।

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৫ ০৫:০৭

ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় শাসনকালে আমেরিকার ভিতরে ও বিদেশনীতিতে যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা আপাতদৃষ্টিতে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, আদতে এর পিছনে কাজ করছে এক ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তা যার যথার্থ নামকরণ সম্ভব নয়। অনেকের মতো, আমিও একে দক্ষিণপন্থী জনপ্রিয়তাবাদ বলব। জনপ্রিয়তাবাদের সারশূন্যতাই তার সবচেয়ে জোরালো আকর্ষণ। এটা আদতে একটা ছাঁচের মতো— যে কোনও প্রচলিত ধারণাকে এতে ফেলে তার রূপান্তর করা যায়।

মানুষ প্রায়ই কর্তৃত্ববাদী নেতাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই নেতারা অর্থনৈতিক সঙ্কট, সত্তাপরিচিতি রাজনীতি, সামাজিক বিশৃঙ্খলার সময়ে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার আপাত-বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি দেন, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন। রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও ধনসম্পত্তির বণ্টনের ফলে অনেক সময় পুরনো আধিপত্যশীল শ্রেণি বা গোষ্ঠী তাদের প্রভাব হারায়। নব্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত শ্রেণি ধীরে ধীরে তাদের আধিপত্য কায়েম করে। এই দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয় না। এই পরিস্থিতিতে এক জন দৃঢ়, ‘রক্ষাকর্তা’ নেতার আবির্ভাব পুরনো গোষ্ঠীর মানুষকে আকৃষ্ট করে। তা ছাড়া, কর্তৃত্ববাদী নেতারা সাধারণত জাতীয়তাবাদ, ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তার ধারণায় জোর দিয়ে জনগণের আবেগকে উস্কে দেন। তবে এই আকর্ষণের ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় ঘটে, যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য হানিকর। কিন্তু, কঠিন সময়ে মানুষ সেই ক্ষতির পরোয়া না করে জনপ্রিয়তাবাদী নেতার কঠোর ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ট্রাম্প তেমনই এক জন নেতা।

রুসো বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই আসে যখন মানুষ নিজের তৈরি আইন অনুযায়ী চলে, যা সমাজের ‘সাধারণ ইচ্ছা’র সঙ্গে মেলে। যারা শুধু নিজের স্বার্থ দেখে এবং এই সম্মিলিত ইচ্ছা মানতে চায় না, তারা সত্যিকারের স্বাধীন নয়। আধুনিক জনতান্ত্রিকতাবাদীরা, যেমন ট্রাম্প, নিজেদের স্বাধীনতার রক্ষক বলে দাবি করেন এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের স্বার্থপর বা বিভ্রান্ত বলে দেখান। এ ভাবে অধিকারকে ব্যক্তিস্বাধীনতার বদলে কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। যুক্তি, সমালোচনা, সাধারণ বুদ্ধির চেয়ে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও আবেগের তাড়নার উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই জনবাদকে বিচার করা নিষ্ফল, কারণ তা সমস্যার মূল রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। সমস্যার সমাধানের পরিবর্তে নৈতিক নিন্দা ও পরিহারমনস্কতা তৈরি হলে তাতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আরও দুর্বল হয়ে যায়। তাই জনবাদের বিশ্লেষণ এবং এর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ করতে হলে চাই রাজনৈতিক ও কাঠামোগত পদ্ধতি— নৈতিক মূল্যায়ন নয়।

সংবাদ এবং সমাজমাধ্যমে দেখি ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তাতে তাঁর মূল উদ্দেশ্য ঢাকা পড়ে যায়। তিনি এক জন ‘শোম্যান’, যিনি মুহূর্তের তাড়নায় কাজ করেন। ট্রাম্প মেরুকরণের কারিগর, সেটাই তাঁর রাজনীতির একাধারে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ। ট্রাম্প কেবল এক জন রাজনৈতিক নেতা নন; তিনি একটি যুগের প্রতিচ্ছবি, একটি অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের অভিব্যক্তি এবং এক গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তনের দ্যোতক। আজকের আমেরিকা তাঁর খামখেয়ালিপনার মধ্যে পথ খুঁজে চলেছে— যে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ক্ষীণ, ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজন প্রবল, সত্যের সংজ্ঞা অনিশ্চিত।

আমরা জানি যে ট্রাম্পের উত্থান কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়। বহু আমেরিকার নাগরিক, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চল, শিল্পনির্ভর শহর এবং কাজ-হারানো জনগোষ্ঠী, নিজেদের ‘উপেক্ষিত’ ও ‘পরিত্যক্ত’ অনুভব করেন। ট্রাম্প তাঁদের ভাষায় কথা বলতে পারেন, তাঁদের ক্ষোভকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজের রাজনৈতিক মূলধনকে শক্তিশালী করতে সক্ষম, এবং আপাতবিরোধী কিন্তু সহজাত, যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর, প্রতিশ্রুতিতে সৃজনশীল: তিনি আমেরিকাকে আবার মহান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা অনেক মানুষকে নিশ্চিত ভাবে উজ্জীবিত করেছে। এই প্রতিশ্রুতি এক শক্তিশালী নস্টালজিয়ার আহ্বান— এমন এক কল্পিত অতীতের হাতছানি যার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষের স্মৃতির জগতে যা নির্মাণ করেছে নিরাপত্তা, একতা ও মর্যাদার এক নতুন অঙ্গীকার। এই কল্পিত অতীতের আহ্বান ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অস্ত্র।

একই রকম গুরুতর অস্ত্র— ট্রাম্পের যুদ্ধং দেহি সুর, সরাসরি সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা, প্রচলিত গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলা, এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের উপর জোর দেওয়া। অভিবাসীবিরোধিতা, কৃষ্ণাঙ্গ, ‘আদিবাসী’ ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলি নাগরিক অধিকারের বিরোধিতা, নারীবাদী ও এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের অধিকার হ্রাস, সব মিলিয়ে উদারনৈতিক, বহুসংস্কৃতিবাদী উত্তরাধিকারের কণ্ঠরোধে ট্রাম্প মরিয়া। অতীতের গণতান্ত্রিক ঐকমত্যের নীতি— যেখানে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও আইনি প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্মান ছিল অপরিহার্য— আজ মিলিয়ে যেতে বসেছে। আমরা দেখছি কী ভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনুগত্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং তথ্যের বিকৃতি দিয়ে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করা যায়। তাঁর উত্তরাধিকারের এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত: যে কেউ, প্রয়োজনবোধে, নিয়ম ভেঙে নিজের স্বার্থে রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে সক্ষম।

শুধু রাজনৈতিক মতভেদ নয়, সামাজিক বিভাজনও আজ অনেক গভীর। ‘আমরা বনাম ওরা’র দ্বন্দ্ব আমেরিকার সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তাকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে। ট্রাম্প এই বিভাজনের উদ্ভাবক নন, তবে তিনি এটিকে রাজনৈতিক পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করেছেন এবং তীব্রতর করেছেন। ইতিহাসও হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক সংঘাতের একটি ক্ষেত্র। জাতীয় ইতিহাসের ব্যাখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ইতিহাসের জটিলতা ও বৈচিত্রকে মুছে দিয়ে এক গৌরবগাথা প্রতিষ্ঠা বা মিথ নির্মাণের চেষ্টা চলছে, যা ইতিহাসের বিতর্কিত অধ্যায়গুলিকে ভুলে যেতে বদ্ধপরিকর। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্কৃতির জগতে এক অকল্পনীয় ভয় ও আত্মরক্ষার মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঝুঁকির মুখে পড়েছে। যদিও আদালতে এই সংক্রান্ত বহু মামলা চলছে, আমেরিকান উচ্চ ন্যায় বিভাগ যে এই নব্য-ম্যাকার্থিজ়ম প্রতিহত করতে চাইবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমেরিকার শক্তির প্রধান স্তম্ভ সে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, যার পিছনে রাষ্ট্র ও ব্যক্তিগত পুঁজির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ট্রাম্প সেই প্রাচুর্যে পেরেক পুঁতছেন। আমেরিকার উত্থানের পিছনে ছিল সারা পৃথিবীর সেরা মেধার সমাহার। আজ উল্টো স্রোতের পালা।

ট্রাম্পের অর্থনীতিও নয়া নিয়ন্ত্রণবাদের আর এক রূপ। মুক্ত বাজারের পরিবর্তে এসেছে সুরক্ষাবাদ, যেখানে শুল্ক, নিষেধাজ্ঞা ও বাণিজ্যযুদ্ধে দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করার একটা জনপ্রিয় আখ্যান তৈরি হয়েছে। অনেক মানুষ ভাবছেন এ ভাবে আমেরিকা তার হৃত গৌরব ফেরত পাবে। আবেগই অর্থনীতির শেষ কথা হয়ে উঠছে।

প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ধারণাও দ্রুত বদলেছে। বিশেষ ক্ষমতার অবাধ ব্যবহার, বিচারবিভাগের উপর রাজনৈতিক চাপ এবং প্রশাসনিক সংস্থায় অনুগতদের বসিয়ে প্রতিষ্ঠানের শক্তি খর্ব করা প্রভৃতি প্রক্রিয়ায় প্রেসিডেন্ট পদটি এখন ব্যক্তিগত ক্ষমতার কেন্দ্রে রূপান্তরিত। ট্রাম্প আবারও প্রমাণ করেছেন, জনপ্রিয়তা থাকলে অনেক কিছু মেনে নেওয়া যায়।

আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেককে প্রশ্ন করেছিলাম, ভবিষ্যতে আমেরিকান গণতন্ত্র কি কেবল প্রতিষ্ঠাননির্ভর থাকবে, না কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করবে? অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী রাখার পক্ষে। তুলনায় স্বল্পশিক্ষিত যাঁরা, তাঁরা ব্যক্তির দক্ষতা ও নীতির কার্যকারিতাকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ডেমোক্র্যাটদের আধাখেঁচড়া নীতি ও প্রথাগত রিপাবলিকানদের শূন্য বাকতাল্লা বহু মানুষকে ট্রাম্পের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। অনেকেই বেশি চিন্তা ও যুক্তির জটিলতার বদলে শক্তিশালী রক্ষণশীলতাকেই যুগোপযোগী বলে মেনে নিচ্ছেন।

মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে অ-বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা এবং এক বিকল্প তথ্যজগৎ সৃষ্টি ট্রাম্পীয় কৌশলের অন্যতম স্তম্ভ। এর মাধ্যমে তিনি এমন এক কল্পিত-বাস্তবতা নির্মাণ করেন যেখানে মতামত আর সত্যের সীমারেখা বলে কিছু নেই। আজকের আমেরিকায় বহু নাগরিক একে অপরের সঙ্গে রাজনৈতিক বা নৈতিক ভাবে নয়, তথ্যগত ভাবেও একাত্ম হতে অপারগ। গণতন্ত্রের পক্ষে এর থেকে বিপজ্জনক সঙ্কেত আমার অজানা।

একই ভাবে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকার বিদেশনীতিতে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে, তা শুধু আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই নয়, বরং বিশ্বরাজনীতির গতিপথকেও গভীর ভাবে প্রভাবিত করছে। জবরদখলের মনোভাব, ব্যবসায়িক দরাদরি, স্বল্পকালীন লাভ-ক্ষতির নিরিখেশত্রুমিত্র বিচার, এবং বিশ্বাসযোগ্যতার একান্ত অভাব বিশ্ব-রাজনীতিকে আজ এক নতুন সন্ধিক্ষণে নিয়ে এসেছে।

আমেরিকা আজ এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি: কী ভাবে আবার গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ফিরবে, বহু মানুষের স্বপ্নের বাসভূমির পুরনো চেহারাটা ফিরবে? ট্রাম্প আমেরিকার দীর্ঘকালীন সঙ্কটমথন থেকে যা তৈরি করেছেন, সে দেশের আত্মপরিচিতিকে তা সবেগে ও সমূলে নাড়া দিয়েছে।

মনে রাখা দরকার, ফ্যাসিবাদ নিঃশব্দে আসে। ফ্যাসিবাদ বেড়ে ওঠে আবেগকে ঘিরে, যুক্তিকে নয়। ফ্যাসিবাদ প্রচার পছন্দ করে, সত্যকে নয়। এবং তার প্রধান জোর মানুষের নিরাপত্তাহীনতা। জনপ্রিয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হতে পারে, যদি সমাজ ও রাজনীতির অন্তর্লীন মূল্যবোধে পরিবর্তন আনতে সে সফল হয়। এই মুহূর্তের আশঙ্কা— আমেরিকায় সেই পরিবর্তন এসেও যেতে পারে। আশা থাকুক, এই আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump American Precident

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy