আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র একটা অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এক দিনের সঙ্কট নয়, অনেক দিনের সমস্যা। আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। আত্মঘাতী চেষ্টা। এখন মনে হচ্ছে, আত্মহননে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আদৌ উৎসাহ ছিল না। তাই তিনি তাঁর পূর্ব-ঘোষিত শুল্কনীতি থেকে একটু-একটু করে পিছিয়ে আসছেন। ট্রাম্প কেন আমদানি শুল্ক বাড়ানোর কথা ঘোষণা করলেন, আর কেনই বা পিছিয়ে এলেন— এটা বোঝার জন্য আমেরিকার সঙ্কটটা বোঝা দরকার।
পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থব্যবস্থায় কিসের সঙ্কট? এমনও তো নয় যে, আমেরিকান অর্থনীতিতে দীর্ঘ দিন মন্দা চলছে। বরং উল্টোটাই। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার ঠিক আগে বেকারত্বের হার বেশ কমে গিয়েছিল, বৃদ্ধির হার ছিল যথাযথ। পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা এবং সবচেয়ে অর্থবান দেশ হিসাবে আমেরিকার জায়গাটা অটুট ছিল। কিন্তু স্ববিরোধী মনে হলেও এটাই সত্যি যে, আমেরিকার আর্থিক শক্তিই ছিল তার দুর্বলতার উৎস। যে সঙ্কট আমেরিকায় তৈরি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ-বাজারে আমেরিকান ডলারের শক্তি ও একাধিপত্য, যা সার্বিক ভাবে আমেরিকার আর্থিক শক্তিকেই চিহ্নিত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আমেরিকান ডলারের আধিপত্য শুরু। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বোঝা গেল যে, ব্রিটেন নয়, আমেরিকাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ— আর্থিক ভাবে, সামরিক ভাবে, রাজনৈতিক ভাবেও। ফলে, ১৯৪৪ সালে নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস-এ চুয়াল্লিশটি দেশের সম্মেলনে ঠিক হল যে, আমেরিকান ডলারের মূল্য সোনার নিরিখে স্থির থাকবে, এবং অন্যান্য দেশের মুদ্রার মান স্থির থাকবে আমেরিকান ডলারের নিরিখে। উদ্দেশ্য, আন্তর্জাতিক লেনদেনকে স্থিতিশীল রাখা। এই ব্যবস্থা অবশ্য খুব বেশি দিন টেকেনি— সত্তর দশকের মধ্য ভাগে পৌঁছে ভেঙে পড়ে ব্রেটন উডস বন্দোবস্ত। সোনার নিরিখে ডলারের দাম ক্রমশ পড়তে থাকে। ডলারের নিরিখে অন্যান্য দেশের মুদ্রার দামেও ওঠাপড়া শুরু হয়।
ব্রেটন উডস বন্দোবস্ত ভেঙে পড়লেও ডলারের গুরুত্ব কিন্তু কমল না। বাজারে চাহিদা আছে বলে আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারই বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে রয়ে গেল। কিন্তু ডলারের চাহিদা বজায় রইল কী ভাবে? এটা ঠিক যে, লৌহ যবনিকার আড়ালে থাকা দ্বিতীয় বিশ্বকে বাদ দিলে, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেরই তখন প্রধানতম বাণিজ্যসঙ্গী আমেরিকা। তারা আমেরিকায় পণ্য বিক্রি করছে, আমেরিকা থেকে পণ্য কিনছে। যত দিন বহির্বিশ্ব আমেরিকায় পণ্য বিক্রির তুলনায় সেখান থেকে পণ্য বেশি কিনছে, তত দিন ডলারের চাহিদা এবং গুরুত্ব বজায় থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ সে ক্ষেত্রে বাণিজ্যসঙ্গী দেশ আমেরিকায় শুধু জিনিসপত্র রফতানি করে সে দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম পুরোপুরি মেটাতে পারছে না, বাকিটা ডলার দিয়ে মেটাতে হচ্ছে— ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা থেকে যাচ্ছে।
১৯৬০ থেকে ১৯৮১, এই একুশ বছরের মধ্যে পনেরো বছর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট বা চলতি বাণিজ্য খাতে উদ্বৃত্ত ছিল। অর্থাৎ, এই ১৫ বছরে আমেরিকা বিদেশ থেকে যত জিনিস কিনেছে, তার তুলনায় বিদেশে বিক্রি করেছে বেশি। এই সময়ে ডলারের আধিপত্য বজায় থাকাটা মোটেই আশ্চর্য নয়। আশ্চর্য হল, ১৯৮১-র পরের ৪৩ বছর ধারাবাহিক ভাবে আমেরিকার চলতি খাতে ঘাটতি বেড়েই চলেছে— রফতানির তুলনায় আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ বেশি— কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের কদর বিন্দুমাত্র কমেনি। প্রক্রিয়াটা বিশ্বায়নের পরে আরও জোরদার হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশ, চিন যাদের মধ্যে অগ্রগণ্য, প্রচুর পণ্য আমেরিকায় বিক্রি করছে, কিন্তু তুলনায় আমেরিকা থেকে আমদানি করছে কম। ফলে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি দ্রুত হারে বাড়ছে। অর্থনীতির কেতাবি তত্ত্ব বলবে, কোনও দেশের চলতি খাতে ক্রমাগত ঘাটতি বাড়তে থাকলে তার মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটবে। আমেরিকার ক্ষেত্রে এটা ঘটছে না কেন?
চলতি খাতে ঘাটতি থাকা মানে বিদেশ থেকে ধার নিয়ে আমদানির খরচ মেটানো। আমেরিকাও তাই করছে। কিন্তু অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমেরিকার তফাত হল, পৃথিবীর সব দেশ আমেরিকাকে ধার দিতে উদ্গ্রীব। এর কারণ, বহির্বিশ্ব ডলারকে পৃথিবীর নিরাপদতম মুদ্রা মনে করে। এই ধারণা ২০০৭-এর ‘সাব-প্রাইম ক্রাইসিস’-এর পর আরও পোক্ত হয়েছে। ধার দেওয়া মানে ডলার অথবা ডলারে ফেরতযোগ্য আমেরিকান সরকারের ঋণপত্র ধরে রাখা। বহির্বিশ্ব তার মোট সম্পদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ডলার অথবা ডলারে ফেরতযোগ্য আমেরিকান সরকারের ঋণপত্রে সঞ্চিত রাখছে। অর্থাৎ, বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়াও সম্পদ সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করছে ডলার। ফলে ডলারের চাহিদা বা মূল্য কোনওটাই কমছে না। কিন্তু বাণিজ্য ঘাটতি যত বাড়ছে, তত বাড়ছে বহির্বিশ্বের কাছে আমেরিকান সরকারের ঋণ।
গত শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকে বামপন্থীদের প্রিয় তত্ত্ব ছিল ‘নব্য উপনিবেশবাদ’। তাঁরা বলতেন, বড়লোক দেশগুলো আর সরাসরি গরিব দেশে সাম্রাজ্য স্থাপন করে না। তার বদলে সেখানকার বাজারের দখল নিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করে। বিনিময়ে কিন্তু গরিব দেশগুলো ধনী দেশের বাজারে তেমন কিছু বিক্রি করতে পারে না। ফলে ধনী দেশগুলোর কাছে গরিব দেশগুলোর ঋণ বাড়তেই থাকে। এ ভাবে গরিব দেশগুলোর সমস্ত সম্পদ ধনী দেশগুলো দখল করে নেয়। এখন ব্যাপারটা উল্টে গিয়েছে। বামপন্থীরা কি একে বিপরীতমুখী উপনিবেশ স্থাপন বলবেন?
ডলারের চড়া দাম আন্তর্জাতিক পণ্য বাজারে আমেরিকাকে সমস্যায় ফেলছে। অন্যান্য মুদ্রার তুলনায় ডলারের দাম বেশি বলে বহির্বিশ্বে আমেরিকান পণ্যের দাম বেশি, আমেরিকার অভ্যন্তরে বিদেশি পণ্যের দাম কম। এর ফলে আমেরিকায় রফতানির তুলনায় আমদানি বাড়ছে, বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে, বহির্বিশ্বের কাছে ঋণ বাড়ছে তো বটেই, কিন্তু আরও বড় সমস্যা, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে আমেরিকায় অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষ কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের জীবনযাত্রার মান পড়ে গেছে। উপরন্তু অতিরিক্ত আমদানি-নির্ভরতা আমেরিকাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ফলে যদি আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, দেশের বন্ধ কারখানাগুলো তো রাতারাতি খোলা যাবে না। যেমন, বর্তমানে আমেরিকার সিংহভাগ ইস্পাত আসে চিন থেকে। যদি কখনও চিনের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ বাধে, চিন থেকে ইস্পাতের আমদানি বন্ধ হয়ে যায়, আমেরিকা অস্ত্র তৈরি করতে প্রবল অসুবিধায় পড়বে।
তা ছাড়া বহির্বিশ্বের কাছে ঋণ বেড়ে যাওয়ার সমস্যাও আছে। যত দিন বহির্বিশ্ব বিশ্বাস করছে যে ডলারের দাম পড়বে না, তত দিন আমেরিকার অসুবিধা নেই। কিন্তু এই বিশ্বাসের বুদ্বুদ কখনও ফেটে গেলে সকলেই ডলার বিক্রি করার চেষ্টা করবে, আমেরিকান সরকারের ঋণপত্রগুলোও বিক্রি করার চেষ্টা করবে। ফলে ডলারের অবমূল্যায়ন ঘটবে, আমদানির খরচ বাড়বে, দেশের উপভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একই সঙ্গে ঋণপত্রের দাম কমবে, সুদের হার বাড়বে, বিনিয়োগ কমবে, দেশে কর্মহীনতা এবং বিপুল অস্থিতি ছড়িয়ে পড়বে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর চেষ্টা করেছিলেন। আশা ছিল, আমদানি শুল্ক বাড়লে আমদানি কমবে, দেশের কলকারখানাগুলো আবার চালু হবে, শ্রমিকরা তাঁদের হারানো কাজ ফিরে পাবেন। এই কাজ-হারানো শ্রমিকরা ট্রাম্পের ভোটব্যাঙ্কের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। কার্যত কিন্তু সে রকম ঘটল না। আমেরিকান আমদানি শুল্কের প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমেরিকার বাণিজ্যসঙ্গীরাও নিজেদের দেশে আমদানি শুল্ক বসাল। একটা শুল্কযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হল। আমেরিকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যই বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। এই আত্মঘাতী শুল্কযুদ্ধ থেকে ট্রাম্প এখন পিছিয়ে আসছেন। তাঁর সহযোগী পুঁজিপতিরা তো শুল্কযুদ্ধ চান না, মুক্ত বাণিজ্য চান।
ট্রাম্পের পিছিয়ে আসার একটা তাৎপর্য, আমেরিকার সমস্যাগুলো মিটল না। গভীরতর প্রশ্ন, ট্রাম্প কি জানতেন না যে, আমেরিকা শুল্ক বাড়ালে অন্যরাও শুল্ক বাড়াবে, একটা শুল্কযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হবে? সম্ভবত জানতেন। এটাও জানতেন, শুল্কযুদ্ধ থেকে তাঁকে পিছিয়ে আসতেই হবে, কারণ তাঁর আসল আনুগত্য পুঁজিপতিদের প্রতি। তবে শ্রমিক-ভোটারদের জন্যে একটা লোক-দেখানো চেষ্টা করাও দরকার। চেষ্টা ব্যর্থ হলে শ্রমিক-ভোটাররা হয়তো অখুশি হবেন। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু যায় আসে না। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তো আর কখনও ভোটে দাঁড়াতে হচ্ছে না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)