E-Paper

পায়ের নীচে মাটি কাঁপছে

পশ্চিমবঙ্গও ভূমিকম্পের রেড অ্যালার্টে রয়েছে। বাংলার অবস্থান গড়ময়না-খণ্ডঘোষ চ্যুতি এবং শিলং প্লাটো সিসমিক আর্কের উপর হওয়াতে পশ্চিমবঙ্গে ৭ ও তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।

কৌশিক ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২৫ ০৬:৩১
Share
Save

আমাদের পায়ের নীচের মাটি ক্রমশ অশান্ত হয়ে উঠছে। ২০২৫ সাল শুরু হয় তিব্বতের ভূমিকম্প দিয়ে। মায়ানমারে ভয়াবহ কম্পনের পর কেঁপে ওঠে নেপাল, শিলিগুড়ি, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা, কলকাতা, মহারাষ্ট্র। তাইওয়ান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তানেও কম্পন অনুভূত হয়। এশীয় উপমহাদেশ জুড়ে তৈরি হয়েছে চরম উদ্বেগ। ইন্দো-অস্ট্রেলীয় পাতের ক্রমাগত উত্তর দিকে সরে যাওয়াই এই ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রধান কারণ। বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পীয় সীমারেখায় অবস্থিত হওয়ায়, ভারতকে এই বাস্তবতার মোকাবিলা করতে দ্রুত পদক্ষেপ করতে হবে।

ভারতের প্রায় ৫৯% ভূমি মাঝারি থেকে মারাত্মক ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের (ভূকম্পীয় অঞ্চল ২ থেকে ৫) মধ্যে অবস্থিত। হিমালয় পর্বতমালা, যার নীচে ভারতীয় পাত প্রতি বছর পাঁচ সেন্টিমিটার করে তিব্বতের দিকে সরছে, এক অন্যতম ভূকম্পন প্রবণ এলাকা। জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মধ্য হিমালয়ের প্রধান ফাটল অঞ্চলে ১৫০৫ সালের পর কোনও বড় ভূমিকম্প হয়নি। তাই সেখানে ৮ মাত্রার বেশি জোরালো ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দিল্লি-গুরুগ্রাম অঞ্চলও কম্পনপ্রবণ। সেখানে সাতটি সক্রিয় ফাটল থাকায় দেশের রাজধানী অঞ্চল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। গুজরাতের কচ্ছ এলাকাও ভূমিকম্পপ্রবণ।

পশ্চিমবঙ্গও ভূমিকম্পের রেড অ্যালার্টে রয়েছে। বাংলার অবস্থান গড়ময়না-খণ্ডঘোষ চ্যুতি এবং শিলং প্লাটো সিসমিক আর্কের উপর হওয়াতে পশ্চিমবঙ্গে ৭ ও তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। কলকাতা এক বিশালাকার ব-দ্বীপের উপরে অবস্থিত, এবং এর নীচে রয়েছে নরম পলিমাটি। গবেষকদের মতে, গঙ্গার নিকটবর্তী কলকাতা ও হাওড়ার মাটির নীচে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়েছে বহু রন্ধ্র। এই রন্ধ্রগুলি দিয়ে ভূগর্ভস্থ জল বেরিয়ে যাওয়ায় নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর। ফলে ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে আমাদের পায়ের তলার মাটি। জোয়ারের সময় গর্তগুলো আরও প্রসারিত হচ্ছে, দুর্বল করে দিচ্ছে মাটিকে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বেপরোয়া ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন। এর জেরে মাটি আরও ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে। এই দুর্বল মাটির উপর অপরিকল্পিত ভাবে বহুতল নির্মাণ, ৬ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্পে, ধসে যেতে পারে অনায়াসে।

কেন্দ্রীয় সরকার ভূমিকম্প সংক্রান্ত গবেষণা এবং প্রস্তুতি জোরদার করতে পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে। ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য শতাধিক পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে এবং ভূমিকম্পের সতর্কতা জারি করতে চালু করেছে ‘ভূকম্প’ অ্যাপ। আইআইটি রুড়কী তৈরি করেছে প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা। ভূকম্পনের ধ্বংসাত্মক এস-ওয়েভ আঘাত হানার আগেই যন্ত্রটি পি-ওয়েভ শনাক্ত করতে পারবে। ফলে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার পর্যাপ্ত সময় পাবে। ইনস্টিটিউট অব সিসমোলজিক্যাল রিসার্চ এবং এনজিআরআই যৌথ ভাবে মাইক্রোজ়োনেশন সমীক্ষা চালিয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনীয় বিল্ডিং কোড-এর নির্দেশিকা দিয়েছে। ভারতকে যন্ত্রমেধা-চালিত প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, অনেকটা স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি ডিপসেক-এর আদলে, যা মাটির কম্পনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ভূমিকম্পের নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারবে। এই ধরনের যন্ত্র তৈরি করার জন্য ভারত সরকারের দেশের গবেষণা সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।

ভূমিকম্প এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একে আটকানো সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞান, সুপরিকল্পনা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর ক্ষতির প্রভাব কমানো যায়। সম্প্রতি জাপানে আসন্ন ভূমিকম্পের পূর্বাভাস সেখানকার সুপরিকল্পিত প্রস্তুতির উদাহরণ। সেখানকার প্রাথমিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রাথমিক কম্পন শনাক্ত করে সতর্কতা জারি করে। ফলে হাতে সময় থাকতে থামানো যায় ট্রেন, সরানো যায় মানুষজনকে, বন্ধ করা যায় স্কুল-অফিস-দোকান-কারখানা। ভারতও ক্রমশ একই ধরনের পদক্ষেপ করছে। গুজরাতের ভুজে ভূমিকম্পের পরে রাজ্য প্রশাসন ভূমিকম্প কেন্দ্রিক নিরাপত্তার মান মেনে পরিকাঠামো পুনর্নির্মাণ করেছে। পুরনো নির্মাণগুলিকে শক্তিশালী করেছে। সেখানকার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই মডেল দেশের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলেও অনুসরণ করা উচিত।

তবে, শুধুমাত্র প্রযুক্তি ব্যবহার করলেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি নিয়মকানুন আরও কঠোর করা জরুরি। ভূমিকম্পের আগে সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে। ‘ড্রপ, কভার, হোল্ড অন’-এর মতো সাধারণ নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে আরও বেশি করে ভূমিকম্প সহনশীল পরিকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হবে। জনগণকে নিজেদের মধ্যে ‘এভাকুয়েশন প্ল্যান’ তৈরি করতে হবে। এ ছাড়াও, স্কুলগুলোতে নিয়মিত মক ড্রিল-এর ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া গেলেও, নির্দিষ্ট সময় জানানো অসম্ভব। তাই শুধু পূর্বাভাস নয়, নাগরিকদের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচার মানসিক প্রস্তুতিও নিতে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Earthquake awareness

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।