খাবার টেবিলে স্ত্রী-সন্তান গৃহকর্তার সঙ্গে গল্প করতে চাইছেন অথচ তাঁর চোখ মোবাইলে, কপালে চিন্তার ভাঁজ। রাত গভীর তবু বাড়ির বধূ ল্যাপটপে, বাড়ির সবাই গোঁসা করে বসে টিভির সামনে। এ কালের বাংলা ছবিতে এমন দৃশ্য পরিচিত। কর্মজীবন ও পরিবারজীবনের মাঝের সীমারেখা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। কোভিড-উত্তর কালে তো গুলিয়েই যাচ্ছে কোনটা ‘ওয়ার্ক’ আর কোনটা ‘হোম’। বিশ্ব জুড়ে বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে ফোন, ল্যাপটপ। বেসরকারি কর্মীদের এই ডিজিটাল কারা থেকে মুক্তি দিতে কেরল রাজ্য সরকার সম্প্রতি বিল আনার কথা জানিয়েছে: ‘সংযোগ ছিন্ন করার অধিকার বিল, ২০২৫’।
প্রস্তাবিত বিলটির বয়ান সহজ, যুগোপযোগী। কর্মস্থলে ‘ডিউটি’র সময়ের পরেও কর্তৃপক্ষের যে সব মেল, ফোন কল, ভিডিয়ো কনফারেন্স ইত্যাদি বেসরকারি কর্মীদের ব্যক্তিজীবনে কর্মজীবনের অনধিকার প্রবেশ নিশ্চিত করছে, তার চাপ থেকে তাঁদের মুক্তি দেওয়া। অর্থাৎ নির্ধারিত কর্মসময়ের বাইরে এ ধরনের ই-আহ্বান এলেও, তাতে সাড়া না দিলে তাঁর শাস্তি বা পদাবনতি হবে না। কর্মীর কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। এই বিল আইনে রূপান্তরিত হলে কতকগুলি ধাপের মধ্য দিয়ে পুরো পদ্ধতিটিকে এগোতে হবে। প্রথমেই প্রয়োজন কর্মসময়ের সংযোগ ছিন্ন করার জন্য সময়ের একটি সীমা নির্ধারণ। এর সঙ্গে ভেবে রাখতে হবে নানা ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি, বিশেষত আপৎকালীন অবস্থার কথা। কর্মসময় ও অবকাশের সময়কে যথাযথ সংজ্ঞায়িত করতে হবে। দুই, তৈরি করতে হবে জেলা স্তরের অভিযোগ নিষ্পত্তি কমিটি। আঞ্চলিক যুগ্ম শ্রম আধিকারিকের নেতৃত্বে পাঁঁচ বছর মেয়াদের এই কমিটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যক্তির কর্মীজীবন ও পারিবারিক জীবনের সামঞ্জস্য করতে গিয়ে উদ্ভূত সমস্যার দিকে নজর রাখবে, সমাধান করবে।
তিন, কর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে নিজস্ব নীতি তৈরি করবে। চার, সমস্যার অভিযোগ, সমাধান, কর্মীদের স্বাস্থ্য, প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। নীতি অস্বীকার করে কোনও কর্মীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে কি না, তাঁর অধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে (যেমন সংবাদমাধ্যম, আই টি, স্বাস্থ্য, আপৎকালীন সেবা) অতিরিক্ত কর্মসময়ের চাহিদা বুঝে ধীরে এগোতে হবে। ম্যানেজার থেকে সাধারণ কর্মী, সকলকেই ‘ডিজিটাল হাইজিন’, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
যে কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অধিকার আছে স্বাস্থ্যকর ও সম্মানজনক ভাবে পেশাগত ও পারিবারিক জীবন কাটানোর। এ-ও এক ধরনের মানবাধিকার। পরিবারের জন্য নির্ধারিত সময়েও যদি মেল, মেসেজ দেখায় ব্যস্ত থাকতে হয়, কর্মীকে তা মানসিক চাপে ফেলে। খিদে, ধৈর্য কমে যায়, মন অন্যমনস্ক থাকে। এই নিয়ে বিশ্ব জুড়ে বহু গবেষণা হয়েছে। কোনও গবেষণা বলছে, অফিসের পর ইমেল পড়া বন্ধ হলে কর্মী কম ক্লান্ত হবেন, কর্তৃপক্ষের উপর তাঁর আস্থা বাড়বে৷ একটি সমীক্ষা বলছে, অফিসের সময়ের বাইরেও কাজ করতে হলে উৎপাদন সামান্য বাড়ে বটে, কিন্তু বেশি বাড়ে পারিবারিক অশান্তি ও মানসিক চাপ। অন্য এক সমীক্ষাও জানাচ্ছে, সংযোগ ছিন্ন করার এই অধিকার কর্মীদের জীবনে ইতিবাচক ছাপ ফেলে, কাজে সন্তুষ্টি বাড়ায়। ফ্রান্স ইটালি বেলজিয়াম পর্তুগাল আয়ারল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া-সহ ১৩টি দেশ কর্মীদের এই সুবিধা দেওয়ার পথে হেঁটেছে।
‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস’ বলে, প্রত্যেক কর্মীর বিশ্রাম ও অবসর যাপনের অধিকার আছে। সে জন্য যুক্তিসঙ্গত ভাবে স-বেতন ছুটি ও কাজের সময়ে কাটছাঁট প্রয়োজন। তবু পরিসংখ্যান মতে, ডিজিটাল শ্রমিকের স্ক্রিন-টাইম অনেক সময় ৯৬ ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছে। আমেরিকায় ৮৩ শতাংশ কর্মীই পেশাগত চাপে কাহিল। ভারতেও ২১-৩০ বছর বয়সিদের ৬৪ শতাংশ বেসরকারি কর্মী প্রবল মানসিক চাপে। সবচেয়ে কাহিল মহিলা কর্মীরা, পরিবারও যাঁদের প্রাত্যহিক দুর্ভোগের কারণ। এ দেশের শ্রম আইনে প্রাত্যহিক নয় ঘণ্টা ও সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টা কাজের কথা বলা আছে। মহারাষ্ট্র ও গুজরাতের বিজেপি-শাসিত সরকার সেই সময়সীমা দীর্ঘতর করার পথে।
এই পরিস্থিতিতে কাজ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অধিকারের সপক্ষে বিল আনার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। আবার কিছু প্রশ্নও জাগে। আজ যখন কর্মস্থলের সঙ্গে গোটা বিশ্ব জুড়ে থাকে, তখন কর্মসময়কে নির্দিষ্ট ভাবে সীমিত করে কি কাজ চালানো যায়? আপৎকালীন কাজের ক্ষেত্রে এই অধিকারের কী হবে? স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বা সংবাদ-সংস্থার কর্মীদের পক্ষে কি এই সংযোগ ছিন্ন করার নিয়ম মেনে চলা সম্ভব? প্রতিষ্ঠান এমন নীতি গ্রহণ করলেও তার প্রয়োগ কি যথাযথ করা যাবে? এমন একটি আইন রাজ্য তথা জাতীয় পর্যায়ে আনতে হলেও অনেক চিন্তাভাবনা দরকার। সরকারি ক্ষেত্রেও কি এখন সবাই নির্দিষ্ট কর্মসময়ে সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন? মহিলারা কোনও কর্মপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকুন বা না থাকুন, সংসার কি তাঁদের ছুটি দেয়? তাঁদের দম নেওয়ার অবকাশটুকু মিলবে কি? তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যেরই বা কী হবে?
ভারতের মতো সমস্যাপীড়িত ও জনসংখ্যা-জর্জরিত দেশে আপাত-ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও গভীর পর্যালোচনা দরকার। আবার বিষয়টিকে তামাদি করে ফেলাও অসঙ্গত। প্রয়োজন সঙ্কীর্ণ রাজনীতি থেকে মুক্ত, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, যা দেশ ও দশের প্রতি সমান মানবিক, বাস্তববাদী হবে। উৎপাদন ও কর্মীদের সুস্বাস্থ্য, দু’টোই সমান দরকার। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কও বুঝতে হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)