Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র হয় না
Bangladesh

৫০ বছর আগে বাংলাদেশ যে শিক্ষা দেয়, ভারতের জন্য তা জরুরি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছিল অন্য রকম। কিছু দিন আগেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ছোট দেশ কিউবা, স্পর্ধায় মাথা তুলছে ভিয়েতনাম।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২১ ০৬:১৩
Share: Save:

এখনও তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সুকান্ত লিখেছিলেন ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’ কবিতায়। সেই উদ্বেল হয়ে ওঠাটা বাঙালির আজও আছে। আরও দীর্ঘ দিন থাকবে। সত্তর দশকে বড় হয়ে ওঠা আমাদের প্রজন্মের বাঙালি আরও একটি গান শুনলে উদ্বেল হয়ে ওঠে। ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’ লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর ও কণ্ঠ ছিল অংশুমান রায়ের। সেই মুজিবুরের আজ জন্মশতবর্ষ। ‘বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ’-এ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এপার বাংলা, ওপার বাংলা: ভূগোলকে ভাগ করে দিয়েছে ইতিহাস। দুই বাংলার মাঝখানে রাষ্ট্র তুলেছে কাঁটাতারের বেড়া। তবুও মনের জানালা খোলা। সেই খোলা জানালা দিয়ে মুজিবুরের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ভেসে আসে অংশুমান রায়ের সুর। ভাল থেকো বাংলাদেশ। সুবর্ণজয়ন্তীর উষ্ণ অভিনন্দন।


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছিল অন্য রকম। কিছু দিন আগেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ছোট দেশ কিউবা, স্পর্ধায় মাথা তুলছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের পাশে ভারত। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েট ইউনিয়ন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন সমাজতন্ত্র। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু নতুন দেশের যাত্রাপথ সুগম ছিল না। তীব্র আর্থিক সঙ্কট ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যাত্রাপথ কণ্টকাকীর্ণ হওয়ারই তো কথা। চার বছরের মধ্যে মুজিব হত্যাকাণ্ড, সামরিক ও আধা-সামরিক শাসনের জালে আটকে পড়ল নতুন দেশ। আজ বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হন তসলিমা নাসরিন, ঘাতকের হাতে নিহত হন রাজীব হায়দার, শফিউল ইসলাম, অভিজিৎ রায়, বাংলাদেশের জেলে অত্যাচারিত হন আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলম, ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী আহমেদ কবীর কিশোর, মারা যান লেখক মুস্তাক আহমেদ। ঠিক যেন আমাদের মকবুল ফিদা হুসেন, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ, নওদীপ কউর, শিব কুমার। স্বপ্নে ও আনন্দে আমরা এক ছিলাম, আজ সঙ্কটে ও উদ্বেগেও আমরা এক।


ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা অবশ্য দুই বাংলার বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি ও মনের মিল দিয়েই নির্ধারিত হয় না। সেখানে চলে আসে দু’দেশের শাসকের দ্বারা নির্ধারিত ‘জাতীয় স্বার্থ’-এর প্রশ্ন। পঞ্চাশ বছরে মাঝে মাঝে কিছু স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্নও উঠে এসেছে, কিছু সমাধান হয়েছে, বেশ কিছু এখনও সমাধানের অপেক্ষায়। দু’দেশের মধ্যে সীমা বিবাদ তেমন নেই, কিন্তু আছে সীমান্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার প্রশ্ন। আছে জলবণ্টন, বাণিজ্য ও পারস্পরিক সংযোগের প্রশ্ন। আছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ থেকে দুই বাংলার প্রাকৃতিক সম্পদ ও জৈব বৈচিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার, পরিবেশ রক্ষার যৌথ তাগিদ। এ সব প্রশ্নেরই সহযোগিতার মাধ্যমে সমাধান কাঙ্ক্ষিত। ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার প্রশ্ন। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ হিসেবে এ ব্যাপারে ভারতের দায়িত্ব বেশি। ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রীবন্ধন শুধু দক্ষিণ নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও শান্তি ও সমৃদ্ধির পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে।


সাম্প্রতিক কালে ভারতের রাজনীতিতে বাংলাদেশ নিয়ে যে বাজার গরম হয়ে রয়েছে, তার কারণ অবশ্য দু’দেশের বাস্তবিক সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে তেমন খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর উৎস দেশভাগের ঐতিহাসিক জ্বালা-যন্ত্রণার মধ্যে নিহিত থাকলেও সেই ক্ষতকে খুঁচিয়ে তোলার রাজনৈতিক নকশাটি খুবই সমকালীন। দেশভাগের পর থেকে, মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু মানুষের এপারে আসার বাস্তব ছবিটি আমাদের সকলেরই কমবেশি চেনা।
২০০৩ সালে এনডিএ শাসনকালে নিঃশব্দে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করে এই উদ্বাস্তু জনগণের একাংশকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে দেগে দেয়। এরই সূত্র ধরে আসে এনপিআর, এনআরসি, অবশেষে ২০১৯ সালের বিভাজনকারী নাগরিকত্ব সংশোধন আইন। ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ ছিল বাজপেয়ী-আডবাণী জমানার আইনি ভাষা, বর্তমানের মোদী-শাহ-যোগী জমানায় তা রূপান্তরিত হয়েছে অমিত শাহের ‘দিমক’ চিত্রকল্পে। দিমক মানে উইপোকা, আর তাকে কী করতে হবে সবাই জানে।
বুঝতে অসুবিধে নেই যে, পুরো এনআরসি-সিএএ প্রকল্পটিই বাংলাদেশকে খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ থেকে নাকি কাতারে কাতারে অনুপ্রবেশকারী ভারতে এসে ছেয়ে গিয়েছে। তা যদি হয় তা হলে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার টেবিলে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এটাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে কখনও এই সমস্যার উল্লেখ শুনবেন না। অসমে যে এনআরসি হল তাতে বাদ পড়লেন প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ। সংখ্যাটা এক বা দু’কোটি নয়, আর যাঁরা বাদ গেলেন তাঁদের অধিকাংশই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ, ভাষার বিচারে বাংলা, অসমিয়া, নেপালি, হিন্দিভাষী মানুষ, আর ধর্মের হিসেবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষই সবচেয়ে বেশি বাদ পড়েছেন। এঁরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, বলা যেতে পারে কাগজ না-দেখাতে-পারা আনডকুমেন্টেড সিটিজ়েন বা নথিবিহীন নাগরিক।


অতীতের পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা উদ্বাস্তু জনগণ আজ ভারতের নাগরিক এবং ভোটার। অন্য সহনাগরিকদের মতো এঁরাও অনেক বঞ্চনার শিকার এবং সকলের মতোই লড়াই করে অধিকার আদায় করে নিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু ভোটারতালিকায় নাম আর পাসপোর্ট থাকা সত্ত্বেও কেউ নাগরিক নয়, এই তত্ত্ব যখন আমদানি করা হয়, তখন নাগরিকত্বের সঙ্গে নাগরিকের সমস্ত অধিকার নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়। নাগরিকের দ্বারা নির্বাচিত সরকার যখন উল্টে ‘নাগরিক নির্বাচন’ শুরু করে দেয়, তখন সেটা অম্বেডকরের সংবিধানকে, সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর পুরো অঙ্গীকারকেই রামদেবের শীর্ষাসনে ঠেলে দেয়। ‘নাগরিকত্ব প্রদান’-এর নামে নাগরিককে ‘পুনঃ উদ্বাস্তু ভব’ মন্ত্রে উদ্বাস্তু বানিয়ে ভোটের এক নতুন নোংরা খেলা খেলে। ভোটের মাছ ধরার জন্যই প্রতিবেশী দেশকে নিয়ে দেশের ভিতরে জল ঘোলা করার এই ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতি— রাষ্ট্রনীতির নিরিখেও যা অত্যন্ত অদূরদর্শী ও অনভিপ্রেত।
বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ আমাদের কী শিক্ষা দেয়? সবার আগে যে শিক্ষা মনে রাখা দরকার তা হল ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদকে বোঝার বিপদ। ধর্মের নামে দেশ গড়ে দিলেও তা ধরে রাখা যায় না। বহুভাষাভাষী দেশে ভাষা ও সংস্কৃতির টান ধর্মের বন্ধনের চেয়ে অনেক বেশি জোরালো। দেশভাগের বেদনা ও বিপর্যয় এবং পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক ভূগোল ও কঠোর শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে সিকি শতকের আগেই বাংলা ভাষার এক স্বাধীন দেশ হিসেবে উঠে আসা আমাদের জানিয়ে দিল, ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র হয় না, ধর্মের চৌহদ্দির মধ্যে সংস্কৃতিকে ধরে রাখা যায় না। ইসলামাবাদ থেকে ছড়ি ঘুরিয়ে জাতীয়তাবাদের ঘেরাটোপে ঢাকাকে ঢেকে রাখা যায়নি। বাংলাদেশের এই শিক্ষা আজ সবচেয়ে বেশি ভারতের জন্য প্রযোজ্য। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধানের দেশে মহান মিলন গড়তে হলে বহুত্বকে সম্মান করতে শিখতে হবে, বৈচিত্রকেই ঐক্যের সূত্র হিসেবে ধরতে হবে। দিল্লি বা আমদাবাদ থেকে স্টিমরোলার চালিয়ে দেশ চালানো যাবে না, ডবল ইঞ্জিনের নামে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে, কিছু কোম্পানির হাতে সমস্ত জাতীয় সম্পত্তি তুলে দিয়ে দেশকে ধরে রাখা যাবে না।


দেশভাগ থেকে এগিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ হয়েছে। দেশভাগের ব্যর্থতার জলজ্যান্ত প্রমাণ বাংলাদেশের জন্ম। সেখান থেকে আজ যদি আমাদের আবার অতীতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়, তবে তা হবে এক মহাবিপর্যয়। এই বিপর্যয় আর নয়। বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। পাশাপাশি এগিয়ে যাক বিবিধের মাঝে মহামিলনের দেশ ভারত। দু’দেশের মধ্যে সুস্থ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়ে উঠুক। রবীন্দ্রনাথের সুরে বাংলাদেশ ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে থাকুক, ‘জনগণমন’ বাজতে থাকুক ভারতের বাতাসে। সবার হৃদয়ে থাকুন রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh independence day celebration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE