Advertisement
০৪ মে ২০২৪
গান্ধী বলতেন, সনাতনী হিন্দু সঙ্কীর্ণমনা, অসহিষ্ণু হতে পারেন না
Mahatma Gandhi

সবার জন্য, সবাইকে নিয়ে

এতখানি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে কিশোর-তরুণদের বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, গান্ধীজি মরণকালে রামনাম করেছিলেন শুনে আমরা যেন দুর্বল বা বিচলিত না হই— ‘কথাটা ঠিক নয়’।

An image of Mahatma Gandhi

মহাত্মা গান্ধী। —ফাইল চিত্র।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২০
Share: Save:

সে দিনের বন্দুকটা ছিল ইটালিতে তৈরি বেরেটা এম-৯। তিনটে বুলেট ছুটেছিল ওই বন্দুক থেকে, যার গতিবেগ ছিল সেকেন্ডে ৩৬০ মিটার। এমন তিনটি গুলি পর পর বুকে এসে লাগার পর কারও পক্ষেই ‘হে রাম’ বা ‘হায় রাম’ কোনও কিছু বলা সম্ভব নয়। ফলে বুঝতেই পারছেন— ইত্যাদি।

উপরের এই অংশটা আমার বক্তব্য নয়, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটে পাওয়া যাচ্ছে। এগুলি সব জনপ্রিয় পড়াশোনা-সহচর সাইট, স্কুলপাঠ্য থেকে ইউপিএসসি— সব পরীক্ষায় কাজে লাগার মতো। এতখানি বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে কিশোর-তরুণদের বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, গান্ধীজি মরণকালে রামনাম করেছিলেন শুনে আমরা যেন দুর্বল বা বিচলিত না হই— ‘কথাটা ঠিক নয়’। গান্ধী রামনাম করেননি, রামের প্রতি তাঁর ভক্তি নেই। তাই হিন্দুহৃদয়সম্রাট নরেন্দ্র মোদীর রাম-রাজত্বের সঙ্গেও গান্ধীর যোগ নেই। নাথুরাম গডসে যেমন দাবি করেছেন যে, গান্ধী হলেন হিন্দুদের সর্বনাশক প্রতিপক্ষ, সেটাতেই তাই আস্থা রাখা যায়। গান্ধী নয়, এই ভারতে গান্ধীঘাতক হিন্দুরক্ষক গডসেই পূজনীয়। আক্ষরিক ভাবেই, ইতিমধ্যে তো তৈরি হয়েই গিয়েছে গডসে-মন্দির সমূহ।

আজকের ভারতে চালু এই সব প্রচার আমাদের এত দিনে চেনাজানা। যিনি যেটা বিশ্বাস করতে চান তিনি সেটাই বিশ্বাস করবেন, যুক্তি তথ্যের ধার ধারবেন না, তত্ত্বেরই তো না-ই, এ সবও ইতিমধ্যে বোঝা হয়েছে। তবু এখনও কিছু কথা বড় বেশি জ্বালাতে থাকে, আপত্তি না জানিয়ে শান্তি মেলে না। গান্ধী তাঁর শেষ মুহূর্তে রামের নাম করেননি বলে যে দাবি ‌আন্তর্জালে গভীর জাল পাতছে— এই কথাটাও সেই রকম অসহ্য। কেননা, প্রথমত, দাবিটা একেবারেই ভিত্তিহীন, মিথ্যা। কোনও এক জন তো গান্ধীজির মুখে এ কথা বসাননি, সে দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকের সাক্ষ্য ও স্মৃতি থেকে তা উঠে এসেছে। দ্বিতীয়ত, এমন অনেকেই এ কথা বলেছেন, যাঁদের এটা বলায় কোনও স্বার্থ ছিল না, বরং এমনটা না ঘটলেই— অর্থাৎ গান্ধীকে সেকুলার, ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্ম-অতিক্রমী দেখানো গেলেই— যাঁরা হয়তো বেশি খুশি হতেন। তবু, তাঁরাও এটা না বলে পারেননি, কেননা এটাই সত্যি। তা ছাড়া, গান্ধীর মুখে যে শব্দ দু’টি কত স্বাভাবিক ছিল, তা তাঁর অন্য সময়ের কথাবার্তা শুনলেও বোঝা যায়।

তিন নম্বর একটা কথাও আছে। পুরো বিষয়টার মধ্যে সত্য-মিথ্যার মীমাংসাই একমাত্র সমস্যা নয়। সমস্যা আরও গভীর। গান্ধী ‘হে রাম’ বলেননি এই দাবি যাঁরা করছেন, তাঁরা আসলে আজকের দেশের রামভক্তির সঙ্গে গান্ধীর একটা দূরত্ব তৈরি করতে চান। মুশকিল হল, সে জায়গাটায় কিন্তু তাঁরা ভুল নন। ঠিকই তো, এই ২০২৪ সালের পরিব্যাপ্ত রামসংস্কৃতি থেকে গান্ধী ও তাঁর রামের দূরত্ব বিরাট, বহু-যোজন। গান্ধী রামনাম করতেন, রামভজন গাইতেন, রামভক্তি তাঁর ধর্মভাবনার মৌলিক অংশ ছিল, জীবনের শেষ মুহূর্তে রামের নামই করেছিলেন— কিন্তু গান্ধীর সেই রাম একেবারে আলাদা, গান্ধীর ধর্মও আলাদা। সেই জন্যেই এখনকার দেশে গান্ধীর প্রিয় রামভজনটি গাওয়ার সময় সন্তর্পণে গানের মধ্যে কারিকুরি করে নিতে হয়, ‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম’ বাদ দিতে হয় ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’-এর স্মরণ থেকে।

গান্ধীকে রাখতেও হয়, আবার ‘এডিট’ও করে নিতে হয়। এত ঝামেলা তৈরি করেছেন অবশ্য গান্ধী নিজেই। যে গান্ধীকে গডসে এবং আরএসএস হিন্দুদের এক নম্বর শত্রু বলে দাগিয়ে দেন, সেই গান্ধী কিন্তু আজীবন হিন্দুসমাজে প্রোথিত থেকেছেন, নিজে ধর্মভীরু থেকেছেন, নিজেকে বার বার সনাতন হিন্দুত্বে বিশ্বাসী বলেছেন। এত বেশি বলেছেন যে, দীর্ঘ সময় ধরে তথাকথিত সেকুলার মানুষরা— যাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা, চিন্তাবিদ বা ইতিহাসবিদরা আছেন, এক দিকে লিবারালরা, অন্য দিকে মার্ক্সবাদীরা আছেন— এঁরা সবাই গান্ধীর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছেন। তাঁদের চোখে গান্ধী ‘বড় বেশি রকম হিন্দু’। গান্ধী এত ধর্মবাদী বলে তাঁকে ‘সিরিয়াসলি’ নিতে চান না বহু ইতিহাসবিদ। যেমন, ইতিহাস-তাত্ত্বিক অজয় স্কারিয়া সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ঠিক এই জন্যই ২০০০ সালের আগে যদি তাঁকে জিজ্ঞেস করা হত তিনি গান্ধীর উপর ‘কাজ’ করবেন কি না, তিনি জোর দিয়ে বলতেন “না”— “আই উড হ্যাভ এমফ্যাটিক্যালি সেড— নো!” এ দিক দিয়ে দেখলে বোঝা যায় কেন নরেন্দ্র মোদী যুগে গান্ধীকে নিয়ে টানাটানি, কাজে অকাজে তাঁকে নিয়ে আইকন বানানো। নেহরুকে উঠতে-বসতে গাল দেওয়া যায়, কিন্তু গান্ধীঘাটে গিয়ে বছরে বেশ কয়েক বার প্রণতি জানাতে হয়, বিদেশে বক্তৃতায় তাঁর নাম করতে হয়। আবার অন্য দিক দিয়ে, তিনি যে আলাদা, তিনি যে বিজেপি-আরএসএসের মনোমত নন, সেটা বোঝাতে দাবি করতে হয় গান্ধী রাম-নাম করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে পারেনই না মোটে। তাঁর চরিত্র বিষয়ে নানা চমকদার গল্পকাহিনি বানিয়ে আজকের ফেক-নিউজ়-উন্মুখ ভারতীয় মনকে ভরাতে হয় যাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কানাঘুষো করতে পারে, গান্ধী ‘আসলে কত খারাপ লোক’!

এই সহজিয়া ধর্ম-উন্মাদনার কালে যাঁকেই বোঝা সহজ নয়, তিনিই ‘খারাপ’ লোক। গান্ধীর ধর্ম আর যা-ই হোক, সহজিয়া নয়। উন্মাদনা তো নয়ই। নিজেকে সনাতন হিন্দু বলতেন ঠিকই, কিন্তু সনাতন বলতে বুঝতেন সম্পূর্ণ অন্য বস্তু। রামকে মানতেন, কিন্তু সে এক অন্য রাম। ধর্মপথের কথা বলতেন, কিন্তু ধর্ম বলতে বুঝতেন গভীর চিন্তার পথে পাওয়া জীবনবোধকে।
গান্ধীর কাছে ধর্ম আসলে একটা ‘ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজ়’, বোধ ও বুদ্ধির চর্চা। ধর্ম বলতে যেমন সব ভাবনাচিন্তা বন্ধ করে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা চালু আছে, গান্ধী সেটার উল্টো পথের পথিক। হিন্দ স্বরাজ বইতে ধর্ম নিয়ে এত বিবিধ বিচিত্র গভীর কথা তাঁর, যাতে সাঁতরে হাতড়ে আসল মুক্তোটি তুলে আনা এক সাধনার বিষয়। কিছু পণ্ডিত করেছেন সেই কাজ। বলেছেন, কী ভাবে গান্ধী প্রচলিত পশ্চিমি লিবারাল সাম্য-তত্ত্বের বাইরে এক বিকল্প সাম্যের সন্ধান করছিলেন ধর্মের মধ্যে: “হোয়াট গান্ধী ডাজ় ইজ় ইনডিড আ রিফ্রেমিং অব রিলিজিয়ন” (স্কারিয়া)। ধর্ম বলতে যাঁরা লোকখেপানো মারপিট-করানো ট্রোল-বানানো সমাজনির্মাণ বোঝেন, তাঁদের পক্ষে এই বিকল্প-ধর্ম সন্ধানী গান্ধীকে হজম করার প্রশ্ন উঠতেই পারে না। তাঁদের তাই হ য ব র ল-র বেড়ালের মতো চশমাটি নিয়েই কেটে পড়তে হয়, গান্ধী-বাদ থেকে বাদ যান গান্ধী।

গান্ধীর পরিবারেই ছিল এই ‘হেটরোডক্স’ সংস্কৃতি, ধর্মসমাজ নিয়ে প্রশ্ন করা, নতুন করে ভাবার অভ্যেস। তাঁর মা ছিলেন প্রণামী সম্প্রদায়ের শিষ্যা, যেখানে গীতার পাশে কোরানকে একই মর্যাদায় গ্রহণ করা হত। তরুণ বয়সে গান্ধী নিজে রায়চাঁদভাই বলে এক জৈন সন্ন্যাসীর বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েন। বার বার বলতেন, সনাতনী হিন্দু হওয়ার অর্থ হল বাইবেল, কোরান এবং সব ধর্মগ্রন্থ সমান শ্রদ্ধা নিয়ে পড়া ও জানা। “সনাতনী হিন্দু কখনও সঙ্কীর্ণমনা হতেই পারে না।”

তিনি বলতেন, ধর্ম দিয়ে যেখানে পৌঁছতে চাই, সেখানে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান কোনও ভেদ নেই, সবাই এক রকম মানুষ, আবার অন্য দিকে ধর্ম মানে সকলের আলাদা পরিচয়, আলাদা ‘লেবেল’। এই দ্বন্দ্বের সমাধান কী? গান্ধীর মতে সমাধান হল, “টু রিটেন দ্য লেবেল অব মাই ফোরফাদার্স সো লং অ্যাজ় ইট ডাজ় নট ক্র্যাম্প মাই গ্রোথ অ্যান্ড ডাজ় নট ডিবার মি ফ্রম অ্যাসিমিলেটিং অল দ্যাট ইজ় গুড এনিহোয়্যার এলস”, অর্থাৎ “তত ক্ষণই ধর্মপরিচয়টা গ্রহণ ও বহন করা যত ক্ষণ তা আমাকে বড় হয়ে উঠতে সাহায্য করে, আর যেখানে যত শুভ আছে তার সঙ্গে মিলিত হতে বাধা না দেয়।” রামচন্দ্রের প্রতি গান্ধীর অনুভূতিটিও এর সঙ্গে যুক্ত।
রামরাজ্য তাঁর কাছে একটা আদর্শের অভিমুখ, যে আদর্শে সকলের স্থান পাশাপাশি, শান্তিপূর্ণ। রাম তাঁর কাছে যোগের রাস্তা, বিয়োগের নয়। প্রসঙ্গত, ১৯৩০ সালে তাঁর ডান্ডি মার্চকে জওহরলালের বাবা মোতিলাল নেহরু তুলনা করেছিলেন
রামের লঙ্কাযাত্রার সঙ্গে। ভক্তি নয়, আদর্শের দিক থেকেই লক্ষ্যের দিকে যাত্রা, বোঝাতে এই তুলনা টানেন মোতিলাল।

এখানেই জরুরি প্রশ্ন। শুভের জন্য ধর্ম, আর ভক্তির জন্য ধর্ম, এই সীমারেখাটা গান্ধী নিজে বুঝতে পারতেন, কিন্তু সাধারণ ভাবে সব মানুষের কি পারার কথা সেটা? এ দেশের বিস্তৃত ধর্মমূর্ছিত সমাজে রামরাজ্য থেকে রামযাত্রা, সব তো একমাত্রিক অর্থেই বোঝা হয়। আর তাই গান্ধী রামভক্ত কি না, হলে কেমন ধরনের, সব গুলিয়ে দেওয়া হয়। যে সূক্ষ্মতার সঙ্গে তিনি হিন্দু, সনাতন, রাম এই সব ভাবনা বুঝতেন, আমজনতা তা পারে না, পারতে চায় না। তাই তাঁর কাজের বহিরঙ্গটিই জনচক্ষে ধরা পড়ে, অন্তরঙ্গ ভাবনা যায় হারিয়ে। এমনই হারিয়ে যায় যে, তাঁকেই শত্রু বানিয়ে হত্যা করা যায়।

রাম-ভজনা গান্ধীকে মানুষে মানুষে যোগের ভাবনায় পৌঁছে দিয়েছিল। তাই হিংসার আঘাতে মৃত্যুবরণের মুহূর্তে স্বাভাবিকতম শব্দ দু’টিই মুখে এসেছিল, ‘হে রাম’। এ দিকে তাঁর চার পাশে যে সমাজ, তার অন্ধ ধর্মভজনা সমানেই বিয়োগ-বিভেদের বিস্ফোরণ তৈরি করে চলল। সে দিক দিয়ে দেখলে, ধর্মকে রাজনীতির মধ্যে এনে তিনি যে অভিমুখে চলতে চেয়েছিলেন, ঠিক তার উল্টোপানে‌ই এগিয়ে গেল তাঁর দেশ। এই ভারত আজ তাঁর প্রিয় ভজন থেকে তাঁর আর একটি লাইনও বাদ দিতে পারে— ‘সবকো সম্মতি দে ভগবান’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hindu Religion Ayodhya Ram Temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE