Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
‘খেলা’ বোঝা সহজ নয়
Coronavirus in India

যাকে খুশি ভোট দিন, কোভিড যেন জিততে না পারে

এক বছরের কিছু আগে করোনা মোকাবিলায় যখন প্রথম লকডাউন শুরু হয়, বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথে নেমে অগ্রণী ভূমিকা তখন বড় অংশের প্রশংসা পেয়েছিল।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৪৭
Share: Save:

ভোটের মঞ্চে কোভিড এখন কেন্দ্রীয় চরিত্র। এত দিন প্রচারের শীর্ষে ছিল মেরুকরণ, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, কেন্দ্রীয় বাহিনী, ‘গদ্দার’, ‘বহিরাগত’, ‘পিসি-ভাইপো’ ইত্যাদি। এখনও নেই, তা নয়, তবে শেষের দু’দফায় কোভিডই মধ্যমণি। ঠিক ভাবে বললে, করোনা-যুদ্ধ এই সময় সর্ব অর্থেই ভোট-যুদ্ধের থেকে অনেক বেশি জরুরি।

ভোটে হয় প্রত্যাবর্তন হবে, নয় পরিবর্তন। সেটা তো জানা কথা। কিন্তু কোভিডের এই দ্বিতীয় ঢেউ মানুষের মরণ-বাঁচন, জীবন-জীবিকার উপর কী ভাবে, কতটা ছায়া ফেলবে, তা কেউ বলতে পারেন না। ভোটের আসন্ন পর্বগুলিতে করোনা-রাজনীতিও তাই বাড়বে। ইতিমধ্যেই সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।

এক বছরের কিছু আগে করোনা মোকাবিলায় যখন প্রথম লকডাউন শুরু হয়, বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথে নেমে অগ্রণী ভূমিকা তখন বড় অংশের প্রশংসা পেয়েছিল। রাজ্যের তরফে কোভিড-তহবিল চালু করা থেকে শুরু করে কোভিড-যোদ্ধাদের জন্য বিমাকরণের মতো কিছু পদক্ষেপ করে তিনি প্রথমেই অনেকের নজর কাড়েন। পরে আবার পরিকাঠামোর অভাব, যথেষ্ট সংখ্যক পরীক্ষা না করা এবং মৃত্যুর হার কমিয়ে দেখানোর মতো নানা অভিযোগেও তিনি বিদ্ধ হন।

কিন্তু দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে রোগ বেড়ে যাওয়ার দায় কেন্দ্রীয় সরকার, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা এড়াতে পারেন কি না, সেটাও খুব সঙ্গত প্রশ্ন। ভুললে চলবে না যে, আদালতের চাপে করতে হলেও গত বছর দুর্গাপুজোর ‘মোচ্ছব’-এ রাশ টানতে নেমেছিল মমতার সরকার। ফলে পুজোর পরে করোনা বেড়ে যাওয়ার যতটা আশঙ্কা ছিল, ততটা হয়নি।

অথচ হতাশাজনক সত্যিটা হল, বিজেপি-শাসকরা করোনার ‘উৎস’ সন্ধানে দিল্লির তবলিগি জামাতের দিকে তাকালেও হরিদ্বারের কুম্ভমেলাকে সময়কালে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার প্রয়োজন বোধ করেননি। উত্তরাখণ্ডে মোদীর দলের সরকারের ‘সৌজন্যে’ পরিস্থিতি কোথায় গিয়েছে, বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন।

বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতের মতো রাজ্যে চিতা নিবছে না। শ্মশানগুলিতে ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা। অমানবিকতার নির্মম প্রদর্শন দেখছেন দেশবাসী। বলতে গেলে যেন, কিলো দরে অন্ত্যেষ্টি চলছে। গাজ়িয়াবাদে ফুটপাতে দাহ করার দৃশ্যও সামনে এসেছে! তৃণমূল-চালিত এই রাজ্যে ততখানি দুঃসময় এখনও আসেনি।

তাই কোভিড নিয়ে এখন কারও দিকে একটি আঙুল তুলতে গেলে চারটি আঙুল মোদী ও তাঁর সহচরদের দিকে ফিরবেই। বাংলায় ভোটের অন্তিম পর্যায়ে এসে সেটা বিজেপির পক্ষে কোনও ভাবে স্বস্তিকর হতে পারে না। এমনকি, বকেয়া পর্বের ভোটগুলি এক সঙ্গে করে নেওয়ার যে বিকল্প প্রস্তাব মমতা দিয়েছিলেন, বিজেপি কেন তাতে সহমত হয়ে নির্বাচন কমিশনে দাবি জানানোর কথা ভাবল না? প্রশ্নটি উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

ভ্যাকসিন, অক্সিজেন এবং ওষুধের পর্যাপ্ত জোগান না থাকা নিয়ে মমতা ইতিমধ্যেই ভোটের মঞ্চে অভিযোগ জানাতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি মোদী এখন প্রতিষেধক দেওয়ার বয়ঃসীমা আঠারো বছরে নামিয়ে আনার পরে মমতা তাঁর সকলের জন্য প্রতিষেধকের পুরনো দাবিটিও ফের রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগানোর পরিসর পেয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে তাই করোনার বলটি বিজেপিকে হয়তো কিছুটা ‘রক্ষণাত্মক’ খেলতে হবে।

তবে রোগের প্রকোপ এই রাজ্যেও বাড়ছে। বহু মানুষের ‘সচেতনতা’ এখনও নিন্দনীয় স্তরে! তাঁরা মাস্ক পরাকে অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য বলে মনে করেন। তাই শুধু মোদীর সভার জন্য ‘বহিরাগত’রা এসে করোনার প্রসার ঘটাচ্ছে বলে রাজনৈতিক অভিযোগ তোলার পাশাপাশি যাঁরা নিয়ত কোনও রকম সুরক্ষাবিধির তোয়াক্কা না করে অকুতোভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা করতে টালবাহানা হয় কেন, সেই প্রশ্নও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক।

তবু মনে হয়, করোনা নিয়ে মোদী-দিদি টক্করে আপাতত দিদির ‘অ্যাডভান্টেজ’ বেশি। অন্তত কোভিড-মোকাবিলার ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় গলদের, ফাঁক-ফোকরের প্রাথমিক জবাবদিহি মানুষ মোদীর কাছেই চাইবেন। প্রশ্ন উঠতে পারে শাসক বিজেপির প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়েও। তবে ছ’দফা ভোট হয়ে যাওয়ার পরে মাত্র দু’দফায় ‘খেলার মাঠ’ কিছুটা ছোট হয়ে যায় বইকি!

যদিও বলব, করোনা-যুদ্ধে জিততে দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠতে পারাই বাঞ্ছনীয়। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী উভয়ের কাছেই এটা ‘রাজধর্ম’ হওয়া উচিত। হবে কি না, সেটা অবশ্যই তাঁদের বিবেচনার বিষয়।

কারণ, এ বারের ভোট গোড়া থেকেই এক অভূতপূর্ব আকার নিয়েছে। এর মধ্যে সুপ্ত রয়েছে এমন এক প্রকার অনিশ্চয়তা, যা আগে দেখা যায়নি। নেতা-নেত্রীরা তাঁদের নিজ নিজ দলের জয় সম্পর্কে নিশ্চিত দাবি করবেন, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু দাবি, তত্ত্ব, গণিত সব কিছুর উপরে একটি ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ হল জন-মনের স্বাভাবিক প্রকাশ, পথে-ঘাটে যা বিশেষ গোপন থাকে না। অনায়াসে কানে আসে। আর আমজনতার সেই ধারণা থেকে যেটা আঁচ করা যায়, সোজা কথায় সেটাই হল ‘হাওয়া’। আসন সংখ্যায় কম-বেশি হলেও ফলের প্রবণতায় তা মোটামুটি মিলেও যায়। এটা বার বার দেখা গিয়েছে।

সেই চেনা হাওয়া এ বার কেমন থম মেরে আছে। যিনি যে দলের ভোটার বা সমর্থকই হোন, জয়পরাজয়ের প্রশ্নে তাঁদের বেশির ভাগই বুক ঠুকে খুব জোরের সঙ্গে কিছু বলতে পারছেন না বা বলতে চাইছেন না। বরং একে অপরের কাছে ‘জানতে’ চাইছেন, এ বার কী হবে?

মুখে না মানলেও ভোট-যোদ্ধারা সেটা বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন। সেই জন্যই কোথায়, কখন, কোন অস্ত্রে কে ঘায়েল হবেন, তা খুঁজতে খুঁজতে উস্কানি, কুৎসা, চরিত্রহনন, গালমন্দ, মিথ্যাচার, কূটতা সব কিছু এই বার চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। আক্রমণের তিরও ক্রমাগত দিক বদলাচ্ছে। শেষ লগ্নে কোভিড সেই তালিকায় আর একটি অভিমুখ তৈরি করে দিল।

২০১১-র বিধানসভা ভোটে বামেদের বিদায়-সম্ভাবনা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনোভাব ছিল স্পষ্ট। ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোট, ২০০৯-এর লোকসভা ভোট, তার পরে পুরসভার ভোট— প্রতিটিতে তৃণমূলের দাপটও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। লোকে প্রকাশ্যে বলত, এ বার পালাবদল।

কিন্তু দীর্ঘ চৌত্রিশ বছরে শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ জমলেও ২০১১-র আগে পর্যন্ত কোনও ভোটে বামেরা হেরে যাবে, তেমন ধারণা জনমনে তৈরিই হয়নি। যার অর্থ, ক্ষোভ তখনও প্রত্যাখ্যানের মানসিকতায় পৌঁছয়নি। পৌঁছল যখন, স্বয়ং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও তখন হেরে যেতে হল।

২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটেও শাসক তৃণমূল যে বাম-কংগ্রেস জোটকে হারিয়ে দেবে, সেই হাওয়া ভালই টের পাওয়া যেত। এই ধারারই সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন। বিজেপি শক্তি অনেকটা বাড়িয়ে যে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটা আগাম বোঝা গিয়েছিল।

অবশ্যই আসন সংখ্যা অনেক সময় বড় চমক তৈরি করে। যেমন ২০০৬-এ বামফ্রন্টের ২৩৫ আসন। ২০১১-তে সেই বামেদেরই মাত্র ৬২-তে বেঁধে ফেলা। ২০১৬-তে শাসক তৃণমূলের ২১১-য় পৌঁছে যাওয়া। আবার তার তিন বছরের মধ্যেই বিধানসভায় তিনটি আসনের দল বিজেপির ২০১৯ লোকসভা আসনের নিরিখে ১২৭টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে থাকা। সব ক’টি উত্থানপতনই চমকপ্রদ। আর প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের খোলামেলা মনোভাবে যে প্রবণতার আভাস মিলেছিল, সেটাই ভোটের ফলে প্রতিফলিত হয়েছে।

যুক্তি এবং অভিজ্ঞতা বলে, বদল একটি স্থির সিদ্ধান্ত। অনিশ্চয়তার আবহ সচরাচর সেখানে থাকে না। আর ‘বড়’ কোনও পরিবর্তনের ক্ষেত্রে হাওয়ায় বার্তা আগেই মেলে। তাই ভোট-পণ্ডিতেরা যে যা-ই বলুন, একটা কথা মানতে হবে, ‘খেলা’ বোঝা এ বার খুব সহজ নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE