Advertisement
E-Paper

কোভিড কর আদায় করে গরিব মানুষের মধ্যে বণ্টন করতে হবে

করোনার কোপটা বিভিন্ন পেশা ও বাণিজ্যের উপর সমান ভাবে পড়েনি, ফলে দেশে-বিদেশে তৈরি হয়েছে প্রবল বৈষম্য।

পরীক্ষিৎ ঘোষ

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২১ ০৫:১৭

দেশে করোনা আবার হুহু করে বাড়ছে। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে হবে, কিন্তু এই ঝড়ের মুখে অর্থনীতির হাল ধরাটাও জরুরি। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান মন্ত্রকের হিসেব অনুসারে, গত বছর ভারতের জাতীয় উৎপাদন ৭.৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মতে, বিশ্ব অর্থনীতির উৎপাদন কমেছে ৪.৪ শতাংশ। কিন্তু শুধু সামগ্রিক সূচকের উপর চোখ রাখলে পরিস্থিতির গুরুত্বটা বোঝা যাবে না।

করোনার কোপটা বিভিন্ন পেশা ও বাণিজ্যের উপর সমান ভাবে পড়েনি, ফলে দেশে-বিদেশে তৈরি হয়েছে প্রবল বৈষম্য। অর্থনীতিবিদ রাজ চেট্টি ও অন্যদের গবেষণায় আমেরিকায় এই বৈষম্যের চিত্রটা খুব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নিম্নবিত্ত ও অল্প শিক্ষিত মানুষের আয়ে ভাটা পড়েছে বেশি, তাঁদের দুর্দশাও তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী। লকডাউন ও বিধিনিষেধ উঠলেও তাঁদের উপার্জন ক্ষমতা পুরোপুরি ফিরে আসেনি, কারণ ছোঁয়াচের ভয়ে মানুষের আচরণ আর স্বভাবটাই গিয়েছে বদলে। লোকে পারতপক্ষে প্লেনে চাপছেন না, হোটেলে থাকছেন না, সিনেমা থিয়েটার রেস্তরাঁয় যাচ্ছেন না, বাজারহাট এড়িয়ে অনলাইনে জিনিসপত্র কিনছেন।

কিন্তু বৈষম্যটা শুধু গরিব আর বড়লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। চেট্টির পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারি যে, অতিমারির গোড়ার দিকে বড়লোক পাড়ায় বসবাসকারী নিম্নবিত্ত মানুষের উপার্জন কমেছিল ৭০ শতাংশ, কিন্তু গরিব পাড়ায় মাত্র ৩০ শতাংশ। কারণটা সহজেই অনুমেয়। সম্পন্ন এলাকায় গরিবরা মূলত সম্পন্ন লোকের পরিষেবায় নিযুক্ত থাকেন; রেস্তরাঁ, বিউটি পার্লার, শপিং মল ইত্যাদি জায়গায় জীবিকা নির্বাহ করেন। ছোঁয়াচের ভয়ে বড়লোকরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন অনেক বেশি।

শেয়ার বাজারেও এই বৈষম্যের ইঙ্গিত মেলে। ২০২০-র মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য এপ্রিল, এই তিন মাসে আমেরিকার শেয়ার বাজারে চোখ রাখলে দেখা যায় যে, বিমান বা হোটেল সংস্থাগুলোর শেয়ার দর ষাট শতাংশের বেশি পড়েছে, কিন্তু অপর দিকে আমাজ়নের দাম প্রায় পঁচিশ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সমস্ত শেয়ারের দর একই হারে উঠবে-নামবে, এমন কোনও কথা নেই, সেখানে তারতম্য থাকেই। কিন্তু এই তারতম্যের একটা সূচক বানিয়ে হিসেব করে দেখেছি যে, ২০২০-২১ সালে তার পরিমাপ বিগত দশকের তুলনায় বহু গুণ বেশি।
ওয়াল স্ট্রিট বা দালাল স্ট্রিট, এক যাত্রায় পৃথক ফল দেখা যাচ্ছে সর্বত্রই।

শেয়ার বাজারে টাকা ঢালেন মুষ্টিমেয় লোক, তাঁদের লাভ-ক্ষতি বড় কথা নয়। কিন্তু শেয়ারের অসম ওঠাপড়া এই ইঙ্গিত দেয় যে, কিছু শিল্পে কর্মীদের চাকরি ও মাইনেকড়ি নিয়ে রীতিমতো টানাটানি চলেছে, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাঁরা বহাল তবিয়তে আছেন। লকডাউনে মুদির দোকানে বিক্রিবাটা কমেনি, কিন্তু পাড়ার সেলুন দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। অধ্যাপক ও আমলারা অনলাইন কাজ চালিয়েছেন, মাইনে যথারীতি ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে। থিয়েটারের কুশীলবরা কিন্তু মাসের পর মাস উপার্জন হারিয়ে বসে ছিলেন।

১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়ে বিগত বছরের তুলনায় ধানের ফলন বেশি বই কম ছিল না। কিন্তু অনিশ্চয়তার মুখে লোকে অনাবশ্যক খরচ কমিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে ধোপা, নাপিত, দুধওয়ালা, মৎস্যজীবী, এঁদের উপার্জন ও ক্রয় ক্ষমতা প্রায় লোপ পেয়েছিল। দুর্দশার এই অসম বণ্টন যে দুর্ভিক্ষের একটা বড় কারণ, অমর্ত্য সেনের সেই বিশ্লেষণ আজকের করোনাক্রান্ত দুনিয়ায় স্মরণযোগ্য।

এই পরিস্থিতিতে দুটো পদক্ষেপ করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। প্রথমত, একটা আয়সীমার উপর যাঁরা থাকতে পেরেছেন, তাঁদের উপর বিশেষ করোনা শুল্ক বা সেস বসানো উচিত। দ্বিতীয়ত, উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে অধিকাংশ নাগরিকের জন্য ন্যূনতম মাসিক ভাতার বন্দোবস্ত করা দরকার।

সম্পদের উপর স্বল্পমেয়াদি করের সপক্ষে কেউ কেউ সওয়াল করেছেন, কিন্তু উপরের দিকে আয়কর বাড়ানোর প্রস্তাবটা তেমন কানে আসেনি। অথচ কর কিন্তু ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। করোনার ধাক্কায় গত অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে জাতীয় আয় যখন ২৫ শতাংশ পড়ল, সেটাকে ‘ভগবানের কর’ ছাড়া আর কী বলব? মুশকিল হল যে, সেই যৌথ করের বোঝাটা অদৃষ্টের পরিহাসে সমান ভাবে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়নি, সুতরাং ‘মানুষের কর’ দিয়ে বিধাতার ভুল শুধরে দেওয়াটাই সমীচীন।

করোনার মোকাবিলায় সারা বিশ্বেই রাজস্ব ঘাটতির কথা ভেবে সরকার অনেক সময় সাহায্যের মাত্রা বাড়াতে সাহস করেনি। ঘাটতি বেশি বেড়ে গেলে মুডিজ়-এর মতো সংস্থা নাকি ভারতের ঋণযোগ্যতার নম্বর কেটে দেবে। ভাগ্যবানের উপর কর চাপিয়ে ঘাটতি দমন করলে তাদের কী বলার থাকতে পারে?

কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আরও অনেক যুক্তি আছে, যা ধোপে টেকে না। ২০১৯-এ কর্পোরেট করের হার ২২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল বিদেশি পুঁজির লগ্নি বাড়াতে। লগ্নিকারীরা দীর্ঘমেয়াদি করের হার দেখে সিদ্ধান্ত নেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে স্বল্পমেয়াদি কর বাড়লেই তাঁরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালাবেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। নতুন করের বোঝা মন্দার অর্থনীতিকে আরও সঙ্কুচিত করবে, এ কথা কেউ কেউ বলতে পারেন। কিন্তু পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, সচ্ছল মানুষের সঞ্চয়ের হার বেশি, সুতরাং মন্দার সময়ে আয়ের পুনর্বণ্টন বাজারে চাহিদা বাড়ায় বই কমায় না।

পুঁজিবাদের পীঠস্থান আমেরিকায় অধিকাংশ নাগরিক দুই দফায় প্রায় তিন হাজার ডলার অর্থসাহায্য পেয়েছেন সরকারের কাছ থেকে। এ দেশে মানুষের কাছে নগদ সাহায্য তেমন পৌঁছয়নি। কোষাগারের টানাটানি ছাড়াও আরও একটা সমস্যা আছে। ভারতে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মাত্র সাত শতাংশ আয়কর দেন, অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারের হাল-হকিকত, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর আয়কর দফতরের কাছে নেই। পশ্চিমি দেশগুলোর মতো নাগরিকদের ভাতা দেওয়ার পরিকাঠামোই এ দেশে তৈরি হয়নি।

জন ধন অ্যাকাউন্টে টাকা ঢাললে সেটা সমবণ্টন হয় না, কারণ পরিবারপিছু কতগুলো অ্যাকাউন্ট আছে, তার হিসেব কারও কাছে নেই। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে অতিরিক্ত ৪০,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল, কিন্তু শহুরে শ্রমিকরা তো এই প্রকল্পের আওতার বাইরে। একটা সুযোগ অবশ্য ছিল, এখনও আছে। দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের রেশন কার্ড আছে। চাল-গমের সঙ্গে তাঁদের কিছু নগদ টাকাও দেওয়া যায় অনায়াসে।

গত কয়েক দশকে দেশে বৈষম্য যত বেড়েছে, সরকারি পরিষেবার ঘাটতি বড়লোকরা পুষিয়ে দিয়েছেন নিজেদের টাকার জোরে। তাঁরা ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুলে পড়াচ্ছেন, চিকিৎসার জন্য ছুটছেন বেসরকারি হাসপাতালে, বহুতল আবাসে জেনারেটরের কল্যাণে চব্বিশ ঘণ্টা বিজলি আর জল, গেটে উর্দিপরা দারোয়ানের সুরক্ষাকবচ। একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, ব্যক্তিগত সচ্ছলতা সবই কিনে নিতে পারে, সমাজের সামগ্রিক উন্নতির উপর আমরা নির্ভরশীল নই।

যে জীবাণু হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, বলিউডের তারকারাও কিন্তু তার হাত থেকে রেহাই পাননি। সংক্রামক রোগ-বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন অসুখের বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিরোধ হল হার্ড ইমিউনিটি বা কৌম প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলা। এ জন্যই টিকার খানিক সমবণ্টন কাম্য, ধনী দেশগুলো তা কুক্ষিগত
করতে গিয়ে নিজেদের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থেই আঘাত হেনেছে। সারা পৃথিবীতে করোনার প্রকোপ না কমলে বিশ্বায়নের যুগে বিশ্ব-অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না।

টিকার সঙ্গে টাকার কিছুটা সমবণ্টনও একই কারণে জরুরি। দরিদ্র মানুষের পক্ষে যদি জীবনধারণই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তাঁরা বিধিনিষেধ মেনে, সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে রোগ দমনে সাহায্য করবেন, তা কি আশা করা যায়? লকডাউনের সময়ে লক্ষ করে থাকবেন, অনেক খেটে-খাওয়া মানুষ জীবিকা হারিয়ে রাস্তায় আনাজ-মাছ ইত্যাদি বেচতে বসে পড়েছিলেন, তাঁদের বাড়িতে বেঁধে রাখা যায়নি। যথাযথ অর্থসাহায্য পৌঁছলে হয়তো যেত।

করোনার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিরোধটাকেও যৌথ প্রতিরোধ হিসেবে দেখা ছাড়া উপায় নেই। বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমাদের বিবেক যদি সাড়া না-ও দেয়, আপন স্বার্থ সাড়া দিলেই যথেষ্ট হবে।

অর্থনীতি বিভাগ, দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স

Indian Economy World Economy Corona virus
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy