E-Paper

সংস্কৃতি দিয়ে আধিপত্য

বিশ্ব অর্থনীতিতে দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান বা চিনের সমকক্ষ নয়; সামরিক শক্তি, খনিজ সম্পদ-সহ নানা বিষয়েও সে এদের থেকে পিছিয়ে।

শ্রীমন্তী রায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৩ ০৫:৩২
South korea.

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের জমি শক্ত করার কাজে কোরিয়ার সংস্কৃতির কৃতিত্ব নিয়ে সন্দেহ নেই। —ফাইল চিত্র।

এই প্রজন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যান্ড ‘বিটিএস’-কে বিলক্ষণ চেনে (ছবি)। এক্সো, ব্ল্যাকপিঙ্ক, শিনি, স্ট্রে কিডস-ও জনপ্রিয়, মুম্বইয়ে কোরীয় গায়ক জ্যাকসন ওয়াং-এর কনসার্ট নিয়ে ছিল তুমুল উন্মাদনা। কোরিয়ান সিনেমা ও ওয়েব সিরিজ়ের জনপ্রিয়তা দুনিয়ার মতো ভারতেও আকাশছোঁয়া।

এর পিছনে রয়েছে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ও। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ‘হার্ড’ ও ‘সফ্‌ট পাওয়ার’-এর ধারণা সুবিদিত। প্রথমটি প্রত্যক্ষ ভাবে সামরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের কথা বলে, পরেরটি অন্য দেশের উপরে পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট হয়। এই প্রক্রিয়ায় আধিপত্যকামী দেশের নিজের সংস্কৃতির প্রতি অন্য দেশকে টানার ব্যাপার আছে, আবার নিজের অর্থনীতি দৃঢ় করতে সে দেশে তৈরি নানা সামগ্রীর বাজার তৈরি করাও আছে। ‘সফ্‌ট পাওয়ার’-এর উদ্দেশ্যও ক্ষমতার বিস্তার, তবে তা হয় মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাংস্কৃতিক জনপ্রিয়তাকেও এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, জাপান বা চিনের সমকক্ষ নয়; সামরিক শক্তি, খনিজ সম্পদ-সহ নানা বিষয়েও সে এদের থেকে পিছিয়ে। ফলে বিশ্ব স্তরে প্রভাব দৃঢ় করতে দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় কুড়ি বছর আগে ‘সফ্‌ট পাওয়ার নীতি’ রূপায়ণ শুরু করে। তারই অন্যতম অস্ত্র সংস্কৃতির প্রসার। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট কিম ইয়ং-সাম বুঝতে পেরেছিলেন— তিনি সরকারের সংস্কৃতি বিভাগকে নির্দেশ দেন দশটি জাতীয় প্রতীক চিহ্নিত করে, সেগুলিকে ঘিরে বিশ্বে কোরিয়ান সংস্কৃতির প্রসার ঘটাতে। এর মধ্যে ছিল জাতীয় পোশাক, তায়কোয়ন্দো, কোরীয় খাবার কিমচি, র‌্যামেন। এখন তা প্রসারিত কে-পপ এবং কে-ড্রামাতেও। নব্বইয়ের দশকে চিনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সূত্রে প্রচুর কোরিয়ান সিনেমা, টিভি শো চিনে দেখানো হয়, কোরিয়ান নাচ-গান সহজলভ্য হয়। আজ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের জমি শক্ত করার কাজে কোরিয়ার সংস্কৃতির কৃতিত্ব নিয়ে সন্দেহ নেই। বিটিএস কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসাবে ইউনেস্কো-তে প্রতিনিধিত্ব করেছে, কোরিয়ার জিডিপি-তে বিটিএস-এর অবদান আলাদা করে দেখলে তা ফিজি, মলদ্বীপ, টোগোর মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের অঙ্কের চেয়ে বেশি।

কোরিয়ার সংবাদসূত্র অনুযায়ী, লকডাউনের সময় বিশ্বের যে ছ’টি দেশ সবচেয়ে বেশি কে-ড্রামা দেখেছে, ভারত তার অন্যতম। অধিকাংশ কে-ড্রামা অল্প সংখ্যক পর্বে শেষ হয়ে যায়, তাদের গল্প ও চিত্রনাট্য আকর্ষক, চরিত্র অনেক বেশি বাস্তব ঘেঁষা, এই প্রজন্ম একাত্ম বোধ করে। কোরিয়ার শিল্পী-অভিনেতাদের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ ও উজ্জ্বল, তাঁরা প্রচুর সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেন, দেশের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে তাঁরা সচেতন। মানব সম্পদের এই কৌশলী ব্যবহার বিশ্ব রাজনীতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার উপস্থিতি জোরালো করে তুলছে।

সফ্‌ট পাওয়ার নীতি কী ভাবে কাজ করে? ধরা যাক এক জন দর্শক একটি কে-ড্রামা দেখলেন, কোনও অভিনেতাকে তাঁর পছন্দ হল। সমাজমাধ্যমে তিনি তাঁকে ‘ফলো’ করা শুরু করলেন, তাঁর অভিনীত অন্য সিরিজ় দেখা শুরু করলেন। শুধু অভিনেতাই নয়, প্রভাব ফেলে তাঁদের জীবনযাত্রাও, ব্যবহৃত সামগ্রী, খাবার ইত্যাদি। দর্শক মনে মনে নিজের দেশের সঙ্গে সে দেশের তুলনা শুরু করেন, তাঁর এও মনে হতে পারে— যদি ওই দেশে এক বার যাওয়া যেত! এই যে অন্য দেশের প্রতি আকর্ষণ, ‘সফ্‌ট পাওয়ার’-এর সার্থকতা বা উদ্দেশ্য এটাই।

প্রযুক্তির কল্যাণে বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়, তার মাত্রাও সীমাহীন। এই পরিস্থিতিতে সফ্‌ট পাওয়ার নীতি সহজেই ফলপ্রসূ হয়। এই নীতি রূপায়ণের অন্যতম মাধ্যম ও ক্ষেত্র সেই বিরাট সংখ্যক মানুষ, যাঁদের কাছে প্রযুক্তি সহজলভ্য। তাঁরা শুধু নিষ্ক্রিয় ভোক্তা নন, সক্রিয় স্রষ্টাও। সমাজমাধ্যমের সাহায্যে তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশের নীতি নির্ধারণেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন। বিটিএস কোরিয়ার বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণে যোগ দেবে কি না, তা নিয়ে আন্তর্জালে ভোটের ব্যবস্থা হয়েছিল, সেই মতামত দেশের প্রশাসনিক স্তরে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে।

নাগরিক সমাজের উপর বরাবরই সরকার বা রাষ্ট্রের এমন এক নিয়ন্ত্রণ থাকে, যার মাধ্যমে সে নিজস্ব মূল্যবোধ প্রচার করে, পরোক্ষে নাগরিক তথা নেটিজ়েনদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করে। যে কোনও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই তার সংস্কৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাকে তার ঐতিহ্যের ভিত্তি ও পূর্ণ রূপ হিসাবে দেখা হয়; ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে দেশের ইতিহাস, ইতিহাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা স্বকীয়তা। দক্ষিণ কোরিয়ার সার্থকতা এখানেই যে, সে তার সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাকে বাজার অর্থনীতির মাধ্যমে লাভজনক করে তুলেছে, কোনও বল প্রয়োগ ছাড়াই তাদের খাবার, রূপচর্চা, পোশাক-সহ নানা ক্ষেত্রের আলাদা বাজার তৈরি হয়েছে। তার সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা অন্য দেশের মান্যতাও পেয়েছে।

সমস্যা অন্য জায়গায়। প্রযুক্তি-নির্ভর জীবন অনুকরণসর্বস্ব, আমরা তারই পিছনে ছুটে চলেছি। এটা ঠিক যে, যা নেওয়ার যোগ্য তা সব দেশ থেকেই নিতে হবে। কিন্তু পাশাপাশি চাই আত্মসমীক্ষাও: প্রচলিত বা সহজলভ্য বলেই কি ভাল লাগতে হবে? সত্যিই ভাল লাগছে তো?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

South Korea World

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy