Advertisement
E-Paper

দুয়ারে সরকারের মেলার মাঠে

ঘণ্টা দুয়েক পরে জানা গেল, ধৃত দুই যুবক টেট পরীক্ষার পর চাকরির আশায় চাষের জমি বিক্রি করে টাকা দিয়ে ঠকেছেন।

সন্দীপন নন্দী

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৫০

পৌষ মাসে পুজো নেই, বিয়ের দিনও নেই। তবু সকাল সকাল আলমারি থেকে বেরিয়েছে তুলে রাখা বাহারি শাড়ি। বাপের বাড়িতে দু’দিনের জন্য ফিরেছে মেয়ে, স্পেশাল জলখাবার তৈরি হচ্ছে তার জন্য। খুশি শ্রমিক বধূরাও— রাজস্থানের পাথর কারখানার হেলিস টুডু, সুরাতে কাপড়কলের অপারেটর ম্যানুয়েল বাস্কে দক্ষিণ দিনাজপুরের গ্রামে ফিরেছেন। একটু পরেই খুলবে ‘দুয়ারে সরকার’ শিবির।

সাড়ে দশটা নাগাদ দেখা গেল, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করার লাইনে হেলিস টুডু দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় ৭০ জনের পরে, ম্যানুয়েল বাস্কে ‘মানবিক’ প্রকল্পে নাম লেখানোর লাইন খুঁজছেন। দুয়ারে সরকারের শিবির বসেছে বালুরঘাটের একটা পার্কে। বাদাম, বেলুন, খেলনায় মেলার মুড। পার্কের ধার ঘেঁষে গোটাকতক গোলাপ আর পিটুনিয়াই হাসিমুখের পিছনে ‘সেলফি-ফুল’। করোনাবিধি মেনে দূরত্ব রাখার চেষ্টা কারও দেখা যাচ্ছে না, বেশ একটা ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে’ মনোভাব। সিভিক ভলান্টিয়াররা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে। ভিড় সামলাতে সামলাতে তাঁদেরও মাস্ক কখন যে মাফলার হয়ে গিয়েছে, খেয়াল নেই। পার্কের বাইরে পুরসভার ভ্রাম্যমাণ শৌচাগার-শকট। সেখানেও লাইন।

প্রৌঢ় দম্পতি লাইনে থেকেও একটু তেরাচা হয়ে এ-ওর সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছেন। আন্দাজ হয়, এই সেই কলেজপ্রেমের পার্ক। এক বৃদ্ধ লোকাল চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন— গৃহবন্দি দশা থেকে বেরোতে পেরেই তিনি খুশি, এই সুযোগের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ! স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড করতে আসা তন্বীর নামের মানে জানতে চাইছে কোম্পানির ভেন্ডর বয়। মেয়েটি মুচকি হেসে এগিয়ে গেল ‘রূপশ্রী’-র টেবিলের দিকে। তার বিয়ে ২২ ফাল্গুন। ছেলেটি আর কথা বাড়াল না। হঠাৎ লাইনে কারও ফোনের রিংটোনে বেজে উঠলেন সাগর সেন, ‘‘আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই!’’ রেগে গেলেন পিছনের মহিলা— ‘‘আর গান পেলেন না?’’

রূপশ্রীতে নাম তোলাতে এসেছেন তরুণী ও তাঁর বয়ফ্রেন্ড। জানালেন, বাড়ির অমত, টাকা পেলে নিজেরাই বিয়ে করে সংসার পাতবেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের ভিড়ে এমন মেয়েরা যেন খোলা বাতাস। ভিন্‌রাজ্য থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা জানালেন, আসার অনুমতি পেয়েছেন বটে, কিন্তু ভোটার কার্ড আধার কার্ড কাজের জায়গায় জোর করে রেখে দিয়েছেন মালিক-ঠিকাদার। যাতে ওঁরা ফিরতে বাধ্য থাকেন। জনজাতির শংসাপত্র নিতে আসা মহিলারা প্রায় সকলেই টিপসই দিচ্ছেন। তাঁদের অনেকেরই শৈশব, কৈশোর ফুরিয়ে গিয়েছে সর্বশিক্ষা মিশন আর শিক্ষার অধিকার আইনের ভারতে।

‘অমিতাক্ষর জ়েরক্স সেন্টার’-এর মেশিন ছাদ ছেড়ে বাড়তি পয়সার জন্য নেমে এসেছে পার্কে। সঙ্গে ল্যাপটপ, প্রিন্টার। দু’জন নীল কাপড়ের খুঁট ধরে নির্মাণ করেছেন ক্ষণিকের ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’। পাসপোর্ট সাইজ় ছবিতে মুখের পিছনে উঁকি দিচ্ছে গাছের পাতা। হঠাৎ এক আধিকারিক লাঠি হাতে তেড়ে গেলে, পার্ক ছেড়ে ল্যাপটপ বগলদাবা করে ছুটলেন দোকানি। নীলবাতির নিষেধ চলে যেতেই ফটো তোলার দোকান ফিরে এল পার্কের ভিতর।

দূরের বটগাছের তলায় এক উকিল অ্যাফিডেভিট করে দিচ্ছেন। খানিকটা ভিড় সরে যায় বটতলায়। রবিবার দুপুরের ঘুম নষ্ট করে এই বিশেষ পরিষেবায় ছুটে এসেছেন উকিলবাবু। সাইনবোর্ডে লেখা, ‘‘নকল হইতে সাবধান, স্বাক্ষরের ‘এস’ দেখিয়া লইবেন।’’ কালো কোট প্রমাণস্বরূপ ঝুলছে গাছের ডালে। তফসিলি জাতি, জনজাতির শংসাপত্রের আবেদনের জন্য দরকার নেই হলফনামার, তবু দালালরা ভুল বুঝিয়ে অ্যাফিডেভিট করিয়ে দেড়শো-দু’শো টাকা আদায় করেছে এই হতদরিদ্র, শীর্ণকায় মেয়েদের থেকে। প্রতিটি আবেদনপত্রে পিন দিয়ে অ্যাফিডেভিটের কপি সাঁটা!

শিবির বসলেই মেলা বসে যাচ্ছে। হঠাৎ হাজির সমবায় ব্যাঙ্কের ভ্রাম্যমাণ এটিএম ভ্যান। ব্যাঙ্ককর্মীর ঘোষণা, ‘‘এ বার থেকে সব ক্যাম্পে পাবেন আমাদের সার্ভিস।’’ টাকা তুলতে ভিড় জমল এটিএম-এ। পার্কের সুইমিং পুলের চাতালে সকাল থেকেই চলছে সব প্রকল্পে ‘শিয়োর সাকসেস’ প্যাকেজ। এক জন মাত্র পাঁচশো টাকায়, অন্য জন পঞ্চাশ টাকা কমে। রাষ্ট্রের জনকল্যাণের মধ্যে বাজারি প্রতিযোগিতা। প্যাকেজ-বিক্রেতাদের নাকি বিশেষ জানাশোনা আছে সরকারের নানা দফতরে, এক বার বলে দিলে পেনশন থেকে বিমা, সব হাতে এসে যাবে। শিবিরে ভিড়ের বহর দেখে অনেকেই জুটেছেন সেখানে। ফল মিলল হাতেনাতে, দু’জনকেই পিক আপ ভ্যানে নিয়ে গেল পুলিশ। পিছন পিছন ক’জন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় থানার দিকে ছুটলেন।

ঘণ্টা দুয়েক পরে জানা গেল, ধৃত দুই যুবক টেট পরীক্ষার পর চাকরির আশায় চাষের জমি বিক্রি করে টাকা দিয়ে ঠকেছেন। এ বার প্রাইমারি স্কুলে নিয়োগ আসছে। তাই এই ভুল পথে। এক যুবক পুলিশকে বলেছেন, ‘‘বেকার জীবন আর ভাল লাগে না স্যর।’’

ভিড় ভেঙে সবাই এ বার নিজ নিজ দুয়ারে ফিরছেন। কাল আবার নতুন মানুষ, নতুন লাইন।

Balurghat Swasthya Sathi Card Duare sarkar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy