Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
রবার্ট সোলো জানতেন, শ্রমের বাজার একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান
Economy

আর্থিক বৃদ্ধি ও মানুষ

সোলোর নোবেল অর্জন আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির তত্ত্বে মৌলিক অবদানের জন্যে। কী দেখিয়েছিলেন তিনি সেখানে? অর্থনীতি কী ভাবে গায়ে-গতরে বাড়ে।

—ফাইল চিত্র।

অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩১
Share: Save:

নিজের কাজকে সিরিয়াসলি নিতে হবে, নিজেকে নয়: কথাটি পেয়েছিলাম নোবেলজয়ী প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী রবার্ট সোলোর একটি লেখায়। বেশ ভাবিয়েছিল। শিক্ষাজগতে আমাদের চার পাশে ঠিক উল্টোটি দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম কিনা! এক বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক নাকি মাছের বাজারে দরাদরি করতে করতে সদর্পে বলেছিলেন, “জানো আমি কে? আমি আর্টসের ডিন।” মাছওয়ালার ত্বরিত উত্তর, “আপনি আট সের ডিম কি ষোলো সের, আমার জানার দরকার নেই, এক পয়সা দাম কমাতে পারব না।” এমনধারা দেখেশুনে এতই অভ্যস্ত ছিলাম যে, নিজেকে সিরিয়াসলি না নেওয়াও যে একটি সিরিয়াস অনুশীলনের ব্যাপার হতে পারে, তা মনে হয়নি। পল স্যামুয়েলসনও রবার্ট সোলো সম্পর্কে অনেক কথার মধ্যে বলেছিলেন, “তাঁর আচরণ দেখে মনে হয় যেন কিছুই প্রমাণ করার নেই তাঁর।” অনায়াস বৈদগ্ধে পূর্ণ সেই জীবনে ছেদ পড়ল এ বার। শতবর্ষের দোরগোড়ায় পৌঁছে রবার্ট সোলো প্রয়াত হলেন গত ২১ ডিসেম্বর। স্যামুয়েলসন প্রয়াত হয়েছেন ২০০৯-এ, ৯৪ বছর বয়সে। রবার্ট সোলো এবং পল স্যামুয়েলসন এক সঙ্গে গবেষণা ও লেখালিখি করেছেন ষাটটা বছর! এমআইটি-তে পাশাপাশি ঘরে ছিল তাঁদের অফিস। দু’জনেই নোবেলজয়ী— স্যামুয়েলসন ১৯৭০-এ আর সোলো ১৯৮৭-তে। ওঁদের বন্ধুত্বও যেন কিংবদন্তি, আর সূক্ষ্ম রসবোধ।

সোলোর নোবেল অর্জন আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির তত্ত্বে মৌলিক অবদানের জন্যে। কী দেখিয়েছিলেন তিনি সেখানে? অর্থনীতি কী ভাবে গায়ে-গতরে বাড়ে। এ প্রশ্নের উত্তর সোলোর আগে খুঁজেছেন রয় হ্যারড ও এভসি ডোমার। তাঁরা তত্ত্ব দিয়ে দেখালেন যে, ধারাবাহিক সুস্থায়ী বৃদ্ধি তেমন সুলভ বস্তু নয়। অর্থনীতিতে পুঁজি (অর্থাৎ যন্ত্রপাতি, কারখানা ইত্যাদি) ও শ্রমের অনুপাত যদি পরিবর্তনশীল না হয়, তা হলে এক দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আর অন্য দিকে সঞ্চয়-বিনিয়োগ-উৎপাদনের হার যে একে অপরকে মেনে চলবে, তার নিশ্চয়তা নেই। এরা মিলতে পারে এক দুর্লভ সমাপতনের কারণে। যেন ছুরির ফলার উপর দিয়ে গুবরে পোকার হেঁটে যাওয়ার মতো— একটু এপাং ওপাং হলেই ঝপাং। ‘নাইফ-এজ’ সমস্যা নামে এর পরিচিতি। সোলো বললেন, তা কেন? ওই পুঁজি ও শ্রমের অনুপাতকে স্থির ধরে নেওয়াতেই অমনধারা হচ্ছে। আঁটসাঁট গাণিতিক যুক্তি এবং প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, সুস্থায়ী বৃদ্ধি সম্ভব, কারণ যন্ত্রপাতির ভাড়া (যাকে বলে ‘রেন্টাল অন ক্যাপিটাল’) আর মজুরির হার ওঠানামা হবে আর সেই মতো পুঁজি ও শ্রমের অনুপাতেও পরিবর্তন হয়ে অন্য হারগুলির সঙ্গে মানিয়ে নেবে। তিনি আরও দেখালেন যে, অর্থনীতিতে বাড়বাড়ন্ত সম্ভব হয় শুধু যে পুঁজির স্ফীতির কারণে তা নয়, পুঁজি ও শ্রমের যৌথ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে, আর সেটি হয় প্রযুক্তির প্রগতির জন্য, যা শুধু পুঁজির স্ফীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থনীতির প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে পরিচিত সোলোর প্রবৃদ্ধির যে মডেল তাঁকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যায়, তা প্রকাশিত হয় ১৯৫৬-য়। তাঁর বয়স তখন ৩২!

এই লেখায় রবার্ট সোলোর প্রবৃদ্ধির তত্ত্ব নিয়ে নয়, কথা বলব শ্রমের বাজারের বিশেষত্ব, শ্রমিকের ভালমন্দ, বেকারত্ব, কর্মহীনদের জন্যে নগদ হস্তান্তর ইত্যাদি নিয়ে। সোলোর পরবর্তীকালের ভাবনায় এই বিষয়গুলির উপস্থিতি দেখি অনেক বেশি। এই বিষয়গুলি নিয়ে অর্থশাস্ত্রে তেমন সর্বজনমান্য তত্ত্ব নেই। অথচ নীতিচিন্তায় ও আলোচনায় এদের গুরুত্ব কম নয়। এ সব বিষয়ে তত্ত্বায়নের প্রচেষ্টা যে-হেতু সহজে সাফল্যের মুখ দেখে না, তাই মূলধারার তাত্ত্বিক অর্থশাস্ত্রে এদের খানিকটা প্রান্তিক হয়েই থাকতে হয়। তাই সোলোর রচনায় এই সব বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণগুলি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হলেও মূলধারার তাত্ত্বিক অবদানগুলির মধ্যে সেগুলি আলোচিত হয় না। যেমন তাঁর ওয়ার্ক অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার, দ্য লেবার মার্কেট অ্যাজ় আ সোশ্যাল ইনস্টিটিউশন পুস্তিকাগুলি, কিংবা অমর্ত্য সেনের সম্মানে যে প্রবন্ধ সঙ্কলনটি প্রকাশিত হয় সেখানে তাঁর প্রবন্ধ ‘মাস আনএমপ্লয়মেন্ট অ্যাজ় আ সোশ্যাল প্রবলেম’। শিরোনামগুলি থেকেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর ঝোঁকটি ছিল কোন দিকে।

তাত্ত্বিক মতাদর্শের দিক থেকে রবার্ট সোলো ছিলেন কেন্‌স ঘরানার। অর্থাৎ অর্থনীতির স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতায় সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে, এ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না তিনি। বেকারত্বের কথা ঘুরেফিরেই তাঁর লেখায় এসেছে। গত শতকের ত্রিশের দশকের গোড়ায় যে মহামন্দা ইউরোপ আমেরিকার সমাজজীবনকে ওলটপালট করে দিয়েছিল, তা তাঁর মানসপটে গভীর রেখাপাত করে। তিনি সামাজিক রাজনৈতিক মতের দিক থেকেও নিজেকে রাখতেন ‘কেন্দ্রের বাম দিকে’। ফলে আমেরিকার নব্য ধ্রুপদী ঘরানার যে ম্যাক্রোইকনমিক্স, তার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ছিল অনেকটা। রোনাল্ড রেগনের আমলে নব্য ধ্রুপদীদের নীতিনির্ধারণ ক্ষমতার শীর্ষে চড়ে বসায় সোলো বিচলিত বোধ করতেন খুব। কাজের বাজার এবং কল্যাণমূলক ব্যয় নিয়ে যে প্রশ্নগুলি তাঁর আলোচনা থেকে উঠে আসে, তাদের সর্বজনমান্য উত্তর যে আমরা খুঁজে পেয়েছি তা বলা যায় না— কিন্তু সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। নব্য ধ্রুপদীদের এ সব বিষয়ে স্বভাবতই আগ্রহ কম। সোলোকে যখন প্রশ্ন করা হয়, নব্য ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ— যেমন রবার্ট লুকাস বা টমাস সার্জেন্ট— এঁদের সঙ্গে তাঁর মত বিনিময় হয় কি না, তিনি স্বভাবসুলভ রসিকতায় উত্তর দেন— “আমাদের কথোপকথন অনেক সময়ে এ রকম হয়: ‘আমি আজ গ্রাঞ্চেস্টার গেছিলাম’, ‘দ্যাট’স ফানি, আমি যাইনি’!”

রবার্ট সোলো।

রবার্ট সোলো।

বেকারত্ব নিয়ে চর্চায় অর্থশাস্ত্রী এবং সমাজবিদ্যার গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গির একটা স্পষ্ট ফারাক দেখা যায়। সমাজবিদ্যায় দীর্ঘ ট্র্যাডিশন আছে বেকারদের অবস্থা জানার— কাজ হারিয়ে বা না পেয়ে তাঁরা কী ভাবে যুঝছেন, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য কেমন ইত্যাদি। অর্থনীতিবিদরা আবার এ দিকটি নিয়ে তেমন আগ্রহী নন। তাঁদের আগ্রহ বেকারত্বকে ব্যাখ্যা করায়, তার কারণগুলি খুঁজে বার করায়। সোলো বলছেন, দু’দলের এই ভাগাভাগির জন্যে বোঝাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যেমন, এক জন মহিলা যিনি সম্পূর্ণ একা বাচ্চা মানুষ করছেন, তিনি যখন স্বল্প মজুরির দীর্ঘ সময়ের কাজ ছেড়ে সরকারি ভাতার উপর নির্ভর করা স্থির করছেন, তাঁর চয়নের স্বাধীনতা কতটুকু? ভাতা-নির্ভরতা নিয়ে অর্থশাস্ত্রীদের মধ্যে যে ‘গেল গেল’ ভাব দেখা যায়, সেখানে এগুলি কতটুকু স্থান পায়? এক দিকে সবাইকে শ্রমের বাজারের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে এই মত, আর অন্য দিকে ভাতা-ব্যবস্থার কোনও সংস্কারের কথা উঠলেই আপত্তি তুলতে হবে গরিব-বিরোধী নীতি বলে, এই দুই চরমপন্থার মাঝামাঝি এক অবস্থানের পক্ষে সোলো যুক্তি সাজান। সোলোর যুক্তি, আমেরিকার মতো দেশে সামাজিক সংস্কৃতি এমনই যে, কর্মহীন মানুষকে উদ্যমহীন বলে ধরে নেওয়া হয়, আর অধিকাংশ কর্মহীন মানুষও তা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় যদি কাজটি অতি নিম্ন মজুরিরও হয়, তা গ্রহণে উৎসাহিত করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু ভাতা/ভর্তুকিরও ব্যবস্থা রাখা যায়। অর্থাৎ দু’টিকে পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে দেখতে হবে। নানা সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, কোনও নির্দিষ্ট মজুরিতে কোনও কাজ এক জন নিচ্ছেন, আর এক জন নিচ্ছেন না। যিনি নিচ্ছেন না তিনি যে আয়েশ করে শুয়ে-বসে সরকারি টাকায় জীবনযাপনের লোভে তা করছেন, তা কিন্তু নয়। এই পর্যবেক্ষণগুলি বিশেষত পাওয়া যায় সমাজবিদ্যার গবেষণা থেকে। প্রেসিডেন্টের ইকনমিক কাউন্সিলের অর্থনীতিবিদদের তা সাধারণত ভাবায় না।

অর্থশাস্ত্রীদের কাছে শ্রমের বাজারের একটি বিশেষ ধাঁধা ফিরে ফিরে আসে। চার পাশে এত মানুষ কর্মহীন, কিন্তু তাঁরা নিয়োগকারীকে গিয়ে বলেন না কেন যে, এখনকার কর্মীদের ছাঁটাই করে তাঁদের কাজে বহাল করলে তাঁরা তুলনায় কম বেতনে একই কাজ করে দেবেন? সোলো বলছেন, এখানেই সামাজিক মানবিক বাধ্যবাধকতা এসে পড়ে। ‘ওটি অন্যায়’— বেকারদের প্রশ্ন করলে অনেকেই এ রকম বলেন। সামাজিক আচরণবিধি, তার ন্যায্যতা সম্পর্কে বোধ, এগুলি অর্থবিদ্যার সঙ্কীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক হিসাব-কষা ব্যক্তির মডেলের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না। আর অর্থশাস্ত্রের উচ্চ আসনে বসে সোলো এগুলিই মনে করিয়ে গেছেন— তোমরা যাকে ‘শ্রমের বাজার’ বলে আলু-পটলের বাজারের সঙ্গে এক করে ফেলো, বারে বারে মনে করিয়ে দিই যে, এটি একটি আদ্যন্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economy Labour market
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE